২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মিশন সমাপ্ত

-

হজের সময় নিকটবর্তী হলে রাসূল সা: সারা আরবে প্রচার করে দেন যে, তিনি এবার হজ পালন করতে চান। নবী ইবরাহিম ও নবী ইসমাইল (তাঁদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) কাবাগৃহ নির্মাণের পর থেকে সেখানে হজ পালনের রীতি সব সময়েই ছিল। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী এটি ছিল প্রথম ইবাদতগৃহ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরবের লোকদের ধর্মীয় বিশ্বাসে এমন বিকৃতি ঘটে যে, তারা আল্লাহর পরিবর্তে অথবা আল্লাহর পাশাপাশি প্রতিমা ও মূর্তির উপাসনা করে। তবে কিছুটা বিকৃতভাবে হলেও তারা ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে হজ পালন অব্যাহত রাখে। হজ পালনের আনুষ্ঠানিকতায় এমন অনেক রীতিনীতি অন্তর্ভুক্ত হয়, যা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলা যায়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, কুরাইশরা মনে করত যে, সব আরববাসীর চেয়ে তারা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী এবং কাবার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তারা হজ পালনের কিছু অনুষ্ঠান পালন থেকে মুক্ত। তারা মক্কার বাইরের হজ পালনকারীদের তওয়াফ করার সময় মক্কায় তৈরি কাপড় পরিধান করার অথবা উলঙ্গ থাকার নিয়ম চাপিয়ে দেয়।

ইসলামের বিজয়ের আগে হজ পালনকালে আরবরা পৌত্তলিকতার অন্যান্য রীতিও পালন করত। হজ পালনকালে ওই সব রীতিনীতি বন্ধ করতে রাসূল সা: তাঁর সাহাবি আবু বকরকে পূর্বের বছরে হজের সময় সেখানে পাঠান। ইসলামী বিধান অনুযায়ী মুসলিমদের হজ পালনের জন্য এবার প্রয়োজনীয় কর্তব্য রাসূল সা: সুস্পষ্ট করে দেন। হজ পালন হলো মুসলিমদের জন্য একটি প্রধান ইবাদতের কাজ, যার মাধ্যমে হজ পালনকারী তার অতীত পাপের জন্য ক্ষমা লাভ করে।। এসব কারণে রাসূল সা: জানিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন যে, কেউ তাঁর সাথে হজ পালনের ইচ্ছা করলে তা করতে পারেন। আরবের সব এলাকা থেকে লোকজন মদিনায় আসতে শুরু করে ইসলামের মহান ওই ইবাদতে যোগ দেয়ার জন্য। তা ছাড়া হজ পালন এমন একটি ইবাদত, যা মুসলিমরা এখনো রাসূলকে করতে দেখেননি।
ইসলামী ইবাদতের প্রতিটি কাজই করা হয় সামাজিক, জাতীয় ও মানবিক উদ্দেশ্যে। এ ছাড়াও এর সাথে জড়িত থাকে আত্মিক ও ব্যক্তিগত গুরুত্ব। রাসূল সা: কিভাবে হজ পালন করেন, তা সরাসরি তাঁর কাছ থেকে জানা মুসলিমদের জন্য প্রয়োজন ছিল। তদুপরি হজ পালন হলো ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুতরাং রাসূল নিজে হজ পালন ও কিভাবে হজ পালন করতে হয়, তা মুসলিমদের শিক্ষা না দেয়া পর্যন্ত ইসলামের বাণী পৌঁছানো সম্পূর্ণ হতো না।

হজ পালনে রাসূলের সাথে যোগদানের কথা ঘোষণা করার পরপরই আরবের সব এলাকা থেকে লোকজন মদিনায় আসতে শুরু করেন। প্রতিদিনই মদিনা দূর-দূরান্তের লোকদেরকে সাদরে অভ্যর্থনা জানায়। রাসূলের সাহাবি জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাসূলের হজ পালনের অত্যন্ত বিস্তারিত ও প্রামাণিক বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, মদিনা থেকে হজযাত্রীদের কাফেলা যখন শুরু হয়, তখন তিনি এর সামনে বা পেছন থেকে অথবা ডান বা বাম দিক থেকে এর শেষ দেখতে পারেননি। মদিনা থেকে রাসূলের সাথে এ যাত্রায় যোগ দেয়া হজযাত্রীর সংখ্যা নব্বই হাজার থেকে এক লাখ ত্রিশ হাজার বলে আনুমানিক হিসাব করা হয়। মক্কায় তাঁর সাথে যোগ দেয়ার জন্য সেখানে একই সংখ্যক মুসলিম অপেক্ষা করছিল।
রাসূল সা: তাঁর মহিমান্বিত এ সফরের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর দশম হিজরি সালের জিলকদ মাসের ২৫ তারিখ শনিবার মধ্যাহ্নে মদিনা ত্যাগ করেন- এটি ছিল রাসূলের মদিনায় হিজরতের শুরুর তারিখ। তাঁর সাথে ছিলেন তাঁর সব স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যগণ, মুহাজির ও আনসারগণ এবং আরবের সব গোত্র থেকে আগত লোকজন। তাঁর সাথে এক শ’টি উট ছিল; কুরবানি করার উদ্দেশ্যে তিনি এসব উট নেন। জুল হুলায়ফা নামক স্থানে আসার পর তিনি আছর নামাজ আদায় করেন- সফরে থাকার জন্য তিনি আছর নামাজ সংক্ষিপ্ত করে দুই রাকাত আদায় করেন। জুল হুলায়ফা স্থানটি এখন আবেয়ার আলি নামে অধিক পরিচিত, যা মদিনা থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তিনি দুই খণ্ড সাদা কাপড় পরিধান করে পবিত্র অবস্থার আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন; এক খণ্ড কাপড় কোমর পরিবেষ্টন করে পরেন, যা তাঁর কোমর থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঢাকা অবস্থায় থাকে এবং অন্য খণ্ডটি কাঁধের ওপর রাখেন।

একই সাথে তিনি হজ ও ওমরাহ পালনের ইচ্ছা করেন অর্থাৎ তিনি ইহরামের কিরান পদ্ধতি বেছে নেন; কারণ তিনি তাঁর সাথে কুরবানির পশু এনেছিলেন। তিনি যখন উষ্ট্রীর পিঠে আরোহণ করে যাত্রা শুরু করেন, তখন তিনি এই তালবিয়া বারবার উচ্চারণ করেন : লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্না আল হামদা ওয়ালনিয়ামাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারিকা লাক। অর্থাৎ আমার প্রভু, আমি আপনার আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। আমি আপনার আহ্বানে সাড়া দিয়েছি : আপনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। সব প্রশংসা, অনুগ্রহ ও সার্বভৌমত্ব আপনার। আপনার কোনো অংশীদার নেই। এটি হজের ইবাদতের প্রতীক হয়ে ওঠে, যা আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত হওয়ার ও তাঁর প্রতি উৎসর্গীকৃত হওয়ার ভাব বাড়িয়ে দেয়। সব মুসলিমই ওই বাক্যটি বারবার পড়তে থাকে এবং আল্লাহর প্রতি তাদের অনুগ্রহ ও উৎসর্গের কথা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে।

বিশাল ওই কাফেলার সবার কাবাগৃহকে দেখার এবং ইসলামী পদ্ধতিতে পবিত্র ও সম্পূর্ণভাবে হজ পালনের আকাক্সক্ষা ছিল। উপত্যকায় ওঠা বা নামার সময়, বিশ্রাম গ্রহণ বা নামাজের জন্য শিবির স্থাপন এবং প্রতিটি সময়ে দৃশ্যের পরিবর্তন হলেও তারা ওই তালবিয়া বারবার পড়তে থাকেন। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর একত্বের ওপর তাদের দৃঢ় বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করতে থাকেন। বিশাল ওই কাফেলার শান্তিপূর্ণ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। ওই কাফেলা থেকে এর আশপাশের সবার মধ্যে নিরাপত্তা ও দৃঢ় আশ্বাসের অনুভ‚তি বিস্তৃত হয়। এর সেøাগান ছিল শান্তি ও নিরাপত্তার। ওই কাফেলার একজন লোকও অন্য কারো প্রতি কোনো ক্ষতিকর চিন্তা করেনি। কোনো ধরনের অস্ত্রও তাদের কেউ সাথে করে আনেনি। তাদের কেউ কোনো পশুর ক্ষতি করেনি, পাখিকে ভীতগ্রস্ত করেনি, কোনো গাছ কাটেনি বা কোনো উদ্ভিদ ধ্বংস করেনি। বলা যায়, এটি ছিল ভালোবাসার কাফেলা। এটি ছিল শান্তিপূর্ণ কাফেলার শান্তিপূর্ণ অগ্রযাত্রা- এর মধ্য দিয়ে এর আশপাশে বিস্তৃত হয় দয়া, শান্তি ও নিরাপত্তার অনুভ‚তি। প্রতিটি স্থানে পশু, পাখি ও গাছ ছিল শান্তিতে।
সব মানুষ ও সব সৃষ্টির সাথে ওই কাফেলা ছিল শান্তিতে। এর উদ্দেশ্য ছিল ভালোবাসা ও সংহতি। এর বৈশিষ্ট্যযোগ্য নিদর্শন ছিল সত্যিকার ভ্রাতৃত্ব ও পরিপূর্ণ সমতা। এ কাফেলায় কোনো পার্থিব বিবেচনা কোনো গ্রæপকে অন্য কোনো গ্রæপের লোকদের থেকে পার্থক্য করেনি। এটি ছিল একটি উৎসর্গীকৃত কাফেলা; এখানে কোনো দৈহিক কামনা, নিরর্থক বাদানুবাদ, সামাজিক স্বাতন্ত্র্য বা ঝগড়া ছিল না। এটি ছিল ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের প্রকাশ, যা আল্লাহর ক্রোধ ডেকে আনার ভয় ও তাঁর তুষ্টি অর্জনের চেষ্টার দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এ যাত্রায় সময় লাগে বেশ কয়েক দিন। ওই কাফেলা মক্কায় উপস্থিত হয় জিলহজ মাসের চতুর্থ দিনে সন্ধ্যার সময়।

রাসূল সা: ওই রাতে মক্কার প্রান্তদেশে ধুতওয়া নামক স্থানে অবস্থান করেন। সকালে তিনি গোসল করেন এবং দিনের আলোয় মক্কায় প্রবেশ করেন। রাসূল যখন কাবায় উপস্থিত হন এবং পবিত্র ওই গৃহকে দেখেন; তখন তিনি দুই হাত উঁচু করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন ওই গৃহের মর্যাদা ও পবিত্রতা বহুগুণ বৃদ্ধি এবং যারা হজ বা ওমরাহ পালন করে ওই গৃহকে সম্মান করে তাদের প্রত্যেককে সম্মানিত ও পুরস্কৃত করার জন্য। রাসূল সা: মসজিদে প্রবেশ করেন এবং তাঁর উষ্ট্রীর পিঠে আরোহণ করে কাবার চার পাশে তওয়াফ শুরু করেন। তওয়াফ শেষ করার পর তিনি মাকামে ইবরাহিম নামে পরিচিত স্থানের পেছনে দুই রাকাত নামাজ পড়েন। তাঁর উষ্ট্রীর পিঠে আরোহণ করে তিনি আল সাফা ও আল মারওয়া পর্বতের মধ্যে সায়ী করার জন্য এগিয়ে যান। এটি সম্পন্ন করার পর তিনি তাঁর সাথে আগত যেসব মুসলিম কুরবানির পশু আনেনি, তাদেরকে হজের সময় না আসা পর্যন্ত ইহরাম খুলে ফেলার নির্দেশ দেন। রাসূল ও তাঁর সাহাবিগণ জিলহজ মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত মক্কায় অবস্থান করেন; ওই সময় থেকে হজের করণীয় কাজ শুরু হয়।

চূড়ান্ত ভাষণ জিলহজ মাসের আট তারিখ মধ্যাহ্নে রাসূল তাঁর উষ্ট্রীর পিঠে আরোহণ করে মক্কা থেকে যাত্রা করেন এবং মিনায় যান- এখানেই তিনি রাত্রিযাপন করেন। প্রত্যুষে তিনি মিনায় ফজর নামাজ আদায় করেন এবং সূর্য ওঠার পর আরাফাত যান। আরাফাতে তিনি তাঁর উষ্ট্রীর পিঠে আরোহণ অবস্থায় প্রধান ভাষণ দেন। রাবিয়াহ ইবন উমাইয়া ইবন খালাফ নামক এক ব্যক্তির উচ্চকণ্ঠ ছিল। তিনি রাসূলের উষ্ট্রীর পাশে দাঁড়িয়ে রাসূল যা বলেন তার প্রতিটি বাক্য আবার উচ্চারণ করেন; যেন রাসূলের সাথে থাকা সব লোক তা শুনতে পায়। ওই দিন রাসূলের ভাষণ ছিল হজ পালনের প্রধান অংশ। এ ভাষণে তিনি ইসলামী সমাজের রূপরেখা প্রদান করেন। আগের মতোই তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা বর্ণনা করে তাঁর ভাষণ শুরু করেন।

অতঃপর রাসূল বলেন : জনগণ, আমি তোমাদের যা বলছি তা শোনো, কারণ এ বছরের পর এখানে আর কখনো তোমাদের সাথে মিলিত হতে পারব কি না, তা আমি জানি না। জনগণ, তোমরা কি জানো কোন মাস, দিন ও শহরে তোমরা আছো? তারা বলল : ‘আমরা একটি পবিত্র দিন, একটি পবিত্র মাস ও একটি পবিত্র শহরে আছি।’ তিনি বললেন : ‘তা হলে তোমরা জানো যে, তোমাদের পবিত্র এই দিনে, তোমাদের এই মাসে, তোমাদের এই শহরে একইভাবে তোমাদের প্রভুর সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের রক্ত, সম্পত্তি ও খ্যাতি তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হলো। তোমরা নিশ্চিতভাবে তোমাদের প্রভুর সাথে মিলিত হবে এবং তোমরা যা করো, সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিতভাবে তোমাদের জিজ্ঞাসা করবেন। আমি কি আমার বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছি?’ তারা উত্তর দিলো : হ্যাঁ। তিনি বললেন : ‘প্রভু আমার, সাক্ষী থাকুন। অন্যের কোনো জিনিস নিরাপত্তার জন্য নিজের জিম্মায় রাখলে তা অবশ্যই তার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে, যে তার অধিকারী। অতীত অজ্ঞতা যুগের সুদের সব লেনদেন এতদ্বারা বাতিল করা হলো। তোমরা শুধু মূলধন দাবি করতে পারো; কোনো অন্যায় বা অনিষ্ট আরোপ না করে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে। আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে, কোনো সুদ অনুমতিযোগ্য নয়। আমার চাচা আল আব্বাস ইবন আবদ আল মুত্তালিবের সুদের লেনদেন আমি প্রথম বাতিল করলাম। প্রতিশোধমূলক সব হত্যার ঘটনা এতদ্বারা প্রত্যাহার করা হলো। এভাবে আমি প্রথম আমির ইবন রাবিয়াহ ইবন আল হারিছের হত্যার ঘটনা প্রত্যাহার করলাম। আমি কি আমার বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছি?’ তারা বলল : ‘আপনি পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।’ তিনি বললেন : ‘প্রভু আমার, সাক্ষী থাকুন। জনগণ, পবিত্র সব মাসে স্থগিতকরণ হলো অবিশ্বাসের বাড়াবাড়ি; যারা অবিশ্বাসী তারা এর মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তারা এক বছর এই স্থগিতকরণ অনুমতিযোগ্য এবং অন্য বছর তা বাতিল ঘোষণা করে আল্লাহ যে সংখ্যক মাসকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন, তা বাহ্যিকভাবে মেনে চলার উদ্দেশ্যে এবং এভাবে আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন, তা ন্যায়সঙ্গত বলে তারা গ্রহণ করে।

সময়কে এখন পেছনে ফেরানো হয়েছে এর মূল রীতির সেই সময়কালে যখন আল্লাহ আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন। আল্লাহর দৃষ্টিতে মাসের সংখ্যা হলো বারো, যার মধ্যে চারটি মাস পবিত্র, তিনটি মাস ধারাবাহিকভাবে এবং একটি মাস এককভাবে : জিলকদ, জিলহজ, মহররম এবং রজব; জমাদিউস সানি ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস হলো রজব। এটি হলো আল্লাহর শাশ্বত সত্য বিধান। সুতরাং এসব মাসের ব্যাপারে নিজের বিরুদ্ধে পাপ করো না।

আমি যখন থাকব না, তখন তোমরা অবিশ্বাস, একে অন্যকে হত্যার পথে ফিরে যেও না। আমি কি আমার বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছি? তারা উত্তর দিলো : আপনি নিশ্চিতভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর বক্তৃতা অব্যাহত রাখেন এবং বলেন : প্রভু আমার, আপনি আমার সাক্ষী থাকুন। জনগণ, তোমাদের নারীদের প্রতি তোমাদের বাধ্যবাধকতা আছে এবং তোমাদের প্রতি তাদের বাধ্যবাধকতা আছে। তোমরা যাকে অপছন্দ করো তাকে তোমাদের অনুমতি ছাড়া তোমাদের গৃহে প্রবেশ করতে দেবে না। যদি তারা তা করে তা হলে তাদেরকে বিছানায় ত্যাগ করার অনুমতি আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন, অতঃপর কোনো কঠোরতা ছাড়াই তাদের প্রহার করবে। তারা যদি নিবৃত্ত হয় তা হলে ন্যায্যভাবে খাদ্য ও পোশাক পাওয়ার অধিকার তাদের আছে। তোমাদের নারীরা তোমাদের তত্ত¡াবধানে আছে; তারা অসহায়। আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করে তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কথা অনুযায়ী তারা তোমাদের জন্য বৈধ। নারীদের প্রতি তোমাদের আচরণে তাই আল্লাহকে ভয় করো এবং তাদের প্রতি সদয় হও। আমি কি আমার বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছি? তারা উত্তর দিলো : বস্তুত হ্যাঁ।

তিনি বললেন : প্রভু আমার, আমার সাক্ষী থাকুন। জনগণ, বিশ্বাসীরা ভাই ভাই। ভাইয়ের সম্পত্তি নেয়া কারো জন্য অবৈধ যদি তা জোরপূর্বক ছাড়াই দেয়া না হয়। জনগণ, তোমাদের প্রভু একজন এবং তোমাদের পিতা একজন। তোমরা সবাই আদমের সন্তান এবং আদমকে সৃষ্টি করা হয় মাটি থেকে। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে মহান যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু। আল্লাহর ভয় ছাড়া কোনো অনারবের ওপর কোনো আরব প্রাধিকার ভোগ করে না। আমি কি আমার বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছি ? তারা উত্তর দিলো : হ্যাঁ, অত্যন্ত নিশ্চিতভাবে আপনি তা করেছেন।
তিনি বললেন : প্রভু আমার, আপনি আমার সাক্ষী থাকুন। জনগণ, এ ভ‚মিতে শয়তান পূজিত হবে এমন কোনো আশা সে ছেড়ে দিয়েছে। তবে সে সন্তুষ্ট এ জন্য যে, তোমরা যেসব বিষয় তুচ্ছ বলে মনে করো সেসব বিষয়ে তাকে মান্য করা হবে। তার বিরুদ্ধে সতর্ক হও, যেন সে তোমাদের ধর্মবিশ্বাসকে বিকৃত করতে না পারে। আমি তোমাদের জন্য যা রেখে যাচ্ছি, তা যদি তোমরা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকো তা হলে তা তোমাদের বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করবে। এটি এমন কিছু যা সুস্পষ্ট ও সহজবোধ্য : আল্লাহর গ্রন্থ ও তাঁর বাণীবাহকের সুন্নাহ। আমার সম্পর্কে তোমাদের কাছে জিজ্ঞাসা করা হবে। তোমরা কী বলবে? তারা বলল : ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আপনার বাণী সম্পূর্ণরূপে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং আপনি আপনার মিশন সম্পন্ন। করেছেন ও সৎ উপদেশ দিয়েছেন।

রাসূল তাঁর তর্জনী আকাশের দিকে তুলে ধরেন এবং তা নামিয়ে জনগণের প্রতি দিকনির্দেশ করেন এবং বারবার বলতে থাকেন : প্রভু আমার, সাক্ষী থাকুন। প্রভু আমার, সাক্ষী থাকুন। রাসূল সা: অতঃপর বলেন : তোমরা যারা উপস্থিত আছে তারা আমি যা বলেছি, তা তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দাও যারা আজ আমাদের সাথে নেই। এটি হতে পারে যে, যারা এটি এভাবে জানতে পারবে তারা তা তাদের চেয়ে সঠিকভাবে অনুধাবন করবে, যারা এটি শুনেছে। এভাবে রাসূল সা: তাঁর প্রধান ভাষণ সমাপ্ত করেন।
পাঁচটি মূলনীতি স্মরণীয় ওই ভাষণে ইসলামী কর্মধারার পাঁচটি মৌলিক নীতির দিকনির্দেশনা রয়েছে। এর মধ্যে দু’টি কাজ ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং তিনটি কাজ ইসলামী সমাজকাঠামোর সাথে জড়িত। ইসলাম দু’টি মৌলিক নীতির ভিত্তিতে মুসলিমদের চরিত্র গড়ে তোলে। প্রথমত, অজ্ঞতা বা জাহিলিয়া যুগের প্রতিমা, রীতিনীতি, আর্থিক লেনদেন, সুদ আদান-প্রদান এবং এ ধরনের যেসব কাজের সাথে মুসলিমরা জড়িত ছিল, তা ইসলাম ছিন্ন করে; কারণ ইসলাম গ্রহণের অর্থই হলো মুসলিমদের জন্য এক নতুন জীবনের শুরু, যা অতীতের সব বিভ্রান্ত জীবনধারা থেকে একেবারে আলাদা। দ্বিতীয় নীতি হলো, সব ধরনের পাপ থেকে সতর্ক থাকা। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রæদের চেয়ে পাপের পরিণাম আরো বেশি ভয়ানক। আমাদের জীবনের সব বিপর্যয়ের কারণ হলো আমাদের পাপ, যা আমাদেরকে পরকালের দুঃখকষ্টের পথেও পরিচালিত করে। রাসূল এটিও স্পষ্ট করে দেন যে, পাপ বলতে তিনি অতীতের পৌত্তলিক উপাসনায় নিমগ্ন থাকার কথাই বোঝাতে চাননি। আল্লাহর একত্বের ওপর ভিত্তিশীল ধর্ম সম্পর্কে জানার পর কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি নিজেকে অধঃপতিত করে কখনো স্বেচ্ছায় গ্রহণ ও দাবি করবে না যে, আল্লাহর অংশীদার আছে। তবু শয়তান মানুষকে বিপথগামী করার জন্য তাদেরকে পাপকাজে প্রলুব্ধ করার প্রয়াস ত্যাগ করে না।

রাসূল আরো তিনটি মূলনীতির দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যার ওপর ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত। প্রথমটি হলো ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ, যা সব মুসলিমের মধ্যে যথার্থ সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই ভ্রাতৃত্ববোধই প্রত্যেক মুসলিমকে অন্য মুসলিমের পৃষ্ঠপোষক করে দেয়, তাকে সে যতটা সম্ভব সাহায্য করে। দ্বিতীয় নীতি হলো দুর্বলকে সহায়তা করা, যেন তাদের দুর্বলতা সমগ্র সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে। এ কথা স্মরণ রাখা উচিত যে, সমাজে সবচেয়ে দুর্বল মহিলাদের প্রতি সদয় হওয়ার জন্য রাসূল কতটা গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তৃতীয় নীতি হলো ইসলামী আইনের যথার্থ বাস্তবায়নের জন্য ইসলামী সরকার ও ইসলামী সমাজের সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতা; কারণ ইসলামী আইন সমাজ থেকে সব ধরনের মন্দ দূরীভ‚ত করার এবং এর বদলে যা ভালো তা কার্যকর করার জন্য কাজ করে। এ পাঁচটি মূলনীতির সার্বিক বৈশিষ্ট্য হলো কুরআন ও সুন্নাহকে বাস্তবে রূপান্তরিত করা। এ জন্য রাসূল কুরআন ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখার এবং তা তাদের জীবনে বাস্তবায়ন করার জন্য তাঁর সাহাবিদের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলের এ ভাষণটি সংক্ষিপ্ত হলেও এর মধ্যে এমন সব নীতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা ইসলামে সত্যিকার বিশ্বাসী ও যথার্থ ইসলামী সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন। এ জন্য রাসূল তাঁর অনুসারীদের বলতে আগ্রহী ছিলেন যে, তিনি তাঁর বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর মিশন সম্পন্ন করেছেন। তিনি বারবার আল্লাহর কাছে তাঁর সাক্ষী থাকার জন্য প্রার্থনা করেন।

হজ পালনের জন্য আল্লাহর নির্দেশের পর এই ধর্মীয় কর্তব্য পালনের এটিই ছিল রাসূলের একমাত্র হজ পালন। তাঁর ওই হজ পালন সম্পন্ন হওয়ার পর মুসলিমরা ইসলামের সব বিষয়ে বাস্তব দিকনির্দেশ অনুসরণ করতে সমর্থ হয়। একাধিক ইঙ্গিত থেকে অনুমান করা হয় যে, রাসূলের মিশন শেষ হওয়ার পথে। এ যাবৎ আল্লাহর বাণীবাহক মুসলিমদের মধ্যে তাদেরই একজন হিসেবে বসবাস করেছেন। আল্লাহর কাছ থেকে তিনি সরাসরি পথনির্দেশ পেয়েছেন এবং মুসলিমদের কোনো সমস্যার সমাধানে সঠিক পথ অনুসরণে তাদের উপদেশ দিয়েছেন। রাসূল ছাড়া ইসলামী জীবন অব্যাহত রাখার সম্ভাবনা তারা চিন্তাও করতে পারেনি। তবু রাসূল অনুধাবন করেন যে, এটা অবশ্যম্ভাবী। এজন্য তিনি তাদেরকে ওই সম্ভাব্য ঘটনার বিষয়ে প্রস্তুত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন।

অনুবাদ: আবু জাফর


আরো সংবাদ



premium cement