২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ইনডেমনিটি অ্যাক্টের প্রবর্তক ইংল্যান্ড

ইনডেমনিটি অ্যাক্টের প্রবর্তক ইংল্যান্ড - ছবি : সংগৃহীত

টকশোর জনপ্রিয়তার পূর্বশর্তই হলো- নিরপেক্ষ সঞ্চালনের দক্ষতা, আলোচনা বিষয় যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানীর অংশগ্রহণে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের উপস্থাপন। কোনো কোনো চ্যানেলে এর অনুষ্ঠান বেশ মানসম্পন্ন। কোনোটায় তা নয়। অনেক আলোচকের কথায় সঞ্চালনকারীর বাধা, থামিয়ে দেয়া, নয়তো তর্কে জড়িয়ে সময় ক্ষেপণ এবং সময়ানুপাতে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সংখ্যাধিক অতিথি নিয়ে সুবিস্তৃত বিষয় আলোচনা করা সম্ভব না হওয়া ইত্যাদি কারণে মনে হয়, সময় কাটানোর প্রয়োজনে প্রচারিত, এসব দায়সারা টকশো শ্রোতা-দর্শকদের স্বার্থ তথা মান রক্ষায় সহায়ক নয়।

দলীয় রাজনৈতিক অতিথিদের কেউ না কেউ, কোনো না কোনো ভ্রান্ত ঐতিহাসিক তথ্য অনেক সময়ই উপস্থাপন করে থাকেন, যা লাখো দর্শক-শ্রোতাকে বিভ্রান্ত করার শামিল। কখনো কখনো তাদের তর্কাতর্কি বিরক্তির কারণ হয়ে যায়। তাদের সবাই যে গণতন্ত্রের প্রকৃত তত্ত্ব জানেন বা বোঝেন, তা মনে হয় না। দলীয় সরকার আর দলের পার্থক্য দলীয় এক নেত্রীর না বোঝার বিস্ময়কর বিষয়টি মাসখানেক আগে এক টকশোতেই দেখা গেছে। আমাদের রাজনীতি দলাদলিও পদমর্যাদা ছাড়া বেশির ভাগেরই ন্যূনতম বিষয়ে পড়াশোনার জ্ঞাননির্ভর নয়। গণতন্ত্র হত্যা আর ‘সজীব’ করার দাবি ও অভিযোগের তর্কাতর্কি না হওয়ার টকশো বিরল। কিন্তু কখনোই শোনা যায় না গণতন্ত্রের কিছু ত্রুটির মধ্যে পুঁজির পৃষ্ঠপোষকতা, অজ্ঞের শাসন ও অন্ধ দলীয় চেতনায় জাতীয় স্বার্থের ক্ষতির মতো উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা।

গত ৫ জুলাই রাত ১০টায় টেলিভিশন চ্যানেলের এক টকশোতে সম্ভবত আওয়ামী লীগ সমর্থক এক তরুণ ব্যারিস্টার বললেন, ‘জিয়াউর রহমান জারি করেছেন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, যা পৃথিবীর কোথাও নেই।’ অবশ্য তার সহ-আলোচক বিএনপির জনৈক নেত্রী যথার্থই এটি খোন্দকার মোশতাক আহমদ করেছেন বললেও শ্রোতার থেকে গেল ‘পৃথিবীর কোথাও’ না থাকার কথাটি। অতীতেও এ প্রসঙ্গে কেউই কখনো এর ঐতিহাসিক জন্মতত্ত্বে আলোকপাত না করায় আমাদের দেশে এর প্রয়োগের অসামঞ্জস্য, অসংলগ্নতা, অনৈতিকতা ও অপপ্রয়োগের বিষয়টি হয়তো আজো অনেকের কাছে অস্বচ্ছ।

মৃত্যুর প্রায় বছর তিনেক পরে, ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত, ড. আলীম-আল-রাজীর “ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হধষ এষরসঢ়ংবং ড়ভ গধৎঃরধষ ষড়ি রহ ওহফরধ, চধশরংঃধহ ধহফ ইধহমষধফবংয,” বইয়ের ৬৯ ও ৮৫ পৃষ্ঠার ২৪ নম্বর নোটের- ক. মতে, ‘ইংরেজ ইতিহাসে ইনডেমনিটি অ্যাক্ট বা বিল বিশেষভাবে ১৯৬০ ও ১৬৯০-এর অ্যাক্ট নামে যথাক্রমে চার্লস দ্বিতীয় ও উইলিয়ামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারী ও বিরোধিতাকারীদের পূর্বকালীন ফৌজদারি অপরাধের দায়মুক্তি দেয়া হয়। খ. লাহোরে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পরে পাকিস্তান শাসনতন্ত্র গঠন পরিষদ (ঈঅচ) ১৯৫৪ সালে ইনডেমনিটি অ্যাক্ট পাস করেছিল।

ঐতিহাসিক কারণ : ১. সংসদ ও রাজার মধ্যকার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দাবিজনিত দীর্ঘ দিনের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছালে এর পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করার রাজকীয় উদ্যোগে ব্রিটিশদের ইতিহাসে সূত্রপাত ঘটে ১৯৪২ সালে প্রথম গৃহযুদ্ধের; যাতে পরাজিত ও ১৬৪৭ সালে সংসদীয় বাহিনীর কাছে হওয়া যুদ্ধবন্দী রাজা চার্লস প্রথম-এর (১৬২৫-১৬৪৯ সাল) বিচারে শিরশ্ছেদে ঘটে তার পরিসমাপ্তি। তবেই ফ্রান্সে পালিয়ে থাকা তার ছেলে দ্বিতীয় চার্লস স্কটল্যান্ডের ঝপড়হব-এ এসে রাজাভিষিক্ত হয়ে ইংল্যান্ড আক্রমণ করে পরাজিত হন অলিভার ক্রমওয়েলের (১৫৯৯-১৬৫৮ সাল) কাছে, যিনি ১৬৪৯ থেকে ১৬৫৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের নেতৃত্ব দিয়ে অস্থায়ীভাবে সংসদকে ‘সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী’রূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

কিন্তু তিনিই ১৬৫৩ সালে সংসদকে স্থগিত করে রাজাদের চেয়েও স্বয়ং বেশি একনায়কতন্ত্রী হয়ে যান। তার মৃত্যু হলে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত চার্লসের দ্বিতীয় সীমিত রাজতন্ত্র, ১৬৬০ সালের ৪ এপ্রিল সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সময়োচিত প্রতিজ্ঞা, অতঃপর এক জেনারেলের সহযোগিতায় ১৬৬১ সালে তাকে রাজপদে অধিষ্ঠিত করা হয়। ২. কর্তৃত্ববাদী রাজা জেমস দ্বিতীয় ১৬৮৮ সালে বিপ্লবের বিতাড়িত হওয়ায় সংসদের প্রত্যাশায় ১৬৮৯ সালে রাজা হয়ে উইলিয়াম তৃতীয় নির্বাসিত জেমস দ্বিতীয়কে পরাজিত করেন। প্রায় ৫০ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসানে ইনিই প্রথম ‘শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের রাজা’ (১৬৮৯-১৭০২ সাল) রূপে শাসন করেন। ৩. গোলাম আহমদ মির্জার (১৮৩৫-১৯০৮ সাল) প্রতিষ্ঠিত কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের জন্ম ভারতের অধীনস্থ পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার ইসলামপুর কাদি নামক গ্রামে, যার পরবর্তী ‘কাদিয়ান’ নামানুসারে সম্প্রদায়ের নাম হয়। তার এক দর্শনে গুরু নানককে মুসলমান ও তাকে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের অবতার বলা হতো। (নরেশ কুমার জৈনের গঁংষরসং রহ ওহফরধ, অ ইরড়মৎধঢ়যরপধষ উরপঃরড়হধৎু, ঠড়ষ-ও, ঢ়-১৭৪)।

তিনি নিজেকে ‘নবী’ দাবি করার কথাও অনেক তথ্যে বলা হয়। পাকিস্তানের পাঞ্জাবে এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়ায় তখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী জাফরুল্লাহ খানসহ প্রশাসনের সব কাদিয়ানিকে বহিষ্কারের দাবি ওঠায় এবং লাহোরে কাদিয়ানিদের বাড়িঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ায় ১৯৫৩ সালের ৬ মার্চ লাহোরে জারি করা হয় সামরিক আইন। ফলে কমান্ডিং অফিসার তদানীন্তন মেজর জেনারেল আজম খান খুবই কঠোর হস্তে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনায় এই আইন পাস করা হয়। (আলতাফ গওহরের ‘আইউব খান,’ পৃষ্ঠা-৩২ ও অন্যান্য বই)


আরো সংবাদ



premium cement