১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জার্মান নির্বাচন-পরবর্তী প্রাথমিক পর্যালোচনা

-

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ সন্ধ্যা ৬টায় প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা কর্তৃক ঘোষিত প্রাথমিক নির্বাচনী ফলাফল নিম্নরূপ :
ভোটদানের হার ৭৬.৬ শতাংশ। বাতিল দ্বিতীয় ভোটের হার ০.৯ শতাংশ। প্রথম ভোটের হার ১.১ শতাংশ। জার্মান সংসদ আইন অনুযায়ী এসএসডবিøউর জন্য ৫ শতাংশ হার অত্যাবশ্যক নয়। এ আইনের সাহায্যে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ডেনিশ ভাষাগোষ্ঠীর সংখ্যালঘুদের মধ্যে যে দল ২০১৭ এর নির্বাচন অনুযায়ী কমপক্ষে ৬৩ হাজার ৫০০ ভোট পাবে সে দল বুন্দেসটাগে অন্তর্ভুক্তির অধিকার রাখে।
নির্বাচনী আইনের ধারা-১ উপধারা-১এর ক্ষমতাবলে সংসদ সদস্য সংখ্যা ৫৯৮ থেকে ৭৩৫ সদস্যে উন্নীত করে অতিরিক্ত ১৩৭ সদস্যের বৈধতা দেয়া হলো। প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তার ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১৫ অক্টোবর বুন্দেসটাগের প্রথম অধিবেশনেই নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

উল্লেখ্য, জার্মান ভোটদান পদ্ধতি ব্যক্তিগতকৃত অনুপাতভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি। এতে অতিরিক্ত ম্যান্ডেট ও ক্ষতিপূরণ ম্যান্ডেটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভোটারের প্রথম ও দ্বিতীয় ভোট সংযুক্ত। যদি কোনো দল প্রথম ভোটের মাধ্যমে বুন্দেসটাগে বেশি প্রার্থী পায়, যা দ্বিতীয় ভোট অনুসারে পাওয়ার অধিকার রাখে না, তা হলে দ্বিতীয় ভোটের ফলাফলের সাথে সব কিছু আনুপাতিক না হওয়া পর্যন্ত পার্লামেন্টের আসনগুলো অন্য সব দলের জন্য সম্প্রসারিত করা হবে। ফলে ২০তম বুন্দেসটাগের সদস্য সংখ্যা ৭৩৫, যা ১৯তম সংসদের চেয়ে ২৬ জন বেশি।

এবারের বুন্দেসটাগ ৭৩৫ জন সদস্য দ্বারা পরিচালিত হবে, যা গত সংসদে ৭০৯ জন ছিল এবং আইনত ৫৯৮ হওয়ার কথা। এই ‘জাম্বো’ পার্লামেন্টে ব্যাভারিয়া রাজ্যের সিএসউর অবদান সবচেয়ে বেশি। যদিও ২০১৭ সালের নির্বাচনের চেয়ে এবার সিএসউ ৭ শতাংশ ভোটারের সমর্থন কম পেয়েছে, তবুও এ রাজ্যের প্রথম ভোটের ৩৬.৭ শতাংশ ভোট অর্জন এবং রাজ্যের ৪৬ সরাসরি নির্বাচিতদের মধ্যে ৪৫টিই তাদের দখলে। আবার বৈধ দ্বিতীয় ভোটের ৩১.৭ শতাংশ পাওয়ায় তাদের আসনসংখ্যা হওয়ার কথা ৩৪। ৪৫টি আসন ডিরেক্ট ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত বলে তাদের অতিরিক্ত ১১ আসনের সমতা অন্যান্য দলকে দিতে গিয়েই পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যার এরূপ জোয়ার; কারণ সিএসউ একটি আঞ্চলিক ও ছোট দল যা সরকারি দল সিডিউর ‘সিস্টার’ পার্টি বা জুনিয়র পার্টনার হিসেবে পরিচিত। সর্বোপরি এই দল সারা দেশের বৈধ দ্বিতীয় ভোট মাত্র ৫.২ শতাংশ পেয়েছে। এই দলের ব্যাভারিয়া রাজ্যের বাইরে কোনো শাখা নেই। ফলে সিএসউর এক অতিরিক্ত সদস্যের জন্য অন্যান্য দলকে ১৭ জন করে ক্ষতিপূরণ ম্যান্ডেট দিতে গিয়েই সংসদের এ অবস্থা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিষয়টি সাংবিধানিক আদালত পর্যন্ত গড়াবে।

নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী তিনটি দল নির্বাচনে (এসপিডি, গ্রিন ও এফডিপি) তাদের ভোটের হার ও সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পেরেছে। অপরপক্ষে প্রধান দল সিডিউ/সিএসউ প্রায় ৮ শতাংশ ভোটার হারিয়েছে।

