২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মনের পশুত্ব কোরবানি দিই

মনের পশুত্ব কোরবানি দিই - ফাইল ছবি

বছর ঘুরে আবারো এসেছে পবিত্র ঈদুল আজহা। মুসলমানদের জীবনে ঈদুল আজহা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। সামর্থ্যবান মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাদের সামর্থ্য অনুসারে প্রতিটি বছর ঈদুল আজহার দিনে পশু কোরবানি দিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে মুসলমানরা পবিত্রতা অর্জন করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, হাজার বছর ধরে কোরবানির ধারাবাহিকতা পালন করলেও, এর সঠিক তাৎপর্য মুসলমানরা অনুধাবন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। একইভাবে পবিত্র ঈদুল আজহার প্রকৃত মর্ম অনুধাবন এবং তা গ্রহণেও মুসলমানরা ব্যর্থ বলা যায়। আর তাই মুসলিম সমাজে এখনো সত্যিকারের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনো হিংসা, হানাহানি আর অশান্তি বিরাজ করছে। এর প্রকৃত কারণ হচ্ছে আমরা পশু কোরবানি দিলেও আমাদের মনের ভেতরে লুক্কায়িত পশুত্বকে কোরবানি দিতে পারিনি। সুতরাং সত্যিকারের ঈদুল আজহার শিক্ষা কাজে লাগাতে হলে আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানির পাশাপাশি নিজেদের মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা পশুত্বকেও কোরবানি দিতে হবে। তাহলেই কেবল ঈদুল আজহার শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সুন্দর এবং শান্তির সমাজ নির্মাণ সম্ভব।

পবিত্র ঈদুল আজহার ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং এর তাৎপর্য আমরা মুসলমানরা সবাই কমবেশি জানি। কয়েক হাজার বছর আগে মহান আল্লাহ তার প্রিয় নবী হজরত ইবরাহিম আ:কে তার প্রাণপ্রিয় সন্তান হজরত ইসমাঈলকে আ: আল্লাহর নামে কোরবানি করার আদেশ করেন। আল্লাহর এই আদেশের কথা হজরত ইবরাহিম আ: তার সন্তান হজরত ইসমাঈল আ:কে জানানোর সাথে সাথে হজরত ইসমাঈল আ: অত্যন্ত আনন্দচিত্তে তা গ্রহণ করেন এবং স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে নিজেকে আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানের কথা ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী হজরত ইবরাহিম আ: তার পুত্র হজরত ইসমাঈল আ:কে আল্লাহর নামে কোরবানির প্রস্তুতি নিলে আল্লাহ তাদের ওপর অত্যন্ত খুশি হন এবং পুত্র ইসমাঈল আ:-এর পরিবর্তে একটি পশু জবাই করার নির্দেশ দেন। তখন আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী হজরত ইবরাহিম আ: তার প্রাণপ্রিয় সন্তান হজরত ইসমাঈল আ:কে আল্লাহর নামে কোরবানি করা থেকে বিরত থাকেন এবং তার পরিবর্তে একটি পশু জবাই করেন। সেই ঘটনার স্মরণে প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পবিত্র ঈদুল আজহা পালিত হয় এবং মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহর নামে পশু কোরবানি দিয়ে থাকে। এই মাসে পবিত্র হজ পালিত হয় এবং সারা বিশ্বের কয়েক লাখ মুসলমান মক্কায় হজ পালন শেষে পশু কোরবানি দেন। এই হচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহা ও কোরবানির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। সাধারণভাবে কোরবানি শব্দের অর্থ হচ্ছে কোনো কিছু ত্যাগ করা। ইসলামের পরিভাষায় কোরবানি শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে একজন মুসলমান কর্তৃক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় তাঁরই উদ্দেশ্যে কোনো কিছু উৎসর্গ করা।

ইসলাম ধর্ম মতে, আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম, নাজিলকৃত ধর্মগ্রন্থ কুরআন এবং তাঁর প্রেরিত রাসূল সা: প্রদর্শিত গাইডলাইন মোতাবেক যারা এই পৃথিবীতে নিজেদের জীবন পরিচালনা করবে তারা সেই বিচারের দিনে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করবে এবং পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ তাদেরকে চির শান্তির বেহেশতে স্থান দেবেন। অন্যদিকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে যারা চলেনি তারা সেই বিচারের দিনে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভে ব্যর্থ হবে এবং শাস্তিস্বরূপ দোজখে নিক্ষিপ্ত হবে। স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের দৃষ্টিতে এই দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং তা হচ্ছে আখিরাতের শস্যক্ষেত্র। আল্লাহ তার সৃষ্ট জীব মানুষের জন্য এই পৃথিবীতে চলার যেই গাইডলাইন দিয়েছে তার মধ্যে এই কোরবানিও একটি।

কোরবানি মুসলমানদের জীবনে একটি অত্যন্ত আনন্দের দিন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর নামে পশু কোরবানি দেয়া অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। স্বাভাবিকভাবেই কষ্টে উপার্জিত অর্থ ব্যয় করে কোরবানি দিতে পারায় প্রতিটি মুসলমান আনন্দিত হয়। পশু কোরবানি দেয়ায় আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন এটাই প্রতিটি মুসলমান বিশ্বাস করে। ইসলামের নির্দেশ অনুসারে কোরবানির গোশত তিন ভাগ করতে হয়। এক ভাগ গরিব আত্মীয় স্বজন, এক ভাগ গরিব দুস্থদের মধ্যে বিতরণ এবং এক ভাগ নিজের জন্য রাখা যায়। এভাবে প্রত্যেক মুসলমানের ঘরে জবাইকৃত পশুর গোশত রান্না হয় বিধায় সবার ঘরেই আনন্দ থাকে এবং এক ধরনের শান্তি নেমে আসে। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই সেই ত্যাগ, সেই কোরবানি এবং সেই শান্তি আবারো বিদায় নেয়। মুসলিম সমাজে আবারো চলে হিংসা হানাহানি এবং বিদায় নেয় সহমর্মিতা আর ফিরে আসে অশান্তি। এর প্রকৃত কারণ, আমরা কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছি। আল্লাহর পথে পশু কোরবানি হচ্ছে একটি প্রতীক মাত্র। এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, আমরা আমাদের অর্থ-সম্পদ, সময়, শ্রম এমনকি প্রয়োজন হলে নিজেদের জীবনও আল্লাহর পথে উৎসর্গ করব। অর্থাৎ আমাদের সবকিছুই আল্লাহর জন্য এবং তার সন্তুষ্টির জন্য। এর উদাহরণ হিসেবে নির্দিষ্ট দিনে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে আল্লাহর পথে পশু কোরবানি দিলাম। আর প্রয়োজনে সারা বছরই আমরা আমাদের অর্থ, শ্রম, সময়, সম্পদ সবই বিনাদ্বিধায় এবং সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহর নির্ধারিত এবং নির্দেশিত পথে ব্যয় করব। অথচ এই ত্যাগ তিতিক্ষার অনুশীলন আজ মুসলিম সমাজে বিদ্যমান নেই। আমরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারি না। অপরের কল্যাণ করতে আমরা এগিয়ে আসি না। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আমাদের মধ্যে নেই। ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুটতরাজ আজ আমাদের সমাজের নিত্যদিনের চিত্র। বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মুসলিম আজ উদ্বাস্তু। কেউ থাকে অট্টালিকায়, কেউ থাকে বস্তিতে। কারো জীবন কাটে লাগামহীন বিলাসিতায় আর কারো জীবন কাটে ক্ষুধার তাড়নায়। একটি মুসলিম সমাজে বা একটি মুসলিম দেশের দুটি মুসলিম পরিবারের জীবনযাত্রার মধ্যে এতটা পার্থক্য হয় কিভাবে? অর্থ, সম্পদ আর আভিজাত্যের বিচারে দুনিয়ার সব মানুষ কখনোই এক সমান হতে পারবে না এটা নিরেট সত্য। কিন্তু তাই বলে ধনী-গরিবের মাঝখানে এতটা ব্যবধান থাকবে কেন? নিশ্চয় আমরা কোরবানির প্রকৃত শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারিনি।

ঈদুল আজহা আসে, ঈদুল আজহা যায়। কোরবানি আসে, কোরবানি যায়। প্রতি বছর আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গ করা হয়। কিন্তু মুসলিম সমাজে কোনো পরিবর্তন আসে না। ন্যায়বিচার আজ নির্বাসিত। মজলুমের আর্তনাদে মানবতা বিপন্ন। একইভাবে চলছে নারী নির্যাতনের অব্যাহত প্রতিযোগিতা। এখানে এখনো চলছে অন্যায়, অবিচার এবং ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। রাস্তার পাশে, রেললাইনের ধারে অনাহারে-অর্ধাহারে পড়ে থাকা মানুষটির প্রতি আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই না। টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে ব্যর্থ রোগাক্রান্ত মানুষটির দুর্দশা লাঘবে অর্থ ব্যয় করি না। এতিম আর অসহায় শিশুর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই না। আমানত এবং ওয়াদা রক্ষা করছি না। অহরহ এবং প্রতিনিয়তই মিথ্যা কথা বলছি। আমরা কেবল অর্থ, সম্পদ আর আভিজাত্য অর্জনের পেছনে লাগামহীন এক প্রতিযোগিতায় বিরামহীন ছুটছি। এর বাইরে অন্য কোনো দিকে ফিরে তাকানোর যেন সময় নেই। অথচ এসব তো মুসলিম সমাজের চিত্র নয়! আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘তোমরা দুনিয়াবাসীকে রহমত করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।’ (সূরা বাকারা-১৯৫) মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘যার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয়, মানুষের মধ্যে তিনিই উত্তম।’

অথচ মুসলমানদের কাছে এখন মানবসেবাটাই সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে উপেক্ষিত বিষয়। তাহলে কোরবানির শিক্ষা আমরা গ্রহণ করলাম কোথায়? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, কোরবানির শিক্ষা বাস্তবায়নে তাহলে বাধা কোথায়? সম্ভবত, আমাদের ভেতর লুকিয়ে থাকা শয়তানরূপী পশুটাই সত্য ও সুন্দরের পথে পথচলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এই পশুত্বই আমাদের মনের সুকোমল প্রবৃত্তি ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই কোরবানির শিক্ষা গ্রহণ করে সুন্দর সমাজ নির্মাণ করতে হলে আমাদের সবাইকে নিজেদের ভেতরের পশুত্বকে কোরবানি করতে হবে। আমাদের মন থেকে হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, লালসা দূর করতে হবে। গড়তে হবে একটি সুন্দর মন। তাহলেই ঈদুল আজহা পালন সার্থক হবে এবং আল্লাহর উদ্দেশে পশু কোরবানিও সার্থক হবে।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ইমেল : omar ctg123@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement