২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সংবিধান বনাম সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা

- প্রতীকী ছবি

গণতন্ত্র চর্চার জন্য আমাদের দেশের সংবিধান মন্দ নয়; বরং বোঝার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধানের চেয়ে আমাদের দেশের সংবিধান অনেকটা স্পষ্ট ও সহজ। আমাদের সংবিধানে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সুস্পষ্ট ধারা সন্নিবেশিত আছে। এখানে আইনের শাসন নিশ্চিতকল্পে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতাসহ মৌল মানবিক অধিকার যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার নিশ্চয়তার কথা উল্লেখ আছে। এগুলো সবই সংবিধানে লিখিত বিধান মাত্র। কার্যত সংবিধানে যা আছে আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টোটি ঘটে চলেছে প্রতি মুহূর্তে।

আমরা যদি চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার কথা বলি তা হলে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ৩৯ অনুচ্ছেদে যেমন বলা আছে, উপধারা (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে : (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার, নিশ্চয়তা দান করা হইল।

সংবিধানের এমন বিধান থাকা সত্ত্বেও একজন লেখক ও সাংবাদিকদের জেলে যেতে হয়? কেন মুশতাক আহমেদকে কারাগারে জীবন দিতে হলো? কেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে আটক করে নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হলো? কেন তাকে ১০ মাস কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটাতে হলো? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে একেকজন লেখক, সাংবাদিকের গলা চেপে ধরা হচ্ছে। ‘পক্ষকাল’ পত্রিকার সম্পাদক ও বণিকবার্তার ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি শেয়ার করার কারণে তাকে ৫৪ দিন নিখোঁজ ও দীর্ঘ দিন কারাগারে থাকতে হয়েছিল। এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চরম হুমকি ।

সংবিধান যেখানে বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতা এবং সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে সেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে কেন সংবাদকর্মী ও মুক্তমত প্রকাশকারী ব্যক্তিদের ক্রমাগতভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতন করা হচ্ছে তা প্রশ্নের দাবি রাখে। আসলে, যেকোনো সরকারবিরোধী সমালোচনা, উষ্মা, মতবিরোধকে চুপ করিয়ে দিতে সরকার এই আইন প্রয়োগ করছে। প্রকৃতপক্ষে সরকারের এই আচরণ স্বৈরতান্ত্রিকতার বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশে সাাংবাদিকতা এক বিপজ্জনক পেশা। বিপজ্জনক শুধু এ দেশের সাংবাদিকদের জন্য নয়। পৃথিবীর নানা দেশের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। যেমন ২০২০ সালের মার্চ মাসে মেক্সিকোর সাংবাদিক মিরোস্লোভা ব্রিচ ভেল ডুসিয়াকে খুন করা হয়। তার অপরাধ ছিল, রাজনৈতিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার থাকা। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, দেশে দেশে শাসকদের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা যত বাড়ছে, ততই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার, বাকস্বাধীনতার যার সাথে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত তার ওপর আঘাত নামছে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এই প্রবণতাকে ‘প্যান্ডেমিক অব অথরিটারিয়ানিজম’ বা কর্তৃত্ববাদের অতিমারী বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, আজ সারা বিশ্বই এই জাতীয় অতিমারীর মুখোমুখি এবং মানবজীবনে ভিন্ন ভিন্নভাবে কিন্তু ‘পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত’ উপায়ে তা প্রভাবিত করছে। আরো একটু স্পষ্ট করে তিনি বলছেন, “দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট মনে করতেন ‘জনপরিসরে সব বিষয়ে লোকের বিচারবুদ্ধি ব্যবহারের স্বাধীনতা’র চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হতে পারে না। অথচ প্রায়ই সমাজে মতামত প্রকাশের সুযোগগুলোকে চেপে দেয়া হয়। আজকের পৃথিবীতে এশিয়া, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এবং খাস আমেরিকাতে স্বৈরতন্ত্র বলিয়ান হয়ে উঠেছে, এটি একটি প্রকাণ্ড দুশ্চিন্তার কারণ।”

বাকস্বাধীনতা ও তর্কবিতর্কের স্বাধীনতা- স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও প্রগতির পূর্বশর্ত এবং তা আমরা কখনোই বিসর্জন দিতে পারি না। আর কেউ এই মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। একই সাথে বলে রাখি এই স্বাধীনতাহীনতা শুধু সাংবাদিক, সাংবাদিকতার জন্য বিপজ্জনক নয়, বিপজ্জনক পাঠক, শ্রোতা, দর্শক ; অর্থাৎ নাগরিক ও রাজনৈতিক সমাজের কাছেও।

কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেই তার গলা টিপে ধরতে হবে এটি গণতান্ত্রিক আচরণের বিপরীত। গত ৩ মার্চ জম্মু ও কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ডা: ফারুক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা খারিজ করে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কউলের নেতৃত্বাধীন বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তার সমন্বিত বেঞ্চের পক্ষ থেকে বলা হয়, “কোনো দৃষ্টিভঙ্গি সরকারের মতের বিরোধী ও তা থেকে ভিন্ন হলেই তাকে ‘দেশদ্রোহ’ বলা যায় না” (নয়া দিগন্ত, ৪ মার্চ ২০২১)।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন অধিকার হরণ করে এক দিকে তথ্যহীনতা, সংবাদহীনতা অন্য দিকে সরকারের বুলিকে বেশি করে প্রচার করে সাধারণ মানুষকে দেশ-কাল-অর্থনীতি বিষয়ে তার যে তথ্যের অধিকার, জানার অধিকার, সে বিষয়ে মতামত সৃষ্টির অধিকার তা থেকে বঞ্চিত করে চলেছে। এর ফলে দেশের নাগরিক সমাজ, বৃহত্তর রাজনৈতিক সমাজকে ক্রমে বিপন্ন করে তুলেছে।

বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক ২০২০ (ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স-২০২০) এ বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম, যা ২০১৯ সালে ছিল ১৫০তম অবস্থানে।

এই সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন মারাত্মকভাবে বেড়েছে। মাঠপর্যায়ে সংবাদকর্মীদের ওপর রাজনৈতিক কর্মীদের হামলা, নিউজ ওয়েবসাইট বন্ধ ও সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনা বেড়েছে বলে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের জন্য অশনি সঙ্কেত হলো এই যে, অনেক দেশের সরকারই সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেখতে রাজি হচ্ছে না। দেখছে প্রতিপক্ষ হিসেবে। খোলাখুলিভাবেই তারা বিরাগ, বিতৃষ্ণা প্রকাশ করছে। সরকারের গোলাম, চাটুকার হয়ে টিকে থাকতে পারলে তার অবস্থান সুদৃঢ় হচ্ছে। কিন্তু বিবেকের স্বাধীনতা সব ব্যক্তিকেই গোলাম, দাসত্ব, আর চাটুকার বানাতে পারে না। যার কারণে বেশির ভাগ সাংবাদিক তার পেশার প্রতি বিতৃষ্ণা পোষণ করছেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে ‘অ্যান ইনভেস্টিগেশন ইনটু রিস্ক টু মেন্টাল হেলথ অব বাংলাদেশী জার্নালিস্টস’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায় ৭৯.১ শতাংশ সাংবাদিক তার নিজ পেশা নিয়ে সন্তুষ্ট নন (কালের কণ্ঠ, ৪ মার্চ ২০২১)।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে সংবাদকর্মীরা সরকারের বিপক্ষে যায় এমন নিউজ করার সময় আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি মিডিয়া ওয়াচডগ বডি আর্টিকেল ১৯-এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯৮টি মামলায় ৪৫৭ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে ও গ্রেফতার করা হয়েছে। ৪১টি মামলার আসামি করা হয়েছে ৭৫ জন পেশাদার সাংবাদিককে। তাদের মধ্যে ৩২ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে (নয়া দিগন্ত, ৭ মার্চ ২০২১)।

বাংলাদেশের এ কালাকানুনের ব্যাপক অপব্যবহারের মাধ্যমে সাংবাদিক, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, কার্টুনশিল্পী ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্ন মতপ্রকাশকারীসহ নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন ও হয়রানির সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে লেখা হচ্ছে ‘ডিজিটাল হাইওয়ে বিকামস ডিজিটাল জেল’। এ আইনের অপব্যবহার করে সরকার ভিন্ন মত দমন ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করতে চাইছেন।

সাংবাদিক, লেখক, কার্টুনিস্টসহ যেসব নাগরিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই জামিনে মুক্তির অধিকার থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। কাউকে কাউকে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, এমন অভিযোগ পাওয়া যায়।

সব আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারা বাংলাদেশের সংবিধানের মৌল চেতনা ও মতপ্রকাশ, অবাধ তথ্যপ্রবাহ এবং মৌলিক মানবাধিকার-সম্পর্কিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন ও বিধানের পরিপন্থী। কাজেই অসঙ্গতিপূর্ণ ধারাগুলো বাতিল করে সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে আইনটি সংশোধন করা আবশ্যক।

একটি কথা মনে রাখা দরকার, কোনো জাতির মেধার প্রসারতাকে রুদ্ধ করে দেয়ার চেষ্টার মানে হলো ওই জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা। আবুল হোসেন সম্পাদিত ‘শিখা’ পত্রিকার নামপত্রে লেখা থাকা একটি উক্তি দিয়ে আজকের লেখাটির যবনিকা টানতে চাই। সেখানে যেমন লেখা থাকত- ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’


আরো সংবাদ



premium cement