২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

চরম বেপরোয়া তরুণ

-

ইতিহাস থেকে আমরা জেনেছি অল্প বয়সের তরুণরা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে বড় বড় লড়াই সংগ্রাম চালিয়েছে। বড় বড় ইস্যু নিয়ে তর্ক যুক্তি দিয়েছে লেখালেখি করেছে। কবি সাহিত্যিক হয়েছেন, বিজ্ঞানী হয়েছেন, দার্শনিক হয়েছেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তিনি তো খুব ছোট বয়সেই বড় মাপের লেখালেখি করেছেন।

তরুণ বয়সে সবাই যে খুব ভদ্র নম্র হবেন, ডিসিপ্লিন মানবেন সেটা কিন্তু নয়। তরুণদের মধ্যে অনেক ধরনের উত্তেজনা থাকবেই। বিভিন্ন খেলাধুলা করা। পুকুর খাল নদী সমুদ্রে সাঁতার কাটা ইত্যাদি নানান শখ তাদের থাকবে। মোটরযান চালানোর শখ, সেটাও থাকতে পারে।

আমার শিশুবেলার কথা মনে আছে। তখন ঢাকা চট্টগ্রামের শহরে জিপ গাড়ি দেখে যেত। মাঝে মাঝে সেসব গাড়িতে চড়েছি। ১৯৯১ সালে আমাদের বাসা ছিল চট্টগ্রাম শহরে। তখন আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের বাসায় বাপ্পীদের বাসা ছিল। বাপ্পী ভাইয়ের মধ্যে অদ্ভুত একটা শখ দেখেছি। তিনি জিপ গাড়ির ধোঁয়ার গন্ধ পছন্দ করতেন! আমাদের বাসার সামনে একটা সরকারি জিপ পার্কিং থাকত। সেটা স্টার্ট করার সময় বাপ্পী ভাই দৌড়ে যেতেন! তখন হালকা যানগুলোর কার্বোরেটর ইঞ্জিনের ছিল। স্টার্ট করার সময় মজার শব্দও হতো!

এখনকার মতো আধুনিক গাড়ি তখন ছিল না। তখনকার মার্সিডিজ গাড়ি আর এখনকার মার্সিডিজ গাড়ি এক নয়। অনেক আপডেট প্রযুক্তি এসেছে। রাজধানী ঢাকা তখন এত বড় ছিল না। তখন ঢাকার রাস্তায় অল্পসংখ্যক মোটরযান চলাচল করতে দেখেছি। এখন তো ঢাকার রাস্তায় উন্নত ব্রান্ডের হাজার হাজার গাড়ি। আমরা ছোটবেলা বহু দুরন্তপনা করেছি। আমরা প্রচুর সময় বাই সাইকেল চালিয়েছি। গ্রামে গিয়ে পুকুর-খাল-নদীতে সাঁতার কেটেছি। কলাগাছ দিয়ে ভেলা তৈরি করেছি। চড়ুইভাতির আয়োজন করেছি। নারকেল গাছসহ বিভিন্ন ফল গাছে উঠেছি।

বিভিন্ন ছেলেদের সাথে মারামারি করেছি! ১৯৯৪ সালে গ্রামের একজন কিশোরকে এক অন্যায় কাজের জন্য তাকে মেরেছিলাম। পরের দিন নির্জন এক রাস্তায় তারা আমার ওপরে পেছন দিয়ে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। এতে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। অবশ্যই এতে তাদের অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। বাড়িছাড়া হয়েছিল কিছু দিনের জন্য। আরো অনেক ঘটনা হয়েছিল। এসব উদাহরণ টানলাম এটা বোঝার জন্য আমরা এই সমাজ রাষ্ট্রেই শিশু-কিশোর বয়স পার করেছি। আমরা দরবেশ ছিলাম না!

বর্তমানে আমাদের তরুণরা অতি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা লাখ লাখ টাকা খরচ করছে নেশাসহ নানা ধরনের ভোজ ফুর্তির জন্য। এখন অনেক লোকের প্রচুর অবৈধ টাকা পয়সা হয়েছে। তারা তাদের সেই অবৈধ টাকা তাদের ছেলেমেয়েদের হাতে দিচ্ছে। অতীতে এরকম ছিল না। অল্প কিছু লোক তখনও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বিত্তশালী হতে পারত। এখন ছোটখাটো পদের সরকারি কর্মচারীদেরও ঢাকার অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট আছে। চারদিকে ভোগের সামগ্রী। বৈধ-অবৈধ অনেক সম্পদশালীর সন্তান অতি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই বেপরোয়াটা হচ্ছে নেতিবাচকভাবে। যদি এমন হতো তারা দেশ ও জাতির কল্যাণে ভালো কাজের জন্য অতি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, সেটা ভিন্ন কথা ছিল।

সরকারি আমলা, ব্যবসায়ী, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তির সন্তান মদসহ নানা ধরনের মাদকে অতি মাতাল হয়ে উঠেছে। তারা দামি গাড়ি নিয়ে রেস করছে। তাদের গাড়িতে থাকছে মদ, এটা-সেটা, কলগার্ল ইত্যাদি। সা¤প্রতিক সময়ে ঢাকার মহাখালীতে ফ্লাইওভারের সাথে একটি মিতসুবিসি আউটলেন্ডার মিনি জিপ ধাক্কা লাগে। এতে সাথে সাথেই দু’জন মারা যায়। আরেকজন গুরুতর আহত হয়। এ গাড়ির সবাই তরুণ বয়সের। এরা বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তাদের সন্তান। এদের মধ্য সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তার এক সন্তানও রয়েছেন। বেশির ভাগ লোক জানে, সামরিক অফিসাররা যথেষ্ট ভদ্র হন। ডিসিপ্লিনের হন। তাদের পরিবারের সদস্যরাও থাকেন ভালো ডিসিপ্লিনের মধ্যে।

কয়েক বছর যাবৎ দেখতে পাচ্ছি পরিস্থিতি বদলে গেছে। নানান আপত্তিকর কর্মে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে ডিসিপ্লিন পরিবারের সন্তানরাও। দুই বছর আগে ঢাকার গুলশানে সরকারদলীয় প্রভাবশালী পরিবারের এক কিশোর গাড়ি রেস করে এক রিকশাওয়ালাকে হত্যা করে। মিডিয়াতে যেন ব্যাপারটা ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য তারা ভিন্ন কৌশলে চেপে রাখে।

কয়েক মাস আগে আমার স্ত্রী সন্তানসহ বারিধারা আবাসিক এলাকায় যাই। দেখলাম সেখানে রেঞ্জ রোভার গাড়ি দিয়ে বেপরোয়াভাবে রেস করছে তরুণরা। এ সময় রাস্তায় আবাসিক এলাকার অনেকেই হাঁটাহাঁটি করছিলেন, ঘটতে পারত ভয়ানক দুর্ঘটনা। কয়েক দিন আগে বেপরোয়া প্রাইভেটকার চালিয়ে পাঁচ মাস বয়সের এক শিশু এবং তার বাবাকে গুরুতর আহত করা হয়েছে। তারা রিকশায় ছিল। যার ভিডিও চিত্র ভাইরাল হয়েছে। ঢাকার একটি গাড়ির কোম্পানির চেয়ারম্যানের কথা জানি। তার ছোট ছেলে ঢাকা-ময়মনসিংহ এলাকায় প্রায়ই বেপরোয়া গাড়ি চালাত। সেই ছেলে তার বাবার পাঞ্জাবির কলার ধরে টান মেরেছিল। এর দু’দিন পর সেই চেয়ারম্যান স্ট্রোক করে ইন্তেকাল করেন। কারণ ছিল- সম্পত্তির ভাগাভাগি।

আমরা ঐশীর খবর অনেকে জানি। একজন পুলিশ কর্মকর্তা কিভাবে তার মেয়েকে লাখ লাখ টাকা দিয়ে উগ্র বানিয়েছিল তার জ্বলন্ত উদাহরণ ঐশী। দেশে অবৈধ সম্পদশালীর সংখ্যা বেড়েছে। অবৈধ ক্ষমতার লোকজনও বেড়েছে। তারা তাদের সন্তানদের হাতে সেই অবৈধ টাকার বস্তা তুলে দিয়ে তাদের চরম বেপরোয়া বানিয়েছে। অতীতে এটা এত সংখ্যক ছিল না। সুশাসন কায়েম না হলে এ বেপরোয়াদের সভ্য বানানো সম্ভব নয়।


আরো সংবাদ



premium cement