২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন : সংশোধনের চেয়ে বাস্তবায়ন জরুরি

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন : সংশোধনের চেয়ে বাস্তবায়ন জরুরি -

বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন থাকা সত্ত্বেও তামাক নিয়ন্ত্রণের বর্তমান অবস্থা সন্তোষজনক নয়। তামাক নিয়ন্ত্রণের এমন পরিস্থিতি হতাশাজনক। দেশের এবং দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যই তামাক নিয়ন্ত্রণে নজর দেয়া প্রয়োজন।

বিস্তারিত আলোচনার আগে, তামাক নিয়ন্ত্রণের বর্তমান চিত্রটা একবার দেখে নেয়া যাক। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) এর তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৯২ লাখে। এছাড়া ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ। শুধু গণপরিবহনেই পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন আড়াই কোটি মানুষ। পরোক্ষ ধূমপানের শিকার মানুষের মোট সংখ্যা ৩ কোটি ৮৪ লাখ।

পরোক্ষ ধূমপানের সরাসরি শিকার হয় শিশুরা। ঘরে ও ঘরের বাইরে শিশুদের সামনেই ধূমপান করে ধূমপায়ীরা। ইচ্ছে করলেও শিশুরা ধূমপানের ক্ষতি এড়াতে পারে না। অথচ বিদ্যমান আইন মানলেই শিশুদের ভয়াবহ দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করা যায়।

সম্প্রতি তামাক পণ্যের ব্যবহার কমাতে এ সংক্রান্ত আইন সংশোধনের দাবি তোলা হয়। বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও সংগঠন এ দাবিগুলো করছেন। তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে গৃহীত আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসিতে (ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। পরে ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এমনি দাবির মুখে ২০১৩ সালে সংশোধন হয় আইনটি।

নতুন সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে প্রকাশ্যে ধূমপান করলে অনধিক তিন শ' টাকা জরিমানা নির্ধারণ করা হয় যা দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে দ্বিগুণ হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়াও অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যুক্ত করা হয়েছে ৬ক ধারাটি। ধারাটি অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে কারো কাছে তামাকপণ্য বিক্রি করা যাবে না বা তাদের দিয়ে তামাকপণ্য বিক্রি করানো যাবে না। কেউ এমন কাজ করলে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। বারবার একই অপরাধ করলে দ্বিগুণ পরিমাণে জরিমানা করা হবে বলেও বলা হয়েছে।

চলতি বছর আবারো আইন সংশোধনের দাবি উঠেছে। তবে, নতুন করে সংশোধন করার আগে এখন আমাদের কয়েকটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। কারণ সংশোধন করলেও যদি কাজ না হয় তাহলে যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কথা হচ্ছে, ২০১৩ সালে সংশোধনের পর আইনটির কতটা কঠোর প্রয়োগ হলো? সংশোধনীর এই ৭ বছরে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের বর্তমান চিত্রটি কী? আইন সংশোধনের বর্তমান দাবিগুলো কতটা যুক্তিযুক্ত তাও পর্যবেক্ষণ করতে হবে আমাদের।

বর্তমানে আইনের যে সংশোধনীর দাবিগুলো করা হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম দাবি- ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্তসহ পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ করা। কিন্তু, পাবলিক প্লেসে ধুমপান নিষিদ্ধ করার বিধান আগে থেকে রয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটির সবচেয়ে শক্তিশালী ও জনবান্ধব ধারা এটি। এত বছর পরেও এই আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ দেখা যায়নি। অন্যদিকে, ধূমপানের জন্য কোনো স্থানও নির্ধারণ করা হয়নি। অথচ, নির্ধারিত স্থানে ধূমপানের ধারাটিই করা হয়েছিল পরোক্ষ ধূমপায়ীদের রক্ষা করতে; বিশেষ করে নারী ও শিশুদের। স্মোক জোনে ধূমপানের বাধ্যবাধকতা থাকলে দৈনিক ধূমপানের হার কমবে বলেও আশা করা হয়। পরোক্ষ ধূমপান রোধে স্মোকজোনের ব্যাপারে উৎসাহিত করেন অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও। স্মোক জোনের বিষয়টি নিষিদ্ধ করে দিলে ধূমপান কমবে না বরং পরোক্ষ ধূমপায়ীর হারই বাড়বে।

এছাড়া কিছু বেসরকারি সংস্থা দাবি করছে সিগারেটের খুচরা বিক্রি বন্ধ করার জন্য। এখানে প্রশ্ন হলো আদতে খুচরা বিক্রি বন্ধ হলে ক্ষতি হবে কার? আমাদের দেশের ৯০ ভাগ সিগারেট বিক্রেতাই খুচরা সিগারেট বিক্রি করে। খুচরা বিক্রি বন্ধ হলে শুধু পাইকারি বিক্রেতাদের ব্যবসাই বাড়বে। অন্যদিকে, কর্মহীন হয়ে পড়বে কয়েক লাখ খুচরা বিক্রেতা। কেননা, অধিকাংশ খুচরা বিক্রেতাই অল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করে। তাদের বিক্রি ব্যবস্থাটিও সুপরিকল্পিত নয়। তাই খুচরা বিক্রেতাদেরকে কোনো বিকল্প কর্মসংস্থান না করে দিয়ে, খুচরা বিক্রি বন্ধ করে দিলে কর্মহীন হয়ে পড়বে কয়েক লাখ মানুষ। করোনাকালে বাংলাদেশ সরকার যখন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করছে, তখন এ ধরণের সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠবে।

প্রশ্ন হলো- এতে করে গ্রাহকদের ধূমপানের হার কমবে কিনা। বাংলাদেশে এখন নিম্নস্তরের ১০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ৪৫ টাকা। এবং এখনো দেশের প্রায় ৭২ ভাগ মানুষ নিম্নস্তরের সিগারেট খান। নিম্ন ও মধ্যস্তর মিলে ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮৪ ভাগ। একজন নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মানুষের দৈনিক উপার্জন যদি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকাও হয়, তাহলেও এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে তার উপার্জনের ৯ থেকে ১০% অর্থ ব্যয় হবে। অর্থাৎ নিম্ন বা মধ্যস্তরের সিগারেটগুলো এখনো দেশের ৮৪ ভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। তাই খুচরা বিক্রি বন্ধ হলে ধূমপানের হার আরো বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তাই বিদ্যমান আইনটির কঠোর বাস্তবায়নে সব শ্রেণি-পেশার মানুষদের এগিয়ে আসা উচিত। সংশোধনের প্রচেষ্টায় সময়ক্ষেপণ আইনটির বাস্তবসম্মত ও যথাযথ প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে আরো বেশি। বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণকেও আইনের প্রয়োগ নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। আর এই সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য সরকার ও জনসাধারণকে একযোগে কাজ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং জনসাধারণের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলে সচেতনতার শক্ত ভিত গড়ে তুলতে হবে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশুদের কথা ভেবে, শিশুদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিদ্যমান আইনটির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত।

তাই নতুন নতুন সংশোধনীর দীর্ঘসূত্রিতা না বাড়িয়ে আমাদের উচিৎ বিদ্যমান আইনটির কঠোর প্রয়োগ করা। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা একদিকে পরোক্ষ ধূমপায়ীর পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারব, অন্যদিকে কমিয়ে আনতে পারব দৈনিক ধূমপানের হার।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

 


আরো সংবাদ



premium cement