২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জেল-জরিমানাই যথেষ্ট নয়

- প্রতীকী ছবি

দেশে নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিতরণের ঘটনা নতুন নয়। বহুদিন ধরে নকল ও ভেজাল ওষুধের রমরমা বাণিজ্য চলছে। আমাদের ওষুধ শিল্পের উন্নতি ঘটলেও নকল ওষুধের বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না। কারণ এক শ্রেণীর অসাধু কোম্পানি বেশি লাভের আশায় নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। এসব নকল ওষুধ মানুষ অজান্তে সেবন করছে; ফলে মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। যেসব ওষুধ সঠিক নয় বা সঠিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি নয় কিংবা অপরিমিত কাঁচামাল দিয়ে তৈরি করা, সেটাই নকল ওষুধ। মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লেই কেবল ওষুধ সেবন করে সুস্থ হওয়ার প্রত্যাশায়। কিন্তু নকল ও ভেজাল ওষুধ সেবনে সুস্থ না হয়ে উল্টো জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সার, লিভার, হৃদরোগ, কিডনিসহ প্রায় সব রোগের ওষুধ নকল হলেও বাংলাদেশে কী পরিমাণ নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন করা হয় তার হিসাব নেই। নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ গণহত্যার শামিল। অথচ জেনেশুনেই কিছু অসাধু কোম্পানি নীরবে এই জঘন্যতম কাজটি করে যাচ্ছে। একজন খুনি একজন মানুষকে হত্যা করে। কিন্তু নকল ওষুধ উৎপাদনকারী পুরো মানবজাতিকে হত্যা করছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। বাংলাদেশে যে পরিমাণ নকল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ হচ্ছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর!

পৃথিবীর অর্ধেকের চেয়েও বেশি দেশে যখন আমাদের ওষুধ সুনামের সাথে বাজারজাত করা হচ্ছে, তখন এ ধরনের নকল ও ভেজাল ওষুধের উৎপাদন বিশ্ববাণিজ্যে আমাদের ওষুধের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ শিল্পের বিকাশমান উন্নয়নকে ধরে রাখতে হলে নকল ও ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধের বিকল্প নেই। বর্তমানে দেশের ৯৮ শতাংশ চাহিদা মিটিয়ে ওষুধ এখন বিশ্বের ১০৬টি দেশে রফতানি হচ্ছে। বিশ্বের ৪৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ওষুধ সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের নামী-দামি ব্র্যান্ডের নকল ওষুধ তৈরি হওয়ার ফলে সম্ভাবনাময় এ খাতটি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ঢাকার বাবুবাজার, মিটফোর্ডসহ সারা দেশের কিছু পাইকারি ওষুধ বাজার, কুরিয়ার সার্ভিস ও অনলাইন-ভিত্তিক কিছু প্রতিষ্ঠান সরাসরি ক্রেতার কাছে নকল ওষুধ পাঠিয়ে দিচ্ছে। এমনকি গাঁওগেরামের ফার্মেসি থেকে শুরু করে রাজধানীর কিছু নামকরা ফার্মেসিতে পর্যন্ত নকল-ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ কোনটা আসল আর কোনটা নকল তা শনাক্ত করতে পারে না। কারণ প্রেসক্রিপশন নিয়ে ফার্মেসিতে গেলেও ওষুধের দোকানদার প্রেসক্রিপশনের ওষুধ না দিয়ে বেশি লাভের আশায় কম দামের ওষুধ দিয়ে দেয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য ওষুধের ফার্মেসিতে বৈধ সনদধারী ফার্মাসিস্ট থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা ফার্মেসির বেশির ভাগগুলোতে বৈধ সনদধারী ফার্মাসিস্ট নেই। অথচ বৈধ সনদধারী ফার্মাসিস্টরা বেকারত্বের অভিশাপে নিদারুণ কষ্টে দিনপাত করছেন। ওষুধের দোকানদাররা মনের অজান্তেই বেশি লাভের লোভে নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি করছেন। এ সমস্যার সমাধানকল্পে মডেল ফার্মেসির সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ে মডেল ফার্মেসি গড়ে তুলতে পারলে, এ প্রবণতা অনেকটাই কমবে। এতে বেকার ফার্মাসিস্টদের কর্মসংস্থান যেমন হবে তেমনিভাবে বেপরোয়া ওষুধ বিক্রির প্রবণতাও কমে আসবে।

নকল ওষুধের রমরমা বাণিজ্য নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। কারণ আইন আছে। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন সময় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা অভিযান পরিচালনা করলে ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ হয়। কিন্তু শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয় না। ড্রাগস আইনে সর্বোচ্চ ১০ বছর শাস্তি এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ওই দুটি আইনে নকল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের জন্য কেউ শাস্তি পেয়েছেন এমন নজির খুবই কম। ভ্রাম্যমাণ আদালতকে মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়। কিন্তু জরিমানা পর্যন্তই শেষ। অনেক ক্ষেত্রে মামলা হলেও অসাধুচক্র তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে ফেলে। ফলে বন্ধ করা যাচ্ছে না নকল ও ভেজাল ওষুধ বিতরণ। এ ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলে এটা কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা সম্ভব। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নজরদারি আরো বাড়ানো উচিত। প্রয়োজনে তাদের জনবল বাড়ানো উচিত এবং তাদের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকা দরকার।

নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিতরণ একটি ব্যাপক সমস্যা। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, ভারত এবং ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশেই এই ব্যবসা রমরমা। প্রতি বছর আফ্রিকায় ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মায় ভেজাল ওষুধ খেয়ে কমপক্ষে সাত লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বের উৎপাদিত ওষুধের মধ্যে ১৫ শতাংশ ওষুধে ভেজাল রয়েছে। এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে এ সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশে ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ক্ষতিকর প্যারাসিটামল সিরাপ সেবন করে কয়েক হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটে। সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ভাষ্যমতে, এ সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। ২০০৯ সালেও ভেজাল ওষুধ সেবনে ২৮ শিশুর মৃত্যু হয়। অস্ট্র্রেলিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে নকল ও ভেজাল ওষুধের পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। কারণ ওই দেশগুলোতে ওষুধ শিল্পের ওপর সরকারের কঠোর আইনের নীতি প্রতিষ্ঠিত আছে। চীনে ওষুধ এবং খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশালে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। আমাদের দেশেও আছে। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।

নকল ওষুধ প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে তারপর বাজারজাতকরণ করতে হবে। এ বিষয়টি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট দফতরকে নিশ্চিত করতে হবে। কারণ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ খাদ্য যেমন জরুরি, তেমনি নিরাপদ ওষুধও জরুরি। খাদ্য ও স্বাস্থ্য একটি আরেকটির পরিপূরক। টেকসই জীবন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ খাদ্য ও নিরাপদ ওষুধের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মিডিয়া যৌথভাবে নকল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ রোধে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করলে পুরো দেশবাসী এর সুফল পাবে। সাথে সাথে ওষুধে ভেজাল দিলে এর শাস্তি শুধু জেল-জরিমানার মধ্যে সীমিত না রেখে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যারা এর সাথে জড়িত তারা যেন ভবিষ্যতে কোনোভাবেই এ ব্যবসার সাথে জড়িত হতে না পারে তার বিধানও থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটি একটি গণহত্যা। এক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে।
লেখক : বিশিষ্ট চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement