২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মানববন্ধন যেন জীবনযাপনের ইন্ধন

-

মানুষের অনেক পেশার মধ্যে ওকালতি বা advocacy অন্যতম। মানবসভ্যতা ও সমাজ বিনির্মাণে অবদানের জন্যে এই পেশার জনবল তথা আইনজীবীদের ‘সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ার’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। নিজেকে এই পেশায় প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে তাকে অনেক ধাপ পাড়ি দিতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়টা হলো একজন সিনিয়র আইনজীবীর জুনিয়র বা শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ করা। মূলত অ্যাকাডেমিক জীবন শেষ হওয়ার পরপরই এই apprentice lawyer-এর ভূমিকায় যেতে হয় সবাইকে। বার কাউন্সিল পরীক্ষা পার হওয়ার এটি একটি পূর্বশর্ত। বর্তমানে একজন ‘ল’ ডিগ্রিধারীকে তিনটি পর্ব পাস করে নিম্ন আদালতের আইনজীবী হতে হয়।

একজন আইনজীবী অনেকটা স্বাধীন পেশায় থাকেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে আইনজীবীদের জন্য কোনো আর্থিক সুবিধা তথা বেতন বা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি আইনজীবীদের জন্য মাসিক বেতনভাতার সুযোগ থাকলেও অপরাপর আইনজীবীর আয়-উন্নতি একেবারে সেলফ সার্ভিস ওরিয়েন্টেড। আইনজীবীদের আয়ের প্রধান উৎস হলো মক্কেলের কাছ থেকে সেবার বিনিময়ে আয় করা এবং একজন মক্কেলও পূর্ণরূপে স্বাধীন তার নিজ পছন্দমতো আইনজীবী নিযুক্ত করার ক্ষেত্রে। একজন আইনজীবীর আদালতে প্রতিটি কর্মই তার মক্কেলকে ঘিরে আর মক্কেলের সন্তুষ্টিই হলো তার প্রধান ব্রত।

একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীর যেমন একটি চেম্বার থাকে, তেমনি তার রয়েছে জুনিয়র বা শিক্ষানবিস আইনজীবী। আবার চেম্বার ও তার সমস্ত কার্যক্রম লিপিবদ্ধ করা এবং দাফতরিক শৃঙ্খলা রক্ষার্থে থাকে এক বা একাধিক ক্লার্ক, সাপোর্টার। একজন আইনজীবী যেমনি ভাবেন তার দায়িত্ব পালন করেন মক্কেলের ও কোর্টের প্রতি, তেমনি তার দায়িত্ব রয়েছে তার চেম্বারের অধস্তন জুনিয়র, শিক্ষানবিস ও ক্লার্কের প্রতি। এভাবে ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সাথে তাকে তার পেশাগত জীবন চালিয়ে যেতে হয়। অনেক ব্যস্ততার মাঝেও তাকে চলতে হয় সামাজিকভাবে যেখানে তার রয়েছে অনেক দায়িত্ব। কেউ কেউ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও গঠন করেন তার এই পেশাগত জীবনের পাশাপাশি।

আজ বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত বাংলাদেশ। করোনার প্রথম ছোবলে এ দেশের সবকিছুর সাথে সাথে কোর্ট-কাচারিও বন্ধ হয়ে যায়। এতে স্বাধীন পেশার এই আইনজীবীরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের সাথে জড়িত সবাই। গত বছর প্রথমবারের লকডাউনের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতে এ বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় দফা লকডাউন। সব কোর্ট-কাচারি একেবারেই সীমিত পরিসরে খোলা রাখা হয় কেবল সাংবিধানিক নিয়ম রক্ষার জন্য। ধীরে ধীরে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও কোর্ট-কাচারির জীবনের সাথে জড়িত সব কোর্ট এখনো খুলে না দেয়ায় খুব বিপাকে পড়ে যান আইনজীবীরা। রাষ্ট্র নিযুক্ত ও নিয়োগপ্রাপ্ত উচ্চ আদালতের বিচারপতি ও নিম্ন আদালতের বিচারকরা মাসিক বেতনভুক হলেও একজন আইনজীবী মাসিক বেতনভুক কর্মচারী নন। তাকে তার জীবন ধারণের আয় নিজেকেই করতে হয়। সাথে সাথে তার অধস্তনদের সুবিধা তথা আর্থিক নিরাপত্তাও দিতে হয়। তাই ভার্চুয়াল সীমিত আদালত নিয়ে প্রায় প্রতিদিন দেখা যায় নিয়মিত আদালত করার জন্য মানববন্ধন ও দাবি পেশ করতে। সুপ্রিম কোর্ট বার থেকে শুরু করে প্রতিটি জেলা বারেও এমন দৃশ্য প্রতিনিয়ত চোখে পড়ার মতো। একজন আইনজীবী না পারছেন তার পেশা ছাড়তে, না পারছেন অন্য পেশায় যেতে। এমনি এক অবস্থায় পতিত আইনজীবী মহল।

অপর দিকে ভার্চুয়াল আদালতে রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। আমাদের দেশ ভার্চুয়াল জীবনে এখনো ভালোভাবে অভ্যস্ত নয়। তদুপরি শুধু মামলার শুনানিগুলো ভার্চুয়ালি হলেও মামলার সাথে জড়িত অপরাপর প্রক্রিয়া রয়ে গেছে ম্যানুয়াল। আবার ভার্চুয়াল আদালতে একটি মামলা যতটুকু বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে উত্থাপন করা দরকার তাও সম্ভব হয় না। এ ছাড়াও এমন কার্যপ্রণালীতে রয়েছে নেট দুর্বলতা, সঠিকভাবে শুনানিতে বিপত্তি। সম্মানিত সিনিয়র আইনজীবীরা কোর্ট তথা আমাদের রাষ্ট্রের সম্পদ। আইনাঙ্গনে তাদের রয়েছে উচ্চ মর্যাদা ও কদর। কোর্টের একটা সাধারণ রীতি, প্রথা হলো সিনিয়রদের প্রায়রিটি দেয়া। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল কোর্টে এমনটা করতে গিয়ে দেখা যায়, জুনিয়র আইনজীবীরা সময়ের স্বল্পতায় ও সীমিত পরিসরে সঠিক সুযোগ পান না। কারণ নিয়মিত আদালতে একজন সিনিয়র আইনজীবী সশরীরে অনেকগুলো আদালতে যেতে না পারলেও ভার্চুয়াল আদালতে এক জায়গায় বসে এমন শুনানি ও সুবিধা নেয়ার পরিবেশ একেবারে উন্মুক্ত।

এমতাবস্থায়, আদালতের সাথে সম্পৃক্ত জনবল প্রধানত আইনজীবী শ্রেণীর আর্থিক সঙ্গতি তথা জীবনমান বিবেচনায়, বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি নিরসনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পূর্ণাঙ্গরূপে আদালত খোলার বিকল্প নেই। করোনাহেতু সরাসরি বা নিয়মিত এমন আদালত খোলা সম্ভব না হলে কমপক্ষে সবগুলো আদালত ভার্চুয়ালি খুলে দিলে এবং আদালত ম্যানেজমেন্টের অংশস্বরূপ সব আইনজীবীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হলে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও হয়তো লাঘব হবে। সাথে সাথে ভার্চুয়াল সব আদালত পরিচালনার ম্যানারস একই রকম হলে বিষয়টি আরো সহজবোধ্য হবে সবার কাছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- কোর্ট প্রাঙ্গণে ব্যান্ডউইথ সাপোর্ট বাড়ানোসহ মোবাইল নেটওয়ার্ক উন্নতির উদ্যোগ গ্রহণ করা।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement