২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লাক্ষাদ্বীপে মুসলমানদের ওপর ‘গেরুয়া আগ্রাসন’

লাক্ষাদ্বীপ - ছবি সংগৃহীত

এ কথা কারো কাছে গোপন নেই, বিজেপির শাসনামলে প্রদেশের গভর্নর ও প্রশাসকরা সম্পূর্ণ নির্লজ্জতার সাথে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত রয়েছেন। এর সর্বশেষ টাটকা দৃষ্টান্ত লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক প্রফুল্ল­ প্যাটেল। তিনি ৯৭ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত এই দ্বীপে হিন্দু এজেন্ডা বাস্তবায়ন শুরু করে দিয়েছেন। তিনি এই মনোরম দ্বীপের চেহারা পাল্টে দেয়ার জন্য এমন অভিনব পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যার কারণে এই অঞ্চলের মুসলিম পরিচিতিই মুছে যাবে। বিজেপি শাসকদের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও মুসলিমবিদ্বেষ এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে যে, তারা দেশের একমাত্র মুসলিম ইউনিয়ন টেরিটরির (কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল) অধিবাসীদেরও তাদের ধর্মীয় পরিচয় ও সংস্কৃতির সাথে বেঁচে থাকার সুযোগ দিতে চাচ্ছেন না। এই বিজেপি যারা ‘সব কা সাথ আওর সব কা বিকাশ’-সবার সাথে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এবং সবার উন্নয়ন’-এর কথা বলে থাকেন, তারা এই দেশে শুধুই হিন্দুত্ববাদের উন্নয়ন ও আধিপত্যকেই পছন্দ করেন। নতুবা এর কী এমন কারণ রয়েছে যে, লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক নিজের সাংবিধানিক দায়িত্ব ভুলে গিয়ে সেখানে গেরুয়া এজেন্ডা বাস্তবায়নে জিদ ধরে বসে আছেন। তিনি স্থানীয় অধিবাসীদের গণতান্ত্রিক আবিষ্কার ও মানবাধিকারকে পিষে ফেলতে শুরু করেছেন।

বিশ্ব দেখছে, আগে যেখানে গভর্নর ও প্রশাসকরা নীরবে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানে তারা এখন ওই দায়িত্বকে পেছনে ফেলে শাসকদলের সদস্যের মতো কাজ করছেন। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার গভর্নরদের বক্তব্য দেখে মনে হয়, তাদের নিজেদের সাংবিধানিক পদের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। তারা সব লাজলজ্জাকে কোথাও মাটিচাপা দিয়ে রেখেছেন যেন। তাদেরই কাতারে এক নতুন নাম, লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক প্রফুল্ল প্যাটেলও শামিল হয়েছেন যিনি হিন্দুত্ববাদের সূতিকাগার গুজরাট থেকে লাক্ষাদ্বীপ গেছেন। গুজরাটের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রফুল্ল­ প্যাটেলকে এখানে কোন উদ্দেশ্যে প্রশাসক করে পাঠানো হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই।

তবে যে ভঙ্গিতে তিনি ফরমান জারি করছেন, তা থেকে এটা অবশ্যই অনুমান করা যায় যে, তিনি এই ৯৭ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত দ্বীপেও ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ কায়েম করেই ক্ষান্ত হবেন। তিনি স্থানীয় মুসলিম অধিবাসীদের কোণঠাসা করতে এবং তাদের মুসলিম পরিচয় মিটিয়ে দিতে সেই সব প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, যা ফ্যাসিবাদী এজেন্ডার পরিচয় বহন করে। তিনি লাক্ষাদ্বীপের উন্নয়ন ও সেখানে পর্যটন শিল্পের বিকাশের শিরোনামে যে নতুন প্রকল্প প্রণয়ন করেছেন, তার আলোকে এখানে গরু ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা, মদ বিক্রয়ে উৎসাহ প্রদান, পঞ্চায়েত নির্বাচনে দুয়ের অধিক সন্তান গ্রহণকারীর অংশগ্রহণে বাধা, ‘গুণ্ডা অ্যাক্ট’ বাস্তবায়ন এবং জমির মালিকানার স্বার্থকে উপেক্ষা করে কর্তৃপক্ষকে জমি অধিগ্রহণের অধিকার দেয়া হয়েছে। এটা এমন বিধি-বিধান, যা লাক্ষাদ্বীপের শান্তিপ্রিয় অধিবাসীদের মাঝে অস্থিরতার ঝড় বইয়ে দিয়েছে। আর তারা এ ধরনের নিপীড়নমূলক এবং অকাট্য অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কাতারবদ্ধ হচ্ছেন।

এই পদক্ষেপগুলোর কারণে প্রতিবেশী রাজ্য কেরালাতেও কঠিন অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ওখানকার অ্যাসেম্বলিতে এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রস্তাব উপস্থাপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। লাক্ষাদ্বীপে প্রশাসকের অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপসমূহের বিরুদ্ধে কেরালাতেও বিক্ষোভ হচ্ছে। কেরালায় বামপন্থী মুখ্যসচিব পিনারাই বিজয়ন সংবাদদাতাদের বলেন, ‘লাক্ষাদ্বীপ সম্পর্কে আমার প্রদেশেও তীব্র ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। এ জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রশাসকের পদক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে অ্যাসেম্বলিতে রেজুলেশন পাস করা।’ কেরালা অ্যাসেম্বলির স্পিকারের বক্তব্য, ‘লাক্ষাদ্বীপে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত।’
উল্লে­খ্য, প্রশাসকের অগণতান্ত্রিক ও জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে স্বয়ং বিজেপির লাক্ষাদ্বীপ শাখায় বিদ্রোহ হয়েছে। তাদের কয়েকজন সদস্য দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে লিখিত অভিযোগ পাঠানোর পর বিজেপি যুব মোর্চার আটজন সদস্য পদত্যাগের ঘোষণা করেন। প্রফুল্ল প্যাটেলের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারী মনোভাবের অভিযোগ এনে আরো অনেক সদস্য পদত্যাগ করতে পারেন। যুব মোর্চার সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি পি পি মুহাম্মাদ হাশেমের বক্তব্য, ‘আমরা এই দ্বীপের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসন কারো কথাই শুনছেন না। তারা জোর করে নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন।’ তার বক্তব্য, ‘এই আইন লাক্ষাদ্বীপের লোকদের জীবনযাপনে অস্থিরতা ও হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্য আমরা প্রতিবাদস্বরূপ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