১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভাড়া : সেকাল-একাল

- ছবি : নয়া দিগন্ত

পঞ্চাশ দশক থেকে বর্তমান ২০২১ সাল প্রায় ৭০ বছর। আমার দীর্ঘ এই জীবনে বাড়ি ও গাড়ি ভাড়ার বিভিন্ন চিত্র প্রত্যক্ষভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে এবং তা স্পষ্ট মনে আছে।

১৯৫১-৫২ সালের কথা। আমার বাবার তখন নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানায় কর্মস্থল। ওই সময়ে যশোর থেকে লোহাগড়া থানায় সরাসরি যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। যশোর থেকে লোহাগড়া যেতে হতো খুলনা হয়ে। যশোর থেকে বাস বা ট্রেনে খুলনা।

সেখান থেকে স্টিমারে বটদিয়া পর্যন্ত। বটদিয়া থেকে নৌকায় লোহাগড়া। সকালে যশোর থেকে রওনা হলে সন্ধ্যায় পৌঁছাতে হতো।

বাবা সরকারি কর্মচারী হওয়ার সুবাদে একটি বাসা বরাদ্দ পান। সেটি ছিল হিন্দুদের পরিত্যক্ত ঘর। মেঝে পাকা, উপরে টিনের চালার দু’টি ঘর। পাকিস্তান আমলে এ ধরনের হিন্দুদের সম্পত্তিকে বলা হতো অর্পিত ও অনাগরিক সম্পত্তি। লোহাগড়া থেকে লক্ষ্মীপাশা যেতে নদী পারাপারে নৌকাই ছিল একমাত্র বাহন। নদী খরস্রোতা হওয়ায় এপার থেকে ওপার যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। খেয়া নৌকার ভাড়া ছিল পাঁচ পয়সা।

অন্য দিকে টাপুরে নৌকায় ২০-২৫ মিনিট সময় লাগত। পাটনীকে দিতে হতো দুই আনা। ওই সময় লোহাগড়ায় দুধের সের ছিল চার আনা। এক টাকায় এক সের রসগোল্লা পাওয়া যেত। মাঠা ঘোল এক সের এক আনা। লোহাগড়ার প্রাথমিক স্কুলে পড়াকালে মামাবাড়ি ঝিনাইদহে হাই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হই। মাঝে মধ্যে ছুটিতে বাড়িতে আসতাম। ঝিনাইদহ থেকে চুড়ামনকাটি পর্যন্ত বাস ভাড়া স্কুলছাত্র হিসেবে হাফ টিকিট আট আনা লাগত।

পরবর্তীকালে ষাটের দশকে আমি ঝিনাইদহ হাইস্কুল থেকে যশোর মুসলিম একাডেমিতে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হই। মুসলিম একাডেমির পাশে বকুলতলা (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিকুর রহমানের ভাস্কর্য), সেখান থেকে ঝিনাইদহ চুয়াডাঙ্গা ও মাগুরা পর্যন্ত বাস চলাচল করত। প্রতি এক ঘণ্টা পরপর বাস। সকাল সাড়ে ৭টায় প্রথম বাস। বিকেল সাড়ে ৫টায় শেষ বাস। এরপর আর কোনো বাস ছিল না। কেননা বাস ও যাত্রী স্বল্পতা। যশোর থেকে ঝিনাইদহ ২৮ মাইল পথ।

বাস ভাড়া গাড়ির পেছনে ঝিনাইদহ পর্যন্ত এক টাকা চার আনা। কেবিন পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা আসন এক টাকা আট আনা। ড্রাইভারের পেছনে ফ্রন্টে গদিযুক্ত আসনে ভাড়া এক টাকা ১২ আনা।

আমরা যারা স্কুলছাত্র, তাদের যশোর বকুলতলা থেকে চুড়ামনকাটি পর্যন্ত চার আনা ভাড়া দিতে হতো। আমাদের বাড়ি যশোর মেহেরুল্লাহ নগর স্টেশন থেকে যশোর স্টেশন পর্যন্ত ট্রেন ভাড়া ছিল পাঁচ আনা। আমরা দুই আনা দিয়ে হাফ টিকিট কাটতাম।

১৯৬৯ সালে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যশোর রেল স্টেশন থেকে আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আট টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন পর্যন্ত টিকিট কাটতাম। যশোর থেকে রাজশাহী পর্যন্ত ভাড়া ছিল ১৬ টাকা। রেলের টিটিই টিকিট চাইলে আমরা হাফ টিকিট প্রদর্শন করতাম। টিকিট দেখে তিনি মুচকি হাসতেন। মুখে কিছুই বলতেন না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তবুও টিকিট করেছি, বিষয়টি উভয়ের কাছে একটি আত্মসম্মানের ব্যাপার ছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, যশোর থেকে ঢাকা বিআরটিসি পরিবহন ভাড়া ৪৫ টাকা। যশোর রেল গেট এলাকায় সোহাগ পরিবহনে ৭৫ টাকা ভাড়া দিয়ে ঢাকায় যেতাম। যাত্রীদের সকালের নাশতার প্যাকেটও দিত পরিবহন কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও দ্রæতি, দিগন্ত, খন্দকার, ডলফিন, যাত্রিক, ঈগল প্রভৃতি পরিবহন ভাড়া ৭০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে ছিল।

১৯৭২ সালে যশোর শহরের পুরনো কসবা কাজীপাড়া এলাকায় ছিল আমার ভাড়াটিয়া বাসা। তখন কাজী নজরুল ইসলাম কলেজে শিক্ষকতা করি। পুরনো কসবায় চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে সাতমাইল বারীনগর পর্যন্ত বাস ভাড়া দিতাম তিন টাকা। যাতায়াত খরচ পড়ত প্রতিদিন ছয় টাকা।

চুড়ামনকাটি বাজার থেকে যশোর ‘মনিহার’ পর্যন্ত বহুকাল জনমজুররা তিন টাকা ভাড়া দিয়ে বাসে যাতায়াত করেছেন। তারা বিশেষ ছাড় পেয়েছেন বাস কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।

আমি বেশ কয়েকবার প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানে ট্রেন ভ্রমণ করেছি। বনগাঁ থেকে শিয়ালদহ রেল স্টেশন ৮০ কিলোমিটার, ভাড়া ১৪ টাকা ছিল। এখন ভাড়া ২০ টাকা। এতে সেখানকার ট্রেনযাত্রীরা খুবই ক্ষুব্ধ। ট্রেন ভাড়া ছয় টাকা বাড়ানো হলো কেন?

কলকাতা হাওড়া স্টেশন থেকে দিল্লি পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার। ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’ এয়ারকন্ডিশন ট্রেনের ভাড়া ৮০০ টাকা। দুপুর ও রাতের খাবার ও পানীয় যাত্রীদের দেয়া হয় সাথে। ‘তুফান মেল’ ট্রেন ভাড়া ৪০০ টাকা ৩৬ ঘণ্টা লাগে দিল্লি পৌঁছাতে। এ ছাড়াও উড়িষ্যা, পুরী, আজমির শরিফ, ভুপাল, আগ্রা প্রভৃতি স্থান ট্রেন ভ্রমণকালে একটি কথা বারবার মনে ঘুরপাক খেয়েছে- কী করে এত কম ভাড়ায় তারা যাত্রীসেবা দিতে পারেন? শুনেছি, এর পরও ভারত সরকার মোট জাতীয় আয়ের একটি বড় অঙ্কের রাজস্ব তারা রেল থেকে আয় করে থাকে।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে আমার বহুদিনের স্বপ্ন ছিল কাজী নজরুল ইসলামের কবি তীর্থ ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতন ঘুরে দেখার। ২০১৫ সালে সাত দিনব্যাপী এই ভ্রমণের কর্মসূচি। আমার আত্মীয় ছোট ভাইয়ের শ্যালক চৌধুরী মান্নান মিন্নুর বীরভ‚মের শিউড়ির বটেশ্বর বাসায় উঠি। সেখান থেকে বর্ধমানের চুরুলিয়ায় কাজী নজরুলের বাসভবনে দুই দিন অবস্থান করে লেখালেখির জন্য তথ্য সংগ্রহ করি। আমার লেখার বিষয়বস্তু ছিল : কেমন আছে কবিতীর্থ নজরুলের চুরুলিয়া। লেখাটি নজরুল চর্চা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দেয়ার পর বিচারকমণ্ডলীর বিচারে কাজী নজরুলের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমাকে ‘জাতীয় কবি পদক-২০১৫ সাদা মনের মানুষ’ দেয়া হয়।

