২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উসামা বিন লাদেনের গল্প শেষ হয়নি

- ফাইল ছবি

২০ বছর আগে, নাইন-ইলেভেনের সাত সপ্তাহ পরে, আমি ছিলাম উসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎগ্রহণকারী শেষ সাংবাদিক। মার্কিন বোমা হামলার মাঝেই আমরা আফগানিস্তানে দেখা করেছি। বিন লাদেন বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, আফগানিস্তানে আমেরিকাকে লাঞ্ছিত করতে তিনি একটি ফাঁদ পেতেছেন, যেমনটি সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। আমেরিকা ও তালেবানের মধ্যে আলোচনার পূর্বাভাসও দিয়েছিলেন তিনি। দুই দশক পরে বিন লাদেন এখন মৃত, কিন্তু ওই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। আমেরিকানরা ছোট কিছু সান্ত্বনা খুঁজে পেতে পারেন হয়তো, কেননা তারা বিন লাদেনকে শিকার করার পর হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু বড় চিত্রটা কম সান্ত্বনাদায়ক। আলকায়েদা এখনো আফগানিস্তানে থেকে গেছে। এর শাখগুলো বিশ্বের অন্যান্য অংশে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আইএসের উত্থান দেখিয়ে দিয়েছে যে, তাদের চিন্তাগুলো বিন লাদেনের অনুসারীদের খুঁজে বের করার চেয়ে আরো কঠিন। আমি নিশ্চিত নই যে, আমেরিকা ও অবশিষ্ট পশ্চিমারা এ পাঠ পুরোপুরি গ্রহণ করেছেন।

আমি যখন ১৯৯৭ সালে আফগানিস্তানের তোরাবোরা পর্বতের একটি গুহায় প্রথমবারের মতো বিন লাদেনের সাথে সাক্ষাৎ করি, তখন তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আমেরিকা শিগগিরই একটি ক্ষয়িষ্ণু পরাশক্তি হবে। তিনি আমেরিকা ও ভারতের বিরুদ্ধে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান ও চীনের একটি জোটের পরামর্শ দিয়ে আমাকে অবাক করে দিয়েছিলেন। আমেরিকা এখনো অবশ্যই একটি পরাশক্তি। কিন্তু তার ভবিষ্যদ্বাণীর দ্বিতীয় অংশটি, যা আমি লিখেছি, সত্য হতে যাচ্ছে। ইরান তালেবান সরকারের সাথে কথা বলেছে। একই সাথে চীনের প্রতি এ ইঙ্গিত দিয়েছে যে, স্বীকৃতি ও সমর্থনের বিনিময়ে মুসলিম উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনা অপরাধ ক্ষমা করে দিতে তারা প্রস্তুত আছে। চীন নতুন আফগান সরকারকে ৩১ মিলিয়ন ডলারের জরুরি সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে।

বিন লাদেন বুঝেছিলেন, আমেরিকার শক্তি তার শত্রুদের যৌথ লক্ষ্য বানাতে বাধ্য করবে। নাইন-ইলেভেনের পর আমি ইরাক থেকে সিরিয়া এবং লেবানন থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত যুদ্ধগুলো কভার করেছি। বিন লাদেন অনেক মুসলমানের সম্মান অর্জন করেছিলেন- তার ধর্মীয় মতাদর্শের কারণে নয়, বরং ইরাকে মার্কিন দখলদারিত্ব ও ইসলামী বিশ্বের পুতুল সরকারগুলোকে ওয়াশিংটনের সমর্থনের কারণে। আমি নাইন-ইলেভেনের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল, কন্ডোলিসা রাইস, হিলারি ক্লিনটন, জন এফ কেরি এবং অনেক শীর্ষ মার্কিন সামরিক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের সাফল্য সম্পর্কে ব্যাপক দাবি করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধটি যে আসলে আরো সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে, এ ব্যাপারে তাদের অজ্ঞাত মনে হয়েছিল। ইরাকে মার্কিন হামলা থেকে সৃষ্ট আঘাতের একমাত্র উদাহরণ আইএস। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমেরিকা নাইন-ইলেভেনের পর ড্রোন দিয়ে আলকায়েদা, তালেবান ও আইএসের অনেক শীর্ষ নেতাকে খুঁজে বের করে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এটাও সত্য যে, সেই হামলার ফলে অর্জিত ক্ষতি হচ্ছে, এ হামলাগুলো অসংখ্য নতুন আত্মঘাতী বোমাবিস্ফোরণকারী তৈরি করেছে। এ আত্মঘাতী হামলাকারীরা আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে তালেবানের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। এখন তালেবান নিজেই আইএসের আত্মঘাতী হামলাকারীদের মুখোমুখি হচ্ছে।

সামরিক শক্তি কিছু সমস্যার সমাধান করতে পারে, কিন্তু এটি বেশির ভাগ সময় আরো সমস্যার জন্ম দেয়। আমেরিকাকে সামরিক শক্তির ব্যাপক ব্যবহারে উসকে দিতে চেয়েছিলেন বিন লাদেন। কারণ, তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, এটি সমাধানের চেয়ে বেশি সমস্যা তৈরি করবে। তবে একটি দেশের জন্য শুধু যুদ্ধই তার স্বার্থ হাসিলের একমাত্র উপায় হতে পারে না। ওয়াশিংটনের উচিত নয়, অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করা। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহারের পর আমেরিকা ও তার মিত্ররা আফগানিস্তান ত্যাগ করেছিল। এটা আফগানিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। তালেবান সেই গৃহযুদ্ধের চূড়ান্ত ফল। ট্রাম্প প্রশাসনের আলোচিত দোহা চুক্তি বাস্তবায়নে তালেবানকে বাধ্য করে আমেরিকা বিন লাদেনকে ভুল প্রমাণ করতে পারে। আমেরিকাকে চাপ দিতে হবে যে, আফগানিস্তানকে অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে না- তালেবান নিজের দেয়া এ প্রতিশ্র“তি মেনে চলবে। বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা তালেবানের দখল নিয়ে বোধগম্য কারণেই অসন্তুষ্ট। তবে তাদের বুঝতে হবে যে, প্রকৃত ফায়দাটা এখনো তাদের কাছে রয়েছে। আমেরিকা আফগানিস্তানের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় তালেবানের অর্থের প্রয়োজন। তালেবানকে দেশের ক্ষমতা কাঠামোতে নারী ও অন্যান্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য করতে আমেরিকা যথাসাধ্য চেষ্টা চালাবে। তালেবান যদি আফগানিস্তানে শান্তি ও নিরাপত্তা আনতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ফল আরো খারাপ হতে পারে। ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলো উসামা বিন লাদেনের মতো মানুষের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘাঁটি। তিনি এক দুর্বল সুদান থেকে ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে চলে যান। ১৯৯৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে আমাকে তিনি বলেছিলেন, আমেরিকা তাকে হত্যা করতে পারবে, কিন্তু তাকে জীবিত ধরতে পারবে না। এ বিষয়েও তিনি সঠিক ছিলেন। অন্য কিছু সম্পর্কেও কি তিনি সঠিক?

ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement