২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নবী সা:-এর অবমাননা রোধের উপায়

হামিদ মীর - ছবি : নয়া দিগন্ত

ভলতেয়ার ফ্রান্সের বিখ্যাত দার্শনিক ও লেখক যার রচনাবলি ফরাসি বিপ্লবের ভিত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিনি ফরাসি জনগণকে শক্তিধর শাসকদের ও ক্যাথলিক চার্চের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার সাহস জুগিয়েছেন। এ জন্য তিনি কয়েকবার জেলও খেটেছেন। ভলতেয়ার ১৭৩৬ সালে মুসলমানদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:কে নিয়ে একটি নাটক রচনা করেন। সেখানে কিছু ধৃষ্টতামূলক বাক্য ছিল। চার্চের সমর্থকদের ধারণা হলো, ভলতেয়ার হজরত মুহাম্মদ সা:-এর সমালোচনার মাধ্যমে মূলত ফ্রান্সের খ্রিষ্টান জনগণকে চার্চের বিরুদ্ধে উসকে দেয়ার চেষ্টা করছেন। ওই সময় ভলতেয়ার হজরত মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে অপর ফরাসি সাহিত্যিক হেনরি ডি বৌলেনভিলিয়ার্সের লেখা বই পড়েন। ওই বই পড়ার পর তার চিন্তাধারা বদলে যায়। এরপর তিনি তার লেখায় রাসূলে করিম সা:-এর ধর্মীয় উদারতা স্বীকার এবং প্রকাশ্যে তাঁর প্রশংসা করেন। ইসলামের নবী সম্পর্কে ভলতেয়ারের চিন্তাদর্শন দ্বারা জার্মানির বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক গ্যেটে বেশ প্রভাবিত হন।

গ্যেটে রাখঢাক না রেখে ইসলামের নবীর শ্রেষ্ঠত্বের মহিমার গুণগান করেছেন। আর সেই গুণগান ও স্বীকৃতি প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবালকে গ্যেটের ভক্ত বানিয়ে দেয়। ভলতেয়ার ও গ্যেটের ইসলামপ্রিয়তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। তাদের মিথ্যা ও ভুল প্রমাণিত করার জন্য ফ্রান্স ও জার্মানিতে অনেক ধৃষ্টতামূলক রচনা লেখা হয়েছে। কিন্তু ওই ধৃষ্টতামূলক তথ্য-উপাত্ত সত্ত্বেও বিশ্বে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়তেই থাকে। অখণ্ড ভারতেও কিছু উগ্রবাদী হিন্দু নবী করিম সা:-এর বিরুদ্ধে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট অস্থিরতা পাকিস্তান আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ১৯২৭ সালে লাহোরের এক হিন্দু প্রকাশক রাজপাল নবী করিম সা: সম্পর্কে চরম ধৃষ্টতামূলক এক গ্রন্থ প্রকাশ করে ছিলেন। মুসলমানদের প্রতিবাদের ফলে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। লাহোরের এক নগর ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ডও দেন। কিন্তু হাইকোর্টের বিচারপতি কানওয়ার দুলীপ সিং রাজপালকে মুক্ত করে দেন। এতে মুসলমানরা সর্বাত্মক বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। এরপর একদিন গাজী ইলমে দীন নামে এক যুবক রাজপালকে হত্যা করেন। ইকবাল গাজী ইলমে দীনকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে উকিল নিয়োগ করেন। কিন্তু গাজী ইলমে দীনকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়। ১৯২৯ সালে ফাঁসি হয় ১৯৩০ সালে আল্লামা ইকবাল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের এলাহাবাদ সমাবেশে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যেখানে মুসলমানদের জন্য এক পৃথক রাষ্ট্রের পরিকল্পনা উপস্থাপনা করা হয়। ১৯৩১ সালে জম্মু-কাশ্মির রাজ্যে ইসলাম অবমাননার কিছু ঘটনা সঙ্ঘটিত হয় যার প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানরা বিক্ষোভ প্রতিবাদ করেন। এরপর ১৩ জুলাই ১৯৩১ সালে শ্রীনগরে ২১ জন মুসলমানকে শহীদ করা হয়। ওই শাহাদতকে কেন্দ্র করে ১৪ আগস্ট ১৯৩১ সালে লাহোরের মোচি গেটের বাইরে আল্লামা ইকবালের সভাপতিত্বে সমাবেশ হয়। এখানেই ‘প্রাচ্যের কবি’ প্রথমবারের মতো কাশ্মিরি মুসলমানদের জন্য স্বাধীনতার দাবিও উত্থাপন করেন।

কেউ মানুক আর না মানুক, পাকিস্তান আন্দোলন ও কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের আন্দোলনকারীদের মাঝে এশকে রাসূল ও ইসলামের প্রতি ভালোবাসা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তা না হলে গাজী ইলমে দীন মৌলভী ছিলেন না, কায়েদে আজমও মৌলভী ছিলেন না। আল্লামা ইকবালও মৌলভী ছিলেন না। তবে তাদের সবার মাঝে এশকে রাসূল ছিল কানায় কানায় ভরা। এই এশকে রাসূল প্রতিটি মুসলমানের শিরায় মজ্জায় ছড়িয়ে আছে। কেউ নামাজ পড়ুক বা না পড়ুক, রোজা রাখুক বা না রাখুক, কিন্তু নবী সা:-এর অবমাননা কেউ মেনে নিতে পারে না। এশকে রাসূল মূলত মুসলমানদের ‘ঈমানের অক্সিজেন’। আমাদের কালেমাতেও রয়েছে মুহাম্মদ সা:-এর নাম। কুরআনেও রয়েছে তাঁর নাম, নামাজের মধ্যেও আছে তাঁর নাম। আমরা দরুদ শরিফকে আমাদের রোগের উপশম মনে করি। সুতরাং মুসলমানদের ঈমান এশকে রাসূল ছাড়া পরিপূর্ণ হতে পারে না। বিশ্বের যেখানেই নবী করিম সা: সম্পর্কে ধৃষ্টতা প্রদর্শন হোক না কেন, মুসলমানরা সেটাকে নিজেদের ঈমানের ওপর আক্রমণ মনে করেন। কয়েক বছর আগে আমেরিকার লাসভেগাস শহরে এক কনফারেন্সে আমার অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে অন্যতম আমেরিকান স্কলার রবার্ট স্পন্সর নবী করিম সা: সম্পর্কে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করল এবং রাসূল সা: সম্পর্কে কিছু ভুল তথ্যও উপস্থাপন করলেন। আমি কোনো আলেমে দ্বীন নই; একজন সাধারণ সাংবাদিকমাত্র। আমি আমার সাধ্য মোতাবেক রবার্ট স্পন্সরকে মোক্ষম জবাব দিলাম এবং তাকে ভুল প্রমাণিত করলাম। কনফারেন্স শেষ হলে অংশগ্রহণকারীদের একটি বড় অংশ আমার কাছে ইসলাম সম্পর্কে বই-পুস্তকের খোঁজ নিতে শুরু করলেন। আমার সেই গ্রন্থগুলোর নাম জানা ছিল, যেগুলো পাকিস্তানে সহজলভ্য। তবে মাইকেল হার্টের ‘দ্য হান্ড্রেড’ দিয়েই কাজ চালিয়ে নিলাম। ওই গ্রন্থে বিশ্বের ১০০ জন মহামনীষীর সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বশীর্ষে রয়েছেন হজরত মুহাম্মদ সা:। ওই সময় অনুভব করলাম, মুসলমান নিজেদের ধর্ম ও নিজেদের নবী সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলোকে নিরসনের জন্য লেখাপড়ায় এতটা জোর দেয়নি, যতটা জোর দেয় সভা-সমাবেশ ও জ্বালাও-ঘেরাওতে।

২০০৫ সালে ডেনমার্কের এক সংবাদপত্র নবী করিম সা:-এর ধৃষ্টতামূলক কার্টুন প্রকাশ করলে বহু মুসলিম দেশেই প্রতিবাদ হয়েছে। সংবাদপত্রটি ওই কার্টুন প্রকাশকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ইস্যু বানানোর চেষ্টা চালায়। ২০০৬ সালে সুইডেনের কিছু ওয়েবসাইট ওই কার্টুনগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ছড়াতে শুরু করে। ওই ওয়েবসাইটগুলোকে বলা হয়, এই কার্টুনগুলো সরিয়ে নাও। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পরিশেষে সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লায়লা ফ্রেইভাল্ডসকে পদত্যাগ করতে হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ওয়েবসাইটগুলো থেকে কার্টুন সরানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী ছিল। ইউরোপের বেশির ভাগ সরকার চাইলেও তারা তাদের মিডিয়াকে ধৃষ্টতামূলক কার্টুন প্রকাশে বাধা দিতে পারবে না। তবে কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্রে নবী করিম সা: সম্পর্কে ধৃষ্টতা অবলম্বনে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা ওআইসি ১৯৯৮ থেকে নিয়ে ২০১১ সাল পর্যন্ত বারবার চেষ্টা করেছে, জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে রাসূল সা:-এর অবমাননা রোধে উদ্যোগ নেয়া হোক। কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলো ওআইসিকে সহযোগিতা করেনি। ২০১১ সালে অস্ট্রিয়ার একটি আদালতে নবীকে অবমাননার কারণে এক মহিলাকে ৪৮০ ক্রোনা জরিমানা করা হয়। এই মহিলা ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসে আপিল করে বলেন যে, তাকে দেয়া শাস্তি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। ইউরোপীয় কোর্ট শাস্তির পক্ষে রায় দিয়ে বলেন, মুসলমানদের নবী সম্পর্কে ধৃষ্টতামূলক আচরণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়। কেননা, এর দ্বারা বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। সাত সদস্যবিশিষ্ট ইউরোপীয় কোর্ট ২০১৮ সালে ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গে এই রায় ঘোষণা করেন। ওআইসি এই রায়কে ভিত্তি করে দাবি করতে পারে, বিশ্বের সব ধর্ম ও সব নবীর অবমাননা থামাতে আইন প্রণয়ন করা হোক যাতে বিদ্বেষের প্রসার কমে আসে। নবী পাক সা:-এর সম্মান রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে আমাদের অবশ্যই সোচ্চার হওয়া উচিত। আমাদের প্রিয় নবী সা:-এর শিক্ষাগুলোর ওপরও কিছুটা মনোযোগ দেয়া উচিত। আমাদের ভাবা উচিত, আমরা যখন মিথ্যা বলি, ঘুষ নিই, রমজান মাসে মুনাফাখোরি করি, সাম্প্রদায়িকতা ছড়াই এবং অন্যায়-অবিচার করি, তখন কি আমাদের নবী সা:-এর শিক্ষার বিরোধিতা করি না? যদি আমরা আমাদের নবীর শিক্ষার ওপর আমল শুরু করি, তাহলে বিশ্বে কারো নবী অবমাননা করার সাহস হবে না। সবাই ভলতেয়ার ও গ্যেটের মতো আমাদের পেয়ারা নবী সা:-এর গুণগান করবেন।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জংয়ের উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
নাটোরে স্কুলছাত্রকে ডেকে নিয়ে হত্যা, আটক ৪ মেহেদির রঙ শুকানোর আগেই দুর্ঘটনায় তরুণ নিহত ছুটির দিনেও ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর কালিয়াকৈরে ছিনতাইকারীর অস্ত্রের আঘাতে স্বর্ণ ব্যবসায়ী বাবা-ছেলে আহত কাপাসিয়ায় চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত ২ রাশিয়ার ২৬টি ড্রোন ধ্বংসের দাবি ইউক্রেনের উত্তর কোরিয়ার সাথে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র মাগুরায় বজ্রপাতে ২ যুবকের মৃত্যু মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ‘অস্থায়ীভাবে’ ক্ষমতায় রয়েছে : জান্তা প্রধান গাজীপুরে কাভার্ডভ্যানের চাপায় মোটরসাইকেলচালক নিহত উত্তরপ্রদেশে কারাগারে মুসলিম রাজনীতিবিদের মৃত্যু : ছেলের অভিযোগ বিষপ্রয়োগের

সকল