১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনা–ডেঙ্গু পরিস্থিতি : বাড়তি ঝুঁকিতে জনজীবন

করোনা–ডেঙ্গু পরিস্থিতি : বাড়তি ঝুঁকিতে জনজীবন - ছবি সংগৃহীত

বিশ্বের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত। ২০১৯ সাল থেকে এখন অব্দি শাসন করে চলেছে গোটা বিশ্বকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্যখাত, হাসপাতাল, চিকিৎসকসহ সেবায় নিয়োজিতরা। তবে দুর্ভোগ এখনো কমেনি এবং কবে কমবে তা বলা মুশকিল। কারণ করোনার সাথে সাথে এখন স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে ডেঙ্গু।

রোগ হিসেবে ডেঙ্গু নতুন না হলেও পূর্বের ন্যয় এই রোগ এখনো ভয়াবহ। করোনা যেমন মানব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়, ডেঙ্গুও তাতে কম পারদর্শী নয়। ইতিহাসে বিভিন্ন সময় ডেঙ্গু মহামারীর সন্ধান পাওয়া গেছে। একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় ৪০ কোটি মানুষ বিশব্যাপী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। অন্য একটি গবেষণা মতে, ১২৮টি দেশজুড়ে প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের দেশ সহ পার্শবর্তী দেশ যেমন ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কায় প্রতি বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়।

১৯৯৯ থেকে ২০০০ সালের দিকে প্রথম এই রোগের আবির্ভাব ঘটে বাংলাদেশে এবং ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগ হিসেবে পরিচিতি পায়। তৎকালীন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় অন্যতম এক আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছিল ডেঙ্গু। তবে প্রযুক্তি উন্নত হওয়ার সাথে সাথে এখন আতঙ্ক কিছুটা কমে এলেও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এখনো বিস্তর। দেশে সরকারিভাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতির হিসাব রাখা শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে এবং বিগত ১৩ বছরে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এই বছর ইতোমধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ১০ হাজার ছাড়িয়েছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে ৪৫ জন রোগী। [সোর্স : স্বাস্থ্য অধিদফতর] আক্রান্তের হারে পিছিয়ে নেই শ্রীলঙ্কাও। বিগত ৫ বছরে শ্রীলঙ্কায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর যদিও আক্রান্তের হার কিছুটা কম (প্রায় ১২ হাজার) তবে নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে পরিস্থিতি গুরুতর হতে সময় লাগবে না। এছাড়া, নেপালে বিগত ৫ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২২ হাজার মানুষ। চলতি বছর আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। পাকিস্তানে বিগত ৫ বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। চলতি বছরে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার এবং মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১০ জন। [সোর্স : যথাযথভাবে প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্য অধিদফতর]

তবে অন্যান্যবারের মতো এবারেও গুরুতর ভারতের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। ভারতে বিগত ৭ বছরে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রায় ১৫০০ জন মৃত্যুবরণ করেছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার এবং মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১০ জন। [সোর্স : এনভিবিডিসিপি, ইন্ডিয়া] ইতোমধ্যেই করোনার আঘাতে বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো তালিকায় ভারত অন্যতম। তার উপর এখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামলাতে বাড়তি খাটনি খাটছে দেশটির চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।

ভারতের ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ভারতের বিখ্যাত ইয়াশোদা হসপিটাল-এর ইন্টারভেনশনাল পালমোনোলজি এবং স্লিপ মেডিসিন-এর কনসালটেন্ট ডা. ভিসওয়াসভারান বালাসুব্রামানিয়ান বলেন, “বর্তমান বর্ষা মৌসুমে গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশগুলোতে যেহেতু মশাবাহিত রোগের সংখ্যা বিশেষ করে 'ডেঙ্গু' বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই নিকটস্থ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো উচিত যথাযথ সেবাদানে প্রস্তুত থাকা। ভারতে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানোর উপায় হিসেবে জনসাধারণের স্বাস্থ্যবিধি উন্নত করার প্রচেষ্টা এবং মশার বংশবৃদ্ধি রোধের ব্যবস্থা গ্রহণ আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। মশার বংশবৃদ্ধি রোধে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে টিমেফোসের মতো ভালো লার্ভিসাইড ব্যবহার, ব্যাসিলাস থুরি জেনেসিসের মতো জৈব লার্ভিসাইড ব্যবহার, গাম্বুসিয়ার মতো লার্ভিভোরাস মাছ এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জাতীয় কর্মসূচিতে কীটনাশক বৃদ্ধির নিয়ম জারি অন্যতম।

প্রতিবেশী দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশ ও ভারত প্রাকৃতিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ দুটি দেশ। চলমান মহামারিতে রোগীর জনসংখ্যাত্মিক প্রেক্ষাপট এবং গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রাকৃতিক অবস্থানে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ভারত থেকে খুব একটা আলাদা নয়। উভয় দেশ যদি সক্রিয়ভাবে কোভিড-১৯ মহামারি এবং ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রতিরোধ বিষয়ে অর্জিত শিক্ষা, জ্ঞান এবং স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত উপকরণাদি দিয়ে একে অপরকে সহায়তা করে, তাহলে দুই দেশ মিলিয়ে আরও দক্ষ এবং অনুকূল উপায়ে এই ধরণের সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব। এছাড়া ডেঙ্গুর সংক্রমণ রোধে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন এবং জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড-এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। যা ভবিষ্যতে এই ধরণের রোগ নিয়ন্ত্রণে সুফল বয়ে আনবে।”

বাংলাদেশের রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল-এর মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. মৌসুমি সানিয়াল জানিয়েছেন, “ডেঙ্গু এবং করোনার উপসর্গ অনেকটাই এক। তবে করোনা হলে জ্বর বেশি না থাকলেও ডেঙ্গুতে সাধারণত জ্বরের মাত্রা বেশি থাকে। প্রায় ১০৩-১০৪ ডিগ্রি জ্বর, মাথা ব্যথা, বিশেষ করে চোখের পিছনে ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ ডেঙ্গুরই আভাস দেয়। তাই উপসর্গ দেখা গেলে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ, অবহেলা করলে অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। শরীরের প্লাটিলেট কমে গিয়ে মস্তিষ্ক বা অন্যান্য স্থানে রক্তক্ষরণ হলে তা মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই হাসপাতালে আসতে অনীহা প্রকাশ করেন। তবে দেশের অনেক হাসপাতালেই ডেঙ্গুর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুতরাং, করোনায় ভয়ে ডেঙ্গুকে অবহেলা করবেন না।”

একদিকে করোনার তীব্রতা, অন্যদিকে মাথা চারা দিয়ে উঠেছে ডেঙ্গু। ফলাফল, নাজেহাল গোটা বিশ্ব। সাধারণ জনগণের তাই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। এই দুটো রোগেরই উপসর্গে মিল রয়েছে, বিশেষ করে আক্রান্ত হওয়ার শুরুর দিকে। জ্বর, মাথা-ব্যথা, গলা-ব্যথা, শরীর-ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলে আগে যেমন শুধু করোনা পরীক্ষা করাতে হতো, এখন উচিৎ করোনা এবং ডেঙ্গু দুটোরই পরীক্ষা করা। পাশাপাশি উচিৎ নিজে সুস্থ থাকা এবং অন্যকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করা।


আরো সংবাদ



premium cement