১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘বিয়ে’ শান্তি না অশান্তি

- ছবি : সংগৃহীত

বিয়ে একটি যুগলের নতুন জীবনের সূচনা। বিয়ে দু’টি নারী ও পুরুষের পারিবারিক জীবনযাপন করার মাধ্যম বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। বিয়ে দু’টি মানুষের শান্তির আবাসস্থল; আবার বিয়ে দু’টি মানুষের অশান্তির সূচনা! ডিজিটাল যুগ হিসেবে আধুনিকতার নামে বিয়েকে ডিজিটাল বানিয়ে ফেলেছে বেশির ভাগ মানুষ। ফলে অনেক সময় বিয়ে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন মজবুত করে না। আধুনিক বিয়ে মানেই যেন কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া! বিয়ে মানেই যেন যৌতুক, আসবাবপত্র বা টাকার ছড়াছড়ি। বিয়ে মানেই যেন পিজ্জা হাটবাজার বা যৌতুকের বাজার। বিয়ে মানেই বধূ বা নারী নির্যাতনের নবযাত্রা। বিয়ে মানেই টেনশন, বিয়ে মানেই তালাক, আত্মহত্যা, বিয়ে মানেই একজন নারীর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জীবন বিলিয়ে দেয়া। বিয়ে মানেই মামলা মোকদ্দমা ইত্যাদি! এমন হবে কেন?

আমাদের গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলা শহরের কাছে সুপরিচিত সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের অন্যতম একটি পরিবার। বিগত ২০০ বছরের মধ্যে আমাদের বংশের কোনো ছেলে তার বউকে তালাক দিতে হয়নি। আমাদের বাড়ির মেয়েদের স্বামী তালাক দিয়ে ফেরত দেয়ার মতো কোনো ঘটনা এখনো ঘটেনি। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিয়ে নিয়ে কোনো মামলা মোকদ্দমা সালিস ইত্যাদি মোকাবেলা করতে হয়নি আমাদের পরিবারকে। ঐতিহ্যগতভাবে এ পরিবারের কোনো সদস্য মানুষের উপকার ছাড়া ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজে অংশগ্রহণ করে না।

বিয়ে শান্তি না অশান্তি এ বিষয় এখন বাংলাদেশে সবার জন্য জটিল বিষয়। আজকাল পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় যৌতুকের জন্য নতুন বউয়ের আত্মহত্যা! তালাক! মামলা মোকদ্দমা ইত্যাদি। ধনী বা গরিব, শহর বা গ্রামে কোনো ভেদাভেদ নেই। যৌতুকের মামলা মোকদ্দমা, তালাক ইত্যাদির ছড়াছড়ি চলছে। ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বিয়েও টিকছে না। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে দিন দিন ছোট হচ্ছে। শিক্ষিত ধনিক মুসলিম মা-বাবার স্থান বৃদ্ধাশ্রমে! টাকার উন্মাদনায় বংশ, গোত্র, সামাজিক মর্যাদা কিছুই না দেখে আড়ংয়ের জামা খরিদের মতো আত্তীকরণ করছে! যার পরিণতি যৌতুকের দাবি! তালাক! আত্মহত্যা! মামলা মোকদ্দমা ইত্যাদি মোকাবেলা করতে হচ্ছে অনেক মুসলিম পরিবারকে ডিজিটাল বিয়ের পরিণামে শান্তির বদলে দু’টি পরিবারে অশান্তি!

শুধু টাকার ছড়াছড়ি, দামি বাড়ি গাড়ি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, উচ্চ শিক্ষিত ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিশেহারা হয়ে মানবেতর জীবন অতিবাহিত করেন অনেক অভিভাবক। বিয়ের পরে অশান্তির মূল কারণ হলো- দু’টি পরিবারের সামাজিক অবস্থান, আচার আচরণ যাচাই না করা। ছেলেপক্ষের অথবা মেয়েপক্ষের অভিভাবকদের আয় রোজগার হালাল কি না, যাচাই না করা। বিয়ে হলো দু’টি পরিবারকে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ করা। আত্মীয় হিসেবে একে অপরের পাশে থাকবে, সবাই সবাইকে শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার চোখে দেখবে।

দু’টি নারী ও পুরুষের মিল হবে কি না তা যাচাই করে না বিধায় বিয়ে মানেই অশান্তি। মেয়ের বা ছেলের পরিবার রাষ্ট্র বা সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত কি না, ঘুষখোর, সুদখোর, সন্ত্রাসী, টাকার প্রতি লোভী, প্রতারক, নারীর প্রতি মিথ্যাচারী, যৌতুকলোভী, অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত কি না ইত্যাদি যাচাই না করে আত্মীয়তা করাই বিয়ের অশান্তির অন্যতম কারণ!

বিয়ে শান্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে অথবা অশান্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে, তা বিয়ের কিছু দিনের মধ্যে বোঝা যায়। সে জন্য বিয়ের আগেই শিক্ষিত এবং ধনিক শ্রেণীর পারিবারিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থা যাচাই করে না, শুধু আমার এ ছেলেকে অমুক মেয়ের জামাই বা আমার মেয়েকে তমুক ছেলের বউ হিসেবে দেখতে চাই! এই চাহিদাই বিয়ে অশান্তির মূল কারণ নিহিত।

একটি বাস্তব ঘটনা, আমার সুপরিচিত এক ভদ্রলোক, তার বাড়ি গোপালগঞ্জ, তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার ছিলেন। তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। দুই ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। বড় মেয়ে গ্র্যাজুয়েট। আমাকে বললেন তার বড় মেয়ের জন্য একটা সুপাত্র দেখার জন্য। আমি বললাম আমাকে একটা বায়োডাটা দেয়ার জন্য। উনি বললেন, আপনি আমাকে চেনেন। আবার বায়োডাটা লাগবে কেন? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার সময় মসজিদে দেখা হয়। বিনয়ের সাথে বললাম, আপনার বংশের পরিচয় আমি জানি না। আপনার সামাজিক মর্যাদা ও পারিবারিক অবস্থান আমি কিছুই জানি না। তিনি আমাকে বললেন, এখন ডিজিটাল যুগ এত কিছু লাগে না। আমি কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপ থাকা উচিত মনে করি। কিছু দিন পর বললেন, আমার বড় মেয়েকে আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশী ছেলের কাছে বিয়ে দিয়েছি। শুনে আলহামদুলিল্লাহ পড়লাম।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ঘটক কে? গ্রামের বাড়ি কোথায়? ছেলের বাড়ি বা গোষ্ঠী বা সামাজিক অবস্থা দেখেছেন কি? তিনি আমাকে বললেন, এত সব দেখার সময় কোথায়? ছেলের বাড়ি নেত্রকোনা জেলায়, আমার বন্ধুর ভাগিনা, এতেই আমি খুশি। এর পরও বললাম, এক জেলার একেক সংস্কৃতি। গ্রামের বাড়ি থেকে পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থা জেনে নেয়া ভালো ছিল! টাকা থাকলে আমেরিকা বা ইউরোপের চাকরিজীবী পুরুষ অনেক সময় দু-তিনটি বিয়ে করে। ছয় মাস পর তাকে জিজ্ঞাসা করলাম মেয়ে ও জামাই কেমন আছে? দুঃখের সাথে জানতে পারলাম, মেয়েটা জামাইকে তালাক দিয়েছে! জামাইকে কেন তালাক দিলো? ভদ্রলোক বললেন, জামাই তিন মাস থেকে আমেরিকার যাওয়ার পর একটিবারও ফোন করেনি; মোবাইল নম্বর দিয়ে যায়নি ইত্যাদি। ভদ্রলোক ছেলের গ্রামের বাড়ি যাচাই করে জানতে পারেন, নতুন জামাই বিবাহিত, দুই সন্তানের জনক!

এই বিয়ের মূল রহস্য আমেরিকার জামাই এবং ডলার দেখে মেয়ের বাবার অধিক সুখের উল্লাস। টাকার লোভের জন্য বাবা মেয়েটার জীবন শেষ করে দিলেন। বিয়ে ভেঙে গেল দুই বছর, এখনো সেই মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ে হয়নি। মেয়ে মোহরানার ক্ষতিপূরণ পায়নি। ছেলে ঠিকানা ভুল দিয়েছে, কাবিননামা মোতাবেক মেয়ের খোরপোশের কোনো মামলা করা যায়নি।

ছেলেমেয়ের বিয়ে নিয়ে অভিভাবকদের যেন আকাল চলছে। অভিভাবকদের পাত্র-পাত্রী পছন্দের তালিকা দেখলে অবাক হয়ে যাবেন! অভিভাবকদের প্রথম পছন্দের তালিকা- ১. ঢাকা, চট্টগ্রাম ও জেলা শহরে যদি ছেলের বাবা বাড়িওয়ালা হয় তা হলে বাড়িওয়ালার মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে দেখতে চান! ২. তেমনি মেয়ের বাবা বাড়িওয়ালা হলে বাড়িওয়ালা ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবেন! ৩. মেয়ের বাপের অঢেল টাকা থাকলে আগেই জানিয়ে দেন, আমার মেয়ে গাড়িতে চলাফেরা করে! ছেলের গাড়ি বাড়ি আছে কি? ৪. ছেলের পক্ষ থেকে দেখা হয় পাত্রীর ধন সম্পদ! ৫. আবার কেউবা মনে করে, অমুক লাঠিয়াল বাহিনী থেকে ছেলে বা মেয়ে বিয়ে দিয়ে সামাজিক অবস্থান বাড়াবেন!

বিয়ের আগে কেউই দেখছেন না দু’টি নারী-পুরুষ সমগোত্রীয় কি না! পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকবে কি না। গাছে-মাছের আত্মীয়তা হচ্ছে কি না। ভদ্রলোক পরিবারের সাথে বাটপাড়ের আত্মীয়তা হচ্ছে কি না! ছেলে বা মেয়ের বাবা সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী, মাদকসেবী অথবা কালোবাজারি ও সন্ত্রাসী কি না! মেয়ে ও ছেলে মাদকাসক্ত কি না! আয় রোজগার কালো টাকার ছড়াছড়ি কি না! বিয়ে দু’টি মানুষের শান্তির বদলে অশান্তির আমদানি কি না! সবাই ছুটছে টাকার পেছনে। শুধু টাকা আর টাকা। টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে সবাই একসময় থেমেছে বৃদ্ধাশ্রমে। কোর্ট কাচারিতে দৌড়! শেষ বয়সে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু! কেউ বলছে না, ভালো মনের পরিবার চাই। ভালো মনের ছেলে বা মেয়ে চাই।

লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ


আরো সংবাদ



premium cement