২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

রাজস্ব বাড়াতে কর কমিশন দরকার

-

বাংলাদেশে জিডিপি ছিল ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। আমরা যদি ২০২০ সালের আগের পাঁচ বছরের দিকে নজর দিই, তাহলে দেখা যাবে, প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়ের পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। নেপাল একটি ছোট দেশ। সেটিও রাজস্ব জিডিপিতে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। যেমন- ২০১৯ সালে নেপালে কর জিডিপির হার ছিল ২৬ দশমিক ০২ শতাংশ, একই সময়ে বাংলাদেশে ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। ভারতে ছিল ১৯ দশমিক ০৬ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৪ দশমিক ০৭ শতাংশ। গত ২০২০ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২৫ দশমিক ০৬ শতাংশ, ২০১৯ সালে ছিল ২৫ দশমিক ০৩ শতাংশ, ২০১৮ সালে ২৬ দশমিক ০১ শতাংশ।

যাই হোক, বাংলাদেশের রাজস্ব খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে ঠিকই তবে আশানুরূপ গতিতে বাড়ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব খাতে প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশে পৌঁছালেও করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক ধাক্কায় কমে আসে ৪ দশমিক ০২ শতাংশে। বর্তমান সরকার রূপকল্প-২০৪১ ঘোষণা করেছে। উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে রূপকল্প-২০৪১-এর রোডম্যাপ বা পথচিত্র তৈরি করা হয়েছে। আগামী ২০ বছরের জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনার কথাও বলা হয়েছে। ওই সময়ে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ, আর কর জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ শতাংশ। এমতাবস্থায় রাজস্ব আহরণের গতি অবশ্যই বাড়াতে হবে। অন্য দিকে, টেকসই লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বিশ্বব্যাপী আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন অতিরিক্ত বিনিয়োগ দরকার। আর বাংলাদেশের দরকার ৯২৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রতি বছর অতিরিক্ত ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ লাগবে। ব্যাপক এই বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে রাজস্ব খাতে ব্যাপক সংস্কার করে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা বাড়াতে হবে, আঞ্চলিক সহযোগিতাও বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। আর এর মধ্যে আয়কর দেন মাত্র সাড়ে ১৭ থেকে ১৮ লাখ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জরিপ অনুযায়ী, আয়কর দিতে সক্ষম প্রায় এক কোটি লোক। বিপুল সংখ্যক লোক এখনো করের আওতার বাইরে। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে সরকারের আয়ের প্রধান উৎস হলো রাজস্ব খাত। আর সেটা আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে। চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫৮ দশকিক ১ শতাংশ আর করবহিভর্র্‚ত খাত থেকে প্রাপ্তি ধরা হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতায় সর্বাধিক রাজস্ব আসে মূল্যসংযোজন কর (ভ্যাট) থেকে।
আর এই ভ্যাট ফাঁকির প্রবণতা বেশি। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে রাজস্ব বা আয়কর না দেয়ার একটা প্রবণতা তো আছেই। সক্ষম করদাতাদের মধ্যে কর না দেয়া যেন মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বড় বড় করদাতারা কর প্রদানে নানা টালবাহানা করেন, এক পর্যায়ে তারা আদালতের আশ্রয় নেন। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, উচ্চ আদালতে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ৯ হাজারের বেশি যার বিপরীতে রাজস্বের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা। সক্ষম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কর না দেয়া, কর প্রদানে টালবাহানা, রাজস্ব ফাঁকির প্রবণতা বেড়েই চলছে। এটি দেশের জন্য ইতিবাচক নয়। বিশ্বের উন্নত দেশ বা প্রতিবেশী স্বল্পোন্নত দেশেও করদাতারা স্বেচ্ছায় বা স্ব-উদোগে কর দিয়ে থাকেন। তারা কর দেয়াকে নাগরিক দায়িত্ব বলে মনে করেন। তারা আরো মনে করেন, সরকারকে রাজস্ব দেয়া একটি সম্মানজনক বিষয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়ে থাকে এবং করদাতাদের কর দিতে নানা উদ্যোগও নিচ্ছে। তবে বোর্ডের কিছু আইনি জটিলতাও আছে। যার কারণে রাজস্ব বোর্ড ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী অনেক পদক্ষেপ নিতে পারে না। তাদের আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে কর ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারে না। জনবল সঙ্কটের মুখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রয়োজনীয় জনবলও নিয়োগ দিতে পারে না।

রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ১০ হাজারের অধিক জনবল তাদের প্রয়োজন যা ইতঃপূর্বে সরকারের ঊর্র্ধ্ব মহলকে জানানো হয়েছে। বোর্ড জনবল সঙ্কটের কারণে সমস্যায় আছে বলেও জানা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেহেতু বোর্ড সরাসরি সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন। এমতাবস্থায়, করব্যবস্থা সংস্কারের জন্য ন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন নামে একটি রাজস্ব কমিশন গঠন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। ইতঃপূর্বে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে এমনো দাবি করা হয়েছিল। অর্থনীতিবিদদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী রাজস্ব ও ব্যাংকিং খাতে আলাদা দু’টি কমিশন গঠনের কথাও বলেছিলেন। মন্ত্রী বলেছিলেন, ফিন্যান্সিয়াল দিকগুলো দেখার জন্য একটি, রাজস্বের বিষয়গুলো দেখার জন্য আরেকটি, অর্থাৎ পৃথক দু’টি কমিশন গঠন করা হবে। কিন্তু এখনো সরকার সে বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজধানী ঢাকায় এমন অনেক ফ্ল্যাট আছে, যেগুলোর রেজিস্ট্রেশন করা হয় না। রেজিস্ট্রেশন ফি, স্ট্যাম্প ডিউটি এত বেশি যে, কেউ রেজিস্ট্রেশন করবে না। আমরা যদি এসব বিষয়ে একটু সহনশীল হই, তাহলে অনেক লাভ হবে।’ রাজধানী ঢাকায় বাড়ি ও ফ্ল্যাটের সংখ্যা কত, এর কোনো হিসাব নেই। বাড়ি-গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলছে। যারা বাড়ি-গাড়ির মালিক, তাদের কর দেয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু তারা করজালের বাইরে রয়েছেন। তাদের করের আওতায় আনা দরকার, দরকার এ বিষয়ে জরিপ চালানো এবং কর দিতে জনগণকে উৎসাহিত করা। জনবল সঙ্কটে হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, তাদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এক কথায় বলতে গেলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নানা সমস্যায় রয়েছে। এমতাবস্থায়, রাজস্ব বাড়াতে একটি স্বাধীন ‘স্বাধীন রাজস্ব কমিশন’ গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। সরকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবে বলে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি রাষ্ট্রের রাজস্ব উন্নয়ন হলে- দেশের সার্বিক উন্নয়ন বেগবান হবে। প্রত্যেক নাগরিককে রাজস্ব দিতে উদ্বুদ্ধ করা- সরকারের পলিসিগত একটি নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কমিশন


আরো সংবাদ



premium cement
ইভ্যালির রাসেল-শামীমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেম্যান আর নেই বিএনপি নেতাকর্মীদের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ খণ্ডালেন ওবায়দুল কাদের আটকের পর নাশকতা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলো ইউপি চেয়ারম্যানকে বদর যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন পণবন্দী জাহাজ ও ক্রুদের মুক্ত করার প্রচেষ্টায় অগ্রগতি হয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঝালকাঠিতে নিখোঁজের ২ দিন পর নদীতে মিলল ভ্যানচালকের লাশ বাল্টিমোর সেতু ভেঙে নদীতে পড়া ট্রাক থেকে ২ জনের লাশ উদ্ধার যুক্তরাষ্ট্রে ছুরিকাঘাতে নিহত ৪ সুইডেনে বসবাসের অনুমতি বাতিল কুরআন পোড়ানো শরণার্থীর ভালো আছেন খালেদা জিয়া

সকল