এরপর চুরুলিয়া থেকে বাসযোগে বীরভ‚মের বোলপুর পর্যন্ত। সেখান থেকে শান্তি নিকেতনে যাই। সেখানে কত কম টাকায় বহু দূরত্বের পথ বাসে ভ্রমণ করা যায় এ কথা বলাবাহুল্য।

বিদায়কালে দেশে ফেরার দিন আমার আত্মীয় মিন্নু শিউড়ির কচুজোড় হল্ট থেকে হাওড়া পর্যন্ত ট্রেনে একটি টিকিট কেটে দেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ২৩২ কিলোমিটার, ট্রেন ভাড়া মাত্র ৪০ টাকা। এত দূরত্বের পথ কত কম টাকায় তারা যাত্রীসেবা দিতে পারছেন ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।

এবার আসি বাড়ি ভাড়া প্রসঙ্গে। ১৯৭২ সালে যশোর শহরের পুরনো কসবা কাজীপাড়ায় তারা কাজীর বাড়ির দোতলার নিচতলা ভাড়াটিয়া হিসেবে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতাম। ভাড়া ছিল মাসিক ৫০ টাকা। এরপর পারভীনা হোটেলের পেছনে লতা চেয়ারম্যানের দোতলার নিচতলায় মাত্র ৭০ টাকা ভাড়া দিতে হতো।

যশোর প্রধান ডাকঘরের ছিল রাঙা মিয়ার হোটেল। বৃহত্তর যশোর জেলার মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল মহকুমার প্রত্যন্ত এলাকার জনগণ অফিস আদালতের কাজে যশোরে আসতেন। তাদের থাকা খাওয়ার জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা ছিল এই হোটেলে।

দুপুরে-রাতে খেলে থাকা ফ্রি। শীতকালে হোটেলে অবস্থানকারী বোর্ডারদের রাতে শোয়ার পর একটি বড় সাইজের লেপ তাদের গায়ে বিছিয়ে দেয়া হতো। আর স্পেশাল খাবার ছিল চ্যাং মাছ দিয়ে লাউ রান্না।

নব্বইয়ে দশকে কলকাতা যাওয়ার পথে বনগাঁ থেকে ট্রেনে ওঠার পর একই বগিতে আমার কলেজ জীবনের শিক্ষক আবদুর রহিম স্যারকে দেখতে পাই। তিনি সপরিবারে তার আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছেন। স্যারের শ্বশুরালয় কলকাতা শহরের তপসীয়া রোডে। একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছেন। স্যার আমাকে ছাড়লেন না। তার আত্মীয়ের বাসায় উঠতে হলো আমাকে। স্যারের শ্বশুরের পুরনো বাসভবন পাকা টিনের শেড। পাশেই দুই শ্যালকের চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ি।

রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে আলাপচারিতার একপর্যায়ে জানা গেল, এই ফ্ল্যাটে প্রতিটি ইউনিট ভাড়া মাত্র ৪৫০ টাকা। তাও আবার বিগত ৮-১০ বছর ধরে একই ভাড়া বহাল আছে। কলকাতা সিটি করপোরেশন ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করে। ইচ্ছা করলেই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়াতে পারেন না। সেখানকার
নিয়মকানুন করপোরেশন ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ দেখেন- মালিকের স্বার্থ নয়।

গত মাসে জানা গেল, আমার ছোট মেয়ে ঢাকার মিরপুর এলাকায় যে বাসাতে ভাড়া থাকে, বাড়িওয়ালা একধাপেই তিন হাজার টাকা বেশি ভাড়া বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন। পরে শেষমেশ দুই হাজার টাকায় রফা হয়।

জীবনসায়াহ্নে এসে এখনকার দিনে গাড়ি ও বাড়ি ভাড়া নিয়ে বড় বাড়াবাড়ি দেখছি। এতে আমি খুবই হতাশ। এর থেকে আমরা কবে, কিভাবে মুক্তি পাবো- এটিই আজ আমার প্রশ্ন।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, কলাম লেখক ও উন্নয়নকর্মী


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিএনপি : কাদের রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্তযুদ্ধ দিবস পালিত

সকল