এবারই প্রথম বুন্দেসটাগে গ্রিন পার্টির ২৩ বছর বয়সী দু’জন তরুণ সদস্যের অভিষেক হচ্ছে। বলাবাহুল্য, গ্রিন পার্টির ভোটারদের মধ্যে বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। অন্য দিকে বুন্দেসটাগের ৮০ বছর বয়সী একমাত্র সদস্য এএফডির। সিডিউ ভোটারদের বেশির ভাগই বয়স্ক এবং নিয়মিত গির্জায় যাতায়াতকারী। জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, জার্মান ভোটারদের সাকুল্যে ৫ শতাংশ বাসিন্দা গির্জার সদস্য এবং এব সদস্যের প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটই সিডিউ/সিএসউ পেয়ে থাকে।

৭৯ বছর বয়স্ক মি. শয়বলে বুন্দেসটাগের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। ২০তম সংসদে অভিষেকের পরে তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের কোনো সুযোগ নেই; কারণ জার্মান সংসদ আইন অনুযায়ী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মধ্য থেকেই পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কথা। মি. শয়বলের দল সিডিউ যেহেতু সংসদে বড় দল হিসেবে ভোটারদের রায় পায়নি, তাই তারও প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে ৪৮ বছরের অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে অবশ্যই তিনি সবার কাছে সম্মানের পাত্র। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সাবেক চ্যান্সেলর ড. হেলমুট কোহল ও সদ্য বিদায়ী চ্যান্সেলর ড. অ্যাঞ্জেলা মারকেলের বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন। তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জাতীয় দায়িত্ব পালনে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

ক্ষতিকর আগাম বা চিঠির ভোটের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা এবার জোরালো প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের ভাষ্য, লক্ষ লোকের অংশগ্রহণে একই দিনে ভোট দেয়া বা জনরায়ের সিদ্ধান্ত নেয়া বা সব ভোটারের প্রায় অর্ধেক ভোটার খামে ভরে সপ্তাহ বা মাসজুড়ে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো কি একই বার্তা বহন করে? কেউ কেউ বলছেন, একে নির্বাচনের দিন না বলে সপ্তাহ বা মাস বলা উচিত। তা ছাড়া আগাম বা খামে করে পাঠানো ভোট ভোটের অন্যতম পূর্বশর্ত, গোপনীয়তা রক্ষা করে কি? ভোটার তার সার্বভৌম ভোটাধিকার কোনো ধরনের প্রভাব ছাড়াই কি প্রয়োগ করেছেন? শুধু ভোটদানের হার বাড়ানোর জন্যই কি এ ব্যবস্থা? এ ছাড়াও জরিপে প্রমাণিত, আগাম/চিঠির মাধ্যমে ভোট প্রদান কিছু দলকে সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে যেতে সাহায্য করে। সিডিউ, এফডিপি, গ্রিন; চিঠির ভোটে এরা সুবিধাপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। আলোচ্য নির্বাচনে সিডিউ/সিএসউকে কোন জরিপই কখনো ২০-২২ শতাংশ বেশি ভোটপ্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনাই দেখায়নি। অথচ তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ২৪.১ শতাংশ। এফডিপি এর একই অবস্থা। এ ছাড়া নির্বাচনী ব্যয়ও ৭৩ মিলিয়ন ইউরো থেকে বেড়ে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ইউরো হয়ে গেছে যদিও তা ইংল্যান্ড, স্পেন বা ফ্রান্সের চেয়ে কম।

সিডিউ/সিএসউ নির্বাচনে পরাজয়ে অনেকগুলো কারণের মধ্যে তাদের প্রার্থী প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় রাজ্য সরকারের নিদারুণ ব্যর্থতা, প্রার্থীকে নিয়ে দলে অনৈক্য, করোনা মোকাবেলায় অদক্ষতা ও দলীয় দু’জন সংসদ সদস্যের দুর্নীতিকেই দায়ী করা হচ্ছে; যদিও আলোচিত সদস্যদের সাথে সাথেই সংসদ ও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

গ্রিন ও এফডিপি এখন কিং মেকার। দেখা যাক ৩৬৮ আসন সংগ্রহের কোয়ালিশন সরকার গঠনের আলোচনা চলছে। এসপিডি, সিডিউ দু’পক্ষই সরকার গঠনে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত মি. লাশেটের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে সবাইকে অবশ্যই নিজেদের অস্তিত্বের কথা চিন্তা করতে হবে। তবে রাজনীতিতে সবই সম্ভব।

লেখক : জার্মান গ্রাজুয়েট এবং জাবির
ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রের খণ্ডকালীন
জার্মান ভাষা শিক্ষক


আরো সংবাদ



premium cement