২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শেয়ারবাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় ভাটা পড়তে পারে

শেয়ারবাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় ভাটা পড়তে পারে - ছবি : নয়া দিগন্ত

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ৩ জুন জাতীয় সংসদে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বিশাল বাজেট উপস্থাপন করেছেন। প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা নানামুখী আলোচনা করছেন। এই আলোচনার মূল উপজীব্য হচ্ছে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাজেটের সম্ভাব্য প্রভাব। প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনীতির অন্যতম খাত শেয়ারবাজার সম্পর্কে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে যা নিয়ে বিনিয়োগকারী এবং বাজার সংশ্লিষ্টদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। নিকট অতীতে করোনার প্রভাব সত্ত্বেও শেয়ারবাজারে একধরনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছিল। গত ৩ জুন অর্থাৎ বাজেট উপস্থাপনের দিন সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ডিএসই-এক্স সূচক ৩৪ দশমিক ৪২পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে ছয় হাজার ৫৩ দশমিক ৪২ পয়েন্টে উন্নীত হয়।

এটা বিগত ৪০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ সূচক। অন্যান্য সূচক এবং বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ে। বিনিয়োগকারী এবং বাজার সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা ছিল, বাজাটে শেয়ারবাজারের উন্নয়নে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ থাকবে। কিন্তু সেটি পুরোপুরি মেটেনি। যদিও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলি রুবাইয়াতুল ইসলাম প্রস্তাবিত বাজেটকে শেয়ারবাজারের জন্য ‘ভালো বাজেট’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, বাজেটে আমাদের তিন-চারটি চাওয়া ছিল, যার প্রায় সবগুলোই পূরণ হয়েছে। এটা কর্তৃপক্ষীয় বক্তব্য। কিন্তু বিনিয়োগকারী এবং বাজার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য অন্যরকম। তারা বলছেন, বাজেট তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। আরো কিছু করার ছিল। প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাবহির্ভূত উভয়ে শ্রেণীর কর হার আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। বন্ডের কর হার কিছুটা কমানো হয়েছে। সুসুক বন্ড রেজিস্ট্রেশনের সময় দ্বৈত করারোপের ব্যবস্থা রয়েছে। এটা সামান্য কমানো হয়েছে। এক ব্যক্তি কোম্পানির কর হার ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক-বীমার ক্ষেত্রে কর হার ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং তালিকাবহির্র্ভূত ব্যাংক-বীমার ক্ষেত্রে কর হার ৪০ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে।

শেয়ারবাজার সম্পর্কিত যেসব উদ্যোগ প্রস্তাবিত বাজেটে নেয়া হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ তালিকাভুক্ত এবং তালিকাবহির্র্ভূত উভয় শ্রেণীর কোম্পানির কর হার আড়াই শতাংশ কমে কমানো। চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) জন্য বাস্তবায়নাধীন বাজেটে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কর হার ছিল ২৫ শতাংশ। এটা আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজারসংশ্লিষ্টদের, এমনকি বিএসইসির দাবি ছিল এই কর হার আরো কমানো হোক। বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলি রুবাইয়াতুল ইসলাম বলেন, আমাদের দাবি ছিল তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার অন্তত ৫ শতাংশ কমানো হোক। এটা করা হলে বাজারে অধিকতর গতিশীলতা সৃষ্টি হতো। বাজার সংশ্লিষ্টদের দাবি ছিল তালিকাবহির্র্ভূত কোম্পানির কর হার ঠিক রেখে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার আরো বেশি পরিমাণে কমানোর। এতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং তালিকা বহির্ভূত কোম্পানির কর হারের ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেত যা বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ারের উপস্থিতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হতো। এ মুহূর্তে বাজারে ভালো শেয়ারের জোগান বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ এবং বাজারে অংশগ্রহণ ধরে রাখার জন্যই এটা করা প্রয়োজন ছিল। অনেকেই মনে করেন, তালিকাভুক্ত এবং তালিকাবহির্র্ভূত কোম্পানির কর হারের মধ্যে অন্তত ১৫ শতাংশ কর ব্যবধান থাকা উচিত। একক ব্যক্তি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের কর হার কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এটা সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করবে। একই সাথে এসব প্রতিষ্ঠান যাতে বাজারে তালিকাভুক্ত হয় সে বিষয়ে শর্তারোপ করা যায় কি না তা বিবেচনা করা যেতে পারে।

প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ নির্ধারিত হারে ট্যাক্স প্রদান সাপেক্ষে বৈধ করার সুযোগ দেয়া হলেও চলতি বছরের বাজেটে সুযোগটি অবারিত করা হয়নি। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে না।

করোনাকালীন অবস্থাতেও শেয়ারবাজারে নিকট অতীতে যে চাঙ্গা ভাব লক্ষ করা গেছে তার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। মানুষের বিনিয়োগের ক্ষেত্র ক্রমেই সঙ্কুুচিত হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকে টাকা আমানত রাখলে সেখানে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পাওয়া যায়। ব্যাংকগুলোও আমানত গ্রহণে তেমন একটা আগ্রহী নয়। বিদেশ থেকে যারা কর্মচ্যুৎ হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন তাদের অনেকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন। শেয়ারবাজার অনিশ্চিত বিনিয়োগ ক্ষেত্র হলে এখানে মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে হলেও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন। কারণ অধিক মুনাফার সম্ভাবনাময় বিনিয়োগের অন্য কোনো ক্ষেত্র তাদের সামনে খোলা নেই। তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই তারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন। যেহেতু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলে আয়ের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় না তাই কালো টাকা এবং অপ্রদর্শিত অর্থের মালিকদের অনেকেই তাদের অর্থ বৈধ করার জন্য শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে থাকেন। কিন্তু আগামী অর্থবছরের শেয়ারবাজারে কালো টাকা এবং অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ থাকছে না বলে জানা গেছে। যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অপ্রদর্শিত অর্থের বিষয়ে জানতে হলে আগামী জুলাই মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সব দেশেই শেয়ারবাজার অত্যন্ত অনিশ্চিত এবং অস্থিতিশীল একটি বাজার। তাই এখানে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার জন্য বিচারবুদ্ধির প্রয়োজন খুব বেশি। ভালোভাবে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা না থাকলে কেউই শেয়ারবাজারে সাফল্য লাভ করতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী হুজুগে বিনিয়োগ করে থাকে। বাজার সম্পর্কে তাদের জানাশোনা খুব কম। কখন কোন শেয়ার বিক্রি করতে হবে, কখন কোন শেয়ার ধরে রাখতে হবে এ সম্পর্কে তারা জানে না। তারা সাধারণত বন্ধু-বান্ধবের পরামর্শে বিনিয়োগ করে থাকে। যেকোনো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করার আগে সেই কোম্পানির বেসিক তথ্যগুলো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ এবং পরিচালনা পদ্ধতি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে এবং বুঝতে হবে। কারণ দিন শেষে কোম্পানি যে লভ্যাংশ দেবে তা কিন্তু অভিহিত মূল্যের ওপরই দেবে। ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের বাজারমূল্য এক হাজার টাকাও হয় তাহলেও কোনো লাভ নেই। কারণ কোম্পানি যখন ডিভিডেন্ড দেবে তখন তা করা হবে ১০০ টাকার ওপর।

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হচ্ছে বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ারের যথেষ্ট উপস্থিতি নেই। দেশের ভালো এবং সুপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে শেয়ারবাজারে আসতে চায় না। কিন্তু এই মনোভাব কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদ্যোক্তারা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে না। তারা বাজারে কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে প্রয়োজনীয় অর্থের সঙ্কুলান করে। কিন্তু আমাদের দেশে এর উল্টো চিত্র। এ দেশে কেউ শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে চাইলে অর্থায়নের জন্য প্রথমেই ব্যাংকের কাছে ধর্ণা দেয়।

কিন্তু ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে ঋণ দিতে ব্যর্থ হলে তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হয়। এতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে উৎপাদিত পণ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বিপাকে পড়েন। কিন্তু তারা যদি শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করতেন তাহলে খুব সহজেই তা করতে পারতেন। এতে ব্যাংকের ওপরও চাপ কমত। একই সাথে আরো একটি বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন; তা হলো, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া দরকার। এমনকি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোও শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাধীনতার পর এক বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশের সব উৎপাদনযন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ ঠিক বলে প্রতীয়মান হয়নি। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তরের কোনো বিকল্প নেই। একটি প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসান দেবে আর জনগণের ট্যাক্সের অর্থে সেই প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা হবে এটা কোনো যুক্তিতেই খাটে না। আগামীতে ব্যক্তিমালিকানায় যেসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়া হবে তাদের একটি নির্দিষ্টসংখ্যক শেয়ার বাজারে ছাড়ার বিধান রাখা যায় কি না তাও বিবেচনা করা যেতে পারে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতি-বিষয়ক কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement