২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হারিয়ে গেছে বাঙালি সংস্কৃতির বিয়ে পার্বণ

- ফাইল ছবি

কোভিড-১৯-এর প্রকোপ কমতে না কমতেই বাড়ছে বিয়েশাদির ধুম। কেনাকাটা শেষ করে বিয়ের গেট-প্যান্ডেল থেকে শুরু করে খানাপিনা পর্যন্ত সব দায় ডেকোরেটর-বাবুর্চির ওপর চাপিয়ে আয়োজকপক্ষের সুদর্শন সন্তানরা পানের ডালা সাজিয়ে খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়েন টাকা কালেকশনে। ‘গিভ অ্যান্ড টেক’-এর এ সংস্কৃতি শহর থেকে প্রবেশ করেছে গাঁও-গেরামেও। সামান্য ব্যতিক্রমসাপেক্ষে সর্বত্র একই প্রকারের রান্না। নিজে তিন তিনবার রিং পরানো হার্টের রোগী। চিকিৎসকের কড়া হুকুম, ‘পরিহার করতে হবে চর্বি, স্নেহ, মিষ্টি, ননী, ঘি, বাটার, মালাই, ক্রিম, তেল, পেস্তাবাদাম, লাল গোশত, তৃণভোজী প্রাণীর গোশত, গিলা, কলিজা, মগজ, ডিমের হলুদ অংশ। গ্রহণ করতে হবে আটা, মুড়ি, চিঁড়া, রুটি, বিস্কুট, ডাল, শাকসবজি, ফল, মাছ, ননীবিহীন দুধ ও কুসুমবিহীন ডিম।’ আজকাল চিকিৎসকের পরিহারকৃত খাদ্য ছাড়া অনুষ্ঠানই অচল। এসব জীবনসংহারী খাদ্য ও ’গিভ অ্যান্ড টেক’ সংস্কৃতি চিরায়ত অতিথিপরায়ণ বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়। বিভিন্ন কারণে অনেকেরই উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের সমস্যা। হার্টের সমস্যাসহ ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এসব খাদ্য ঝুঁকিপূর্ণ। অনুষ্ঠানে খাদ্য ভক্ষণের চেয়ে অপচয়ও কম হয় না। গরমের দেশে এসব খাদ্য খাওয়ার সাথে সাথে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুসহ হাসপাতালে ভর্তির খবরও পাওয়া যায়। খানাপিনার মতো বিয়ের পার্বণেও বদলে গেছে সংস্কৃতি। কালের কবলে হারিয়ে যাওয়া বিয়ের খানাপিনা ও রীতিনীতিই বাঙালির আদি-আসল চিরায়ত সংস্কৃতি।

বর ঘোড়া কিংবা পালকিতে চড়ে চলছে আগে। আতশবাজি-পটকা ফুটাতে ফুটাতে বরকে অনুসরণ করছে যুবকদল। সবার পেছনে জয়ঢাক বাজিয়ে চলছে ব্যান্ডপার্টি। যাত্রাপথে ঘাটে ঘাটে বাধা। বিড়ি-সিগারেট ও পান-বাতাসা বিলিয়ে সব বাধা অতিক্রম করার পর শেষ বাধা শাহদরজায়। কনের বাড়িতে প্রবেশের জন্য প্রথমেই শাহদরজা। এর জন্য খুঁজে আনা হয় লম্বা কলাগাছ। দুই দিকে খাড়া থাকে দুই জোড়া কলাগাছ। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বেড়া বানিয়ে চার কলাগাছের সাথে অর্ধচন্দ্রাকারে আটকানো হয়। আটকানো ‘ফেন্সি’র বাঁকে বাঁকে লাগানো হয় কারুকাজ করে কাটা রঙিন কাগজ। কপাল বরাবর সাঁটানো সাদা কাগজে মোটা অক্ষরে প্রবেশ মূল্য লিখে রাখা হয়। বিয়ে বাড়ির বরকে বাদশার সাথে তুলনা করে প্রবেশদ্বারের নাম ‘শাহদরজা’। শাহদরজার প্রবেশপথে আড়াআড়ি বাঁশ বেঁধে আটকে রাখা হয় বরযাত্রীকে। বাঁশের এক পাশে বরপক্ষ; আরেক পাশে অবস্থান করে কনেপক্ষ। কনেপক্ষে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। গেটমাশুলসহ কনের সঙ্গী-সাথীদের বাতাসার পরিমাণ নিয়ে শুরু হয় দরকষাকষি। এর বাগ্যুদ্ধে সাধারণত বরপক্ষের যুবক ও কনেপক্ষের যুবতীরা অংশ নিয়ে থাকেন। বাগ্যুদ্ধের শুরুটা নিম্নরূপ-
কনেপক্ষ : কনের কাছে পৌঁছাতে হলে আগে পরিশোধ করতে হবে গেটমাশুল।
বরপক্ষ : আমরা মেহমান, বাড়ি গিয়ে দাওয়াত দিয়েছেন। দাওয়াতি মেহমান আটকে দেয়া কোন দেশী আচার?
কনেপক্ষ : বরের মতলব খারাপ। বর শুধু দাওয়াত খেতে আসেনি, নিতেও এসেছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি, বর কনে ছাড়া ফিরবে না। বিনা মাশুলে আমরা আমাদের সাথীকে হারাতে রাজি নই।

এভাবে অম্লমধুর তর্কবিতর্ক, বাগ্যুদ্ধসহ দরকষাকষি চলত মিনিটের পর মিনিট। বাগ্যুদ্ধ দীর্ঘায়িতসহ মাশুল আদায়ে বিলম্ব হলে শুরু হয় ঢিল মারা। ঢিলে মাটির ঢেলা ছাড়াও নিক্ষেপ করা হয় গোবর আবর্জনা ইত্যাদি। এ সময় বর রুমাল মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। পরিশেষে গেটমাশুলসহ বাতাসা-মিষ্টি ও পান-বিড়ি দিয়ে প্রবেশের অনুমতি পায়। নিরেট আনন্দ ছাড়াও দরকষাকষির একটা ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে। দু’পক্ষের মুখোমুখি মুখ-দর্শন, বাকচাতুর্যের মাঝেই অনেক সময় নির্ধারিত হয়ে যায় ভবিষ্যৎ বর-কনে।

বিয়ের সময় এসব প্রচলিত রীতিনীতি আইন কিংবা ধর্মে থাকুক কিংবা না থাকুক, না মেনে উপায় ছিল না। প্রতিটি দেশেই ধর্ম ও আইনের বাইরে রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি বা কালচার। সংস্কৃতির সাথে সভ্যতার একটি বিনা সুতার বন্ধন রয়েছে। ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভারের মতে, ‘আমরা যা করি তাই আমাদের সংস্কৃতি, আর আমাদের যা আছে তাই আমাদের সভ্যতা। মূলত সংস্কৃতি হলো মানুষের স্বাভাবিক জীবনপ্রণালী আর সভ্যতা হলো সে জীবনপ্রণালীর বাহ্যিক রূপ।’ সহজ অর্থে- বৈবাহিক প্রথা সভ্যতা আর বৈবাহিক প্রথা কার্যকর প্রণালী করা হচ্ছে সংস্কৃতি। এ কারণেই যে জাতির মধ্যে বৈবাহিক প্রথা না আছে সে জাতিকে বলা হয় অসভ্য জাতি। ভিন্ন ভিন্ন জাতির বৈবাহিক প্রণালীও ভিন্ন ভিন্ন। জাতির বিকাশ ধর্ম আর সভ্যতা দিয়ে নয়, সংস্কৃতি দিয়ে। সভ্যতাকে বিকশিত করে সংস্কৃতি। কোনো দেশের জাতীয় সংস্কৃতির ধারা দু’টি- নগর সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতি হলো, গ্রামের সহজ-সরল, অনাড়ম্বর লোকসম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সামাজিক বিশ্বাস, আচার-আচরণ, জীবনধারণ প্রণালী, চিত্তবিনোদনের উপায় ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা জীবনব্যবস্থা। দীর্ঘ দিন ধরে গড়ে ওঠা জীবনব্যবস্থা নিজস্ব সংস্কৃতি সভ্যতার পরিচয় বহন করে। বাঙালি বৈবাহিক প্রথার সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে বহু আগেই। জোড়ায় জোড়ায় গরু, ডজন ডজন খাসি ও শত শত মুরগি জবাই করে পোলাও, কাচ্চি বিরানি করা বাঙালি সংস্কৃতি নয়।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ১৯৬৩ সালের একটি বিয়ে পার্বণের কথা। বরের বাড়ি কুমিল্লা জেলার বর্তমান মেঘনা উপজেলার কান্দারগাঁও আর কনের বাড়ি একই উপজেলার মির্জানগর গ্রামে।

বরের ভাতিজা মোসলে উদ্দীন (বর্তমানে ক্যাপ্টেন পিএসসি, বিএন অবসরপ্রাপ্ত) আমার সমবয়সী, দু’জনই তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। ভাব জমতে সময় লাগেনি। বরযাত্রীসহ শাহদরজা পার হয়ে কনের বাড়িতে প্রবেশ করতে না করতেই কানে প্রবেশ করে গান। বরকে খোঁটা দিয়ে সম্মিলিত নারীকণ্ঠের গান-
‘পাশিবালি আনছে মাগনা বিবির কানে শোভে না
অপমাইন্না দুলারে, বিবির সম্মান চিনলি না।
শাড়ি আনছে মাগনা বিবির গায়ে শোভে না;
অপমাইন্না দুলারে, বিবির সম্মান চিনলি না।’
এভাবে কনের অলঙ্কার ও পরিচ্ছদের নাম উল্লেখ করে করে সম্মিলিত নারীকণ্ঠের গান কানে প্রবেশ করে। বহু দূর থেকে এরকম গান কানে প্রবেশ করলেই বুঝতে পারা যায়, বিয়ে বাড়ির গান। একদল থামতেই আরেক দল-
‘কেমন-অই না কুমাইরা রে ছনক্ষেত যেন নিড়াসরে
রৌদ্র যেন লাগে তোর গায়রে রে কুমার,
রৌদ্র যেন লাগে তোর গায়ে।
কেমন-অই না কইন্নায় লো কলসি যেন ভরিস লো
আগাইয়া ধরো আফের ছাত্তি লো কইন্না
আগাইয়া ধরো আফের ছাত্তি।’
বরযাত্রী নিজ নিজ আসন গ্রহণের পর দূর থেকে করুণ সুরে- ‘বাগে বাগে ডাকে কুকিল রে... কার বা বাগে ডাকে,
রাধিকার ওই বাগে কুকিল রে...বইসা রোদন করে।’
মেয়েলি গানের রয়েছে শ্রেণিবিভাগ। কমবয়সী, প্রবীণ ও বৃদ্ধা, বয়সভেদে রয়েছে পৃথক পৃথক গান। বিয়ের গান বলতে মূলত বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে কনেপক্ষ বরপক্ষকে আবার বরপক্ষ কনেপক্ষকে উদ্দেশ করে রচিত গান। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে দ্বিরাগমন পর্যন্ত এক পক্ষ আরেক পক্ষকে নিয়ে মজাদার চটুল গান বাঁধে। গান করে অন্তঃপুরের মহিলারাও। সেই প্রাচীনকাল থেকেই গানের প্রচলন ছিল। গানগুলো আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এবং প্রজন্মপরম্পরায় মুখে মুখে প্রচারিত। বয়স্করা অর্থাৎ মা-চাচীরা যখন গান করেন, তখন তাদের ঘিরে থাকে শিশুরা। শিশুরা মা-চাচীদের কাছে শোনা গান মনের ভেতর গেঁথে রাখে। বড় হয়ে গাইতে শুরু করে তারাও। নারী গানে পরস্পরের প্রতি কটাক্ষসহ নারী মনের আবেগ-উৎকণ্ঠা, আনন্দ-বেদনা, কামনা-বাসনা, হাসি-ঠাট্টা সব রয়েছে। খোঁটা ও খোঁচাবিষয়ক গানগুলো কম বয়সী এবং গুরুগম্ভীর ভাবমূলক গান প্রবীণ মহিলারা গেয়ে থাকেন।

গান চলতে থাকার মধ্যেই খানাপিনায় বসে যায় বরযাত্রী। বড় ঘর কিংবা উঠানে শামিয়ানার তলায় বিছানার ওপর দস্তরখানা। দস্তরখানার উপরে বসে পানাহার শুরু। খাদ্য পরিবেশন পদ্ধতিও ভিন্ন। বারো রকমের খানা, একটার পর একটা চলতেই থাকে। প্রথমে প্লেট বিতরণ। এর পরপর ধারাবাহিকভাবে শুরু হয়, চিলমচি ও বদনা হাতে নিয়ে মেহমানদের হাত ধোয়ানো। হাত ধোয়ানো শেষ হতে না হতে খানা চলে আসে। খানা শুরু হয় পাতলা সাবু কিংবা টকদই দিয়ে। প্রথমেই অ্যালুমিনিয়াম পাতিল কিংবা পিতলের গামলায় করে সাবু কিংবা টকদই। সাথে সাথে খই-মুড়ি, নানা রকমের কারুকাজ করা কারিগরি পিঠা ও মিষ্টি। গামলা ভরা মিষ্টি যার যত ইচ্ছা খাও। আমৃত্তি, চমচম এত বেশি পরিমাণ দেয়া হয় যে, কেউ কেউ পাঁচ-সাতটি করে সঞ্চয়ও করতে পারেন। টকদই থেকে মিষ্টি বিতরণ পর্যন্ত প্রথম পর্ব শেষ।

দ্বিতীয় পর্ব শুরু পোলাও-মুরগি দিয়ে। প্লেট পরিষ্কার করে এবার মুষ্টি পোলাও (পরিমিত পরিমাণ)। একজন এক চামচ করে পোলাও, অন্যজন দিয়ে যায় এক টুকরো করে মুরগির গোশত ও ঝোল। পোলাও-মুরগি শেষ হতে না হতেই শুরু হয় সাদা ভাত। আমন ধানের চালের সাদা ভাতের সাথে বড় মাছের তরকারি। মাছ যে যত খেতে পারে। মাছের পরে ডাল। মাষকলাইয়ের ডাল- ক্ষেত্রভেদে মুগ ডাল, পরিশেষে পায়েস কিংবা ক্ষীর (ঘন পায়েস)। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় খামারের মাছ দেখা দূরের কথা, নামও কেউ জানত না। বিয়েসহ বড় অনুষ্ঠানে মুরগির পরই মাছ। মিঠা পানির রুই, কাতলা ও মৃগেলের জন্য অনুষ্ঠানের আগেই জেলেদের কাছে অর্ডার দিয়ে রাখতে হয়। মেজবানি ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠানে গরু জবাইয়ের প্রচলন খুব একটা চোখে পড়ত না।

সাধারণ মেহমানদের খানাপিনা শেষে বরের জন্য স্পেশাল খানা। দোস্ত হিসেবে বরের পাশেই ছিল আমার স্থান। স্পেশাল খানাপিনার জন্য আমাকেও বসিয়ে রাখা হয়েছিল। বিয়ের আসরে বরের পাশে বসা অবস্থায় এই বয়সেই আমার গুরুত্ব টের পেতে শুরু করেছি। টের পেতে শুরু করছি যে, আড়াই দিনে বন্ধুবরের ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা বয়ে যাবে। বন্ধুবরকে ছায়ার মতো আগলে রাখার গুরুদায়িত্ব আমার; কারণ বরকে আড়াই দিন কনের বাড়িতে অবস্থান করতে হবে। এই আড়াই দিনে বরের আইকিউসহ নানা রকম পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। শ্বশুর-শাশুড়ি সম্পর্কিত সবার সাথে বরের পরিচয় ছাড়াও শালা-শালী সম্পর্কিতদের সাথে চলে অম্লমধুর যুদ্ধ। এই বিয়েতে অম্লমধুর রসিকতাপূর্ণ বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষার যুদ্ধে বরের দেহরক্ষী ছিলাম আমি। সময় শীতকাল। যে ঘরে আমাদের রাখা হয় সে ঘরে বাঁশের বেড়া। পুরনো বেড়ার মাঝে মাঝে ফাঁকা। পরদিন ঘুম ভাঙার আগেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে তরল রঙ এসে গায়ে লাগে; অর্থাৎ ঘুমন্ত অবস্থায় কনেপক্ষের আক্রমণ। বরপক্ষের সৈনিকদের মধ্যে একজন ছিল সোনারগাঁওয়ের জামাই। সোনারগাঁওয়ের জামাই যেমন চতুর তেমন বুদ্ধিমান। তার সোনারগাঁওয়ের জামাইয়ের নেতৃত্বে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলি। পাকা খেলোয়াড় হিসেবে ৫৭০ রঙসহ সরঞ্জাম জামাইয়ের ব্যাগে আগেই ছিল। রঙ বাটিতে গুলে প্লাস্টিকের সিরিঞ্জে ভর্তি করে শুরু হয় পাল্টা রঙযুদ্ধ। রঙযুদ্ধ মল্লযুদ্ধের দিকে গড়াতে শুরু করতেই মুরুব্বিরা চলে আসেন। আশপাশের মুরুব্বিদের হস্তক্ষেপ না হলে রঙখেলায় আমরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলাম।

সকাল থেকে যাদের সাথে যুদ্ধ, তারাই সহাস্যে আমাদের জন্য নাশতা নিয়ে হাজির। বারো রকমের পিঠা, শিরনি, পায়েস, সেমাই, মুড়ি প্রভৃতি। সোনারগাঁওয়ের জামাই আগে থেকেই সতর্ক করেছিলেন যে, ‘পিঠা কখনো আগে মুখে দেবেন না। প্রথমে হাতে নেবেন, টুকরো টুকরো করে ভাঙবেন, নিশ্চিত হওয়ার পর মুখে তুলবেন। শিরনি ও পায়েস যাই হোক, প্লেটে নেয়ার আগে চামচের মাথায় করে আগে টেস্ট করবেন, তার পর প্লেটে উঠাবেন। এসব খানায় অস্বাভাবিকভাবে থাকতে পারে মরিচ-লবণ। বরের বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষার জন্য আরো পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। খানাপিনার বিষয় ছাড়াও পাড়ার মুরুব্বিরা আসতেন। বরের পেশাবিষয়ক নানা প্রশ্ন করতেন। বর কৃষক পরিবারের বিধায়, কৃষিবিষয়ক খুঁটিনাটি প্রশ্ন থেকেও বাদ পড়েনি। সোনারগাঁওয়ের জামাইয়ের নেতৃত্বে আমরা ‘আড়াইউল্লার সব পরীক্ষা’ সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে আড়াই দিনের মাথায় বউ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম।

বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান। গ্রামের বিপুল জনগোষ্ঠী নিজস্ব জীবনপ্রণালীর মাধ্যমে হাজার বছর ধরে যে বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে তা-ই বাংলার লোকসংস্কৃতি নামে অভিহিত। নগরবাসীর স্বল্প পরিসরে ঘনবসতি জনগোষ্ঠীর আহার-বিহার, আনন্দ-উৎসব ও উৎপাদন পদ্ধতির সংমিশ্রণে নগর সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা জটিল, বৈচিত্র্যময় ও দ্রুত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল নগরসংস্কৃতির করালগ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের লোকসংস্কৃতি। সাথে হারিয়ে যাচ্ছে চিরায়ত খাদ্যাভ্যাসও। কাচ্চি বিরানি মধ্য এশিয়ার খাবার, যা তীব্র ঘ্রাণযুক্ত গরম মসলা, ঘি, কাঁচা গোশত ও সুগন্ধি চাল মিশিয়ে রান্না করা হয়। মুঘল আমল থেকে অদ্যাবধি ভারতে সমানভাবে আদৃত হতে দেখে বিখ্যাত রম্যসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘এ কি ভানুমতি! এ কি ইন্দ্রজাল’ আখ্যায় আখ্যায়িত করেছিলেন। ‘মাংস খেলে মাংস বাড়ে, ঘৃতে বাড়ে বল/দুগ্ধ খেলে চন্দ্র বাড়ে, শাকে বাড়ে মল’- মধ্যযুগের সুধীজনের শ্লোকটি ভুল প্রমাণিত হয়ে সম্প্রতি নেচার মেডিসিন সাময়িকীতে প্রকাশিত, ড. স্ট্যানলি হ্যাজেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় জানা যায়, লাল মাংস কার্নিটিন নামের কেমিক্যাল পাকস্থলীর ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে প্রচুর কোলেস্টেরল তৈরি করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। হৃদরোগ ছাড়াও শরীরে বেশির ভাগ রোগ সৃষ্টির মূল কারণ কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় খাবার; যার মধ্যে চিনি সবচেয়ে বেশি খারাপ। সে কারণে চিনির আরেক নাম ‘হোয়াইট পয়জন।’ সব জেনে-বুঝেও আমরা দিন দিন ভয়ঙ্করের দিকেই হাঁটছি।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement