২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
জাতিসঙ্ঘ দিবস ২০২১

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে

- ছবি : সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস, জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসান, যুদ্ধ বন্ধ করা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টিতে জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা বারবার আলোচিত হয়ে আসছে। এ ভূমিকার পাশাপাশি যোগ হয়েছে পরিবেশগত সমস্যা কিংবা নারী উন্নয়ন সম্পর্কিত সমস্যা। জাতিসঙ্ঘ দিবস ২৪ অক্টোবর বিশ্বের সব স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে উদযাপিত হয়। সাধারণ পরিষদর সিদ্ধান্ত অনুসারে জাতিসঙ্ঘ সনদ অনুমোদনের দিন এ দিবস পালনের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। এ দিবসের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছ জাতিসঙ্ঘের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে উৎসর্গ করা হয়েছে।

জাতিসঙ্ঘ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে এর সদর দফতর। শাখা অফিস রয়েছে জেনেভা, ভিয়েনা ও নাইজেরিয়াতে। জাতিসঙ্ঘের ধারণা দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জাতিসঙ্ঘের জন্ম হলেও মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব নেতারা এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও মৈত্রী বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হয়। এ প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখেই তৎকালীন বিশ্ব নেতারা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করার উদ্যোগ নেন।

১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আটলান্টিক সনদে স্বাক্ষর করেন। এ সনদে বিশ্বের সব জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, বাকস্বাধীনতা, স্থায়ী শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে আক্রমণকারীদের নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হয়েছিল। এসব আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই পরে জাতিসঙ্ঘ সনদ রচিত হয়। জাতিসঙ্ঘ নামটি এসেছে ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিল, সেই ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে। এ চারটি দেশ এক ঘোষণাপত্রে আটলান্টিক চার্টারে বর্ণিত নীতি ও আদর্শের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছিলেন, যা ‘জাতিসঙ্ঘ ঘোষণা’ নামে পরিচিত।

জাতিসঙ্ঘের মূল সনদে ৫১টি দেশ স্বাক্ষর করলেও বর্তমানে জাতিসঙ্ঘের সদস্য সংখ্যা তিনগুণের উপরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিশ্ব সংস্থার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে- বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। মূলত দু’টি বিশ্বযুদ্ধের কারণে সমগ্র মানব জাতির জীবনে যে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছিল, তার ভয়াবহতা অনুধাবন করেই বিশ্ব নেতারা জাতিসঙ্ঘের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। বিশ্ব নেতাদের কাছে যেসব বিষয় তখন প্রাধান্য পেয়েছিল, তা হলো- যেকোনো ধরনের যুদ্ধকে নিরুৎসাহিত করা, ছোট ছোট দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আগ্রাসী দেশগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, একটি নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করা, আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে দেশগুলোকে ধারণা দেয়া এবং ছোট দেশগুলোর প্রগতি ও উন্নয়ন সাধনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা ইত্যাদি।

বিশ্ব নেতারা এসব লক্ষ্যকে সামনে রেখেই জাতিসঙ্ঘের সনদ রচনা করেন। জাতিসঙ্ঘ সনদে বলা হয়েছে- এসব লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে প্রতিটি রাষ্ট্র সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করবে। প্রতিটি রাষ্ট্র সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ ও শান্তিতে বসবাস করবে; অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্র আগ্রাসী ভূমিকা নেবে না ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে পাশের দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে। সনদে বলা হয়েছে- আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য সব রাষ্ট্রের শক্তি ঐক্যবদ্ধ করতে হবে; অর্থাৎ আগ্রাসী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ছোট ছোট রাষ্ট্রের নিরাপত্তা একটি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব। এই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই বিশ্ব শান্তির অন্যতম প্রধান রক্ষাকবচ। জাতিসঙ্ঘ সনদে সশস্ত্রবাহিনী ব্যবহারকেও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া সশস্ত্রবাহিনীকে ব্যবহার না করার উপর এতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ যাতে একটি রাষ্ট্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে, জাতিসঙ্ঘের সনদে এ বিষয়টিরও উল্লেখ আছে। জাতিসঙ্ঘ প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার স্বীকার করে এবং সমতার ভিত্তিতে প্রতিটি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার নীতিতে বিশ্বাসী। জাতিসঙ্ঘ কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু যদি ওই রাষ্ট্র বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দেয়, তা হলে ওই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ সনদ অনুযায়ী, নিরাপত্তা পরিষদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা।

আপাত দৃষ্টিতে জাতিসঙ্ঘের সাফল্য বেশি বলে মনে হলেও জাতিসঙ্ঘ প্রতিটি ক্ষেত্রে যে সফল হয়েছে, তা বলা যাবে না। বেশ কিছু ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘের ব্যর্থতাও লক্ষ করার মতো। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা জাতিসঙ্ঘের অন্যতম উদ্দেশ্য; অথচ দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে যেসব যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে, বিশেষ করে ইরান-ইরাক যুদ্ধ, চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন, ভিয়েতনাম কর্তৃক কম্পুচিয়া আগ্রাসন কিংবা কিউবার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চাপ- এসব প্রতিরোধ করতে জাতিসঙ্ঘ ব্যর্থ হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দু’টি বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল, সেই স্নায়ুযুদ্ধ রোধ কিংবা উত্তেজনা হ্রাস করার ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

পারস্পরিক অস্ত্র উৎপাদন হ্রাস করা ও পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমিয়ে আনার ব্যাপারেও জাতিসঙ্ঘের ব্যর্থতা লক্ষ করার মতো। জাতিগত বৈষম্য বিলোপসংক্রান্ত জাতিসঙ্ঘ ঘোষণা গৃহীত হলেও বিগত বছরগুলোতে ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ব্যবধান আরো বেড়েছে। গরিব দেশগুলোর ঋণের পরিমাণ দিনে দিনে বাড়লেও নিজের দ্বন্দ্বের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে আফ্রিকায় রুয়ান্ডা-বুরুন্ডিতে কিংবা ইউরোপে বসনিয়া হার্জেগোভিনা ও কসোভোতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও লাখ লাখ মানুষের দেশান্তরিত হওয়ার রোধ করার ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘ আদৌ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এমনকি জাতিসঙ্ঘ এসব দেশে গণহত্যার সাথে যারা জড়িত, তাদের সবাইকে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে সোপর্দ করতে পারেনি। ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের নগ্ন আগ্রাসনের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘ অদ্যাবধি কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।

গণবিধ্বংসী অস্ত্র গোপন রাখার অভিযোগে ইরাকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বুশ সরকারের অন্যায় আক্রমণের প্রশ্নেও জাতিসঙ্ঘ কোনো কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের ব্যাপারে বড় অভিযোগ- এ সংস্থাটি মূলত বড় দেশ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে। জাতিসঙ্ঘের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রক্রিয়ায় উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এসব দেশের মোট জনসংখ্যা ২০০ কোটির বেশি। অথচ এই বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দেশগুলোর ক্ষমতা জাতিসঙ্ঘের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থায় একদম নেই। জাতিসঙ্ঘের মূল ক্ষমতা নিরাপত্তা পরিষদের হাতে।

প্রতিটি সংস্থারই সাফল্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ব্যর্থতা। জাতিসঙ্ঘের ক্ষেত্রেও এ কথাটি প্রযোজ্য। জাতিসঙ্ঘের সাফল্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে এর ব্যর্থতাও। তুলনামূলক বিচারে জাতিসঙ্ঘের সাফল্য বেশি। বিশেষ করে শান্তিরক্ষা, পরিবেশ কার্যক্রম কিংবা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে জাতিসঙ্ঘ উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষী পাঠিয়ে জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসানের উদ্যোগ নিয়েছে জতিসঙ্ঘ। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বৃহৎ শক্তিগুলোর একটি ভূমিকা ও কর্তৃত্ব করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আর তাই জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামোগত সংস্কার এখন সময়ের দাবি।

লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথ-ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল : arafatrahman373@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement