২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

প্রকৃত চেতনা লুণ্ঠিত করার ফসল

- প্রতীকী ছবি

পাকিস্তানি শাসক ও শোষকদের অত্যাচার, নিপীড়ন, নিষ্পেষণ থেকে রক্ষা পাওয়া এবং ন্যায়বিচার ও সব সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ বেছে নিয়েছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, অতি নগণ্য কিছু লালসা তাড়িত, লোভাতুর ও বিবেকবর্জিত মনুষ্য ছাড়া জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষই অসাম্প্রদায়িক ও শান্তিপ্রিয়। কিন্তু গভীরভাবে ব্যথিত হই যখন দেখি বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই রাজনীতির ছত্রছায়ায় মুষ্টিমেয় অসৎ, নষ্ট ও দুশ্চরিত্র এবং তথাকথিত জননেতাদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্যচরিতার্থ করার লক্ষ্যেই ক্ষণে ক্ষণে জনগণের শান্তি বিঘ্নিত করা হয়ে থাকে। স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে হামলার ঘটনায় আমরা হয়েছি যন্ত্রণাকাতর। একই সাথে পীড়িত হই সরকারেরই পৃষ্ঠপোষকতায় আসামে ও ভারতজুড়ে নিরীহ মুসলমানদের ওপর পরিকল্পিত নৃশংস ও ধারাবাহিক হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত হতে দেখে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, যেখানে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও আপামর জনসাধারণ সব সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ কঠোর হস্তে দমন ও দায়ী অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করার লক্ষ্যে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সোচ্চার, তখন পাশের দেশে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর প্রকাশ্য আস্ফালন ও চিহ্নিত অপরাধীদের সরকারি দলের নেতা কর্তৃক ক্রমাগত ইন্ধন জোগানো অবলোকন করে আমরা হই স্তম্ভিত।
তাই আমাদের দাবি, সব ধর্মাবলম্বীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্র্রীতি লক্ষ্য সমুচ্চ রাখার উদ্দেশ্যে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকেই আমাদের বজ্রকণ্ঠ হতে হবে উচ্চারিত। শ্রেণী-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে সমান অধিকার। এ অধিকার নিশ্চিন্ত করার সর্বাধিক দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়। তবে যেহেতু সব মানুষই রক্ত মাংসে গড়া, তাই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই, বিশেষ করে বর্তমান উন্নত ও বিস্ময়কর গণমাধ্যমের যুগে সংঘর্ষের ঘটনা যখন মুহূর্তের মধ্যেই অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায়, তখন সাধারণ জনগণের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া রোধ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই অলিখিত রীতি কেবল আমাদের উপমহাদেশেই নয়, সব দেশেই দৃশ্যমান।

তাই সব প্রকার প্ররোচনা এবং উসকানিমূলক কাজ ও বক্তব্য থেকে বিরত থাকা প্রতিটি দেশের সরকার ও সচেতন নাগরিকদের অপরিহার্য কর্তব্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মাইনরিটি বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শব্দটি সম্পূর্ণভাবে রহিত করা উচিত। সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ঠ শব্দ দু’টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে সব অশুভ ইঙ্গিত। নাগরিক হিসেবে সাংবিধানিকভাবে যেখানে সবারই সমঅধিকার নিশ্চিত, সেখানে সংখ্যার মারপ্যাঁচে দেশের জনগণকে বিভক্ত করা দিয়েই সূচনা হয় হিংসা ও বিদ্বেষের। ধর্মভিত্তিক রেষারেষির এখানেই সূত্রপাত।

বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের লোকেরা যুগ যুগ ধরে সুখে শান্তিতে বসবাস করে আসছে। আমি স্বয়ং ছোটকাল থেকেই আজ অবধি অনেক হিন্দু বন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছি। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে অনেক হিন্দু যোদ্ধার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া অশান্তিকর ঘটনাগুলো রাজনৈতিক ও কিছু ব্যক্তিবিশেষের অশুভ স্বার্থ হাসিলের বহিঃপ্রকাশ। এটি কোনোক্রমেই ধর্মীয় নয়। এ ঘৃণিত ও নৃশংস কাজের ইন্ধনদাতা রয়েছে দেশের অভ্যন্তরে ও সীমান্তের বাইরে; দুই স্থানেই। এ বিষয় সহজ বোধগম্য যে, মূর্তির সাথে কুরআন রাখা কোনো প্রকৃত হিন্দু কিংবা মুসলিমের পক্ষেই সম্ভব নয়। একজন প্রকৃত হিন্দু এ কাজ করে তার পূজা কেন নষ্ট করবে? তেমনিভাবে একজন প্রকৃত মুসলমান তো পৃথিবী উল্টে গেলেও মূর্তির নিচে পবিত্র কুরআন রাখাবে না। এরই মাঝে প্রত্যক্ষদর্শী ও অবস্থাগত প্রমাণের (পরৎপঁসংঃধহঃরধষ বারফবহপবং) ভিত্তিতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, কুমিল্লা ও দেশের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত সংঘর্ষগুলো দাড়িটুপিওয়ালা মুসলমান বা নামাবলি গায়ে জড়ানো কোনো প্রকৃত ধর্মভীরু মানুষের কাজ নয়। সংঘর্ষে লিপ্ত সবাই ছিল বয়সে তরুণ।
এ ছাড়া অতীতে সংঘটিত ভারতে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশেও হিন্দু ও মুসলিম একে অন্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার ঘটনার জন্য আমরা ধর্মকে দোষী করার কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। ভারতে মুসলিম ছেলেকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে জীবিত অবস্থায় যৌনাঙ্গ কেটে দেয়া কোনো ধর্মের কাজ ছিল না। কাশ্মিরে এক নারীকে মন্দিরে রেখে পুরোহিতসহ টানা তিন দিন গণধর্ষণ করার পর হত্যা করে জঙ্গলে ফেলে দেয়া কোনো ধর্মের কাজ ছিল না। মাদ্রাজে হাজার হাজার মুসলমান হত্যা ও নারীদের ধর্ষণ করার জন্য হিন্দু ধর্মকে দোষী করা যায় না। বুয়েটের আবরার হত্যার আসামি ‘অমিত সাহা’ প্রকাশিত হওয়ার পরও ধর্মকে দায়ী করা যায় না। শাপলা চত্বরে পবিত্র কুরআন শরিফ পুড়িয়ে ফেলার দায়ে শনাক্ত কেউ একজন হিন্দুধর্মের হলেও হিন্দুধর্মের প্রতি এ জন্য অঙ্গুলি নির্দেশনা অনুচিত হবে।
ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশে মন্দির আক্রমণের ঘটনা ইসলাম বা প্রকৃত ধর্মভীরু মুসলমানের কাজ নয়। কোনো ধর্মই হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও উপাসনালয় পোড়ানোর মতো নিকৃষ্ট কাজকে সমর্থন করে না। তাই সন্দেহাতীতভাবে এই হানাহানি লোভাতুর ও দেশবিরোধী চক্রেরই সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের প্রতিফলন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভ‚-অর্থনৈতিক, ভ‚-রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ এবং এ দেশের ১৭ কোটি মানুষ ক্রমেই তাদের অবস্থান যতই সুদৃঢ় করে তুলছে, শকুন ও হায়নাদের অসহিষ্ণুতা ও আক্রোশ ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দাঙ্গা সৃষ্টি করে মানুষের লাশ ভক্ষণ করতে তারা সদা সচেষ্ট। তারা সুযোগের সন্ধানে রয়েছে তাদের নখর ও দন্ত বিকশিত করে আঘাত হানার।

দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকল্পে এবং জনগণের কষ্টে অর্জিত ৫০ বছরের অগ্রগতি অটুট রাখার জন্য সব শ্রেণী ও সব পেশাজীবী মানুষের একতাবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আজ মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সব দেশপ্রেমিক নাগরিকদের শুধু তাদের অধিকার আদায়ের জন্য নয়, দেশের নাগরিক হিসেবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনেও হতে হবে সচেষ্ট। তাই সরকার ও সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানাই, প্রশাসনের সব স্তরে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করুন, নাগরিক অধীকারসহ দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করুন। মন্দিরে সংঘটিত বেদনাদায়ক ঘটনার নিরপেক্ষ ও বিচার বিভাগীয় তদন্তসাপেক্ষ পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকাসহ সব অপরাধীর দ্রুত ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিন।

আমরা একই সাথে দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা পঞ্চম বাহিনী এবং দেশের বাইরে নখর বিস্তার করা সব শকুন ও হায়েনাদের হুঁশিয়ার করে দিতে চাই, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার যেকোনো দুঃসাহস আমরা সমূলে ধ্বংস করে দিতে বদ্ধপরিকর। ৫০ বছর আগে এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যদি ভয়ানক মারণাস্ত্রে সজ্জিত লাখ লাখ দখলদার বাহিনীর কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারে, তবে বর্তমান বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ এ মাটি রক্ষার্থে যেকোনো শত্রুর অভিলাষ চিরতরে গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম।


আরো সংবাদ



premium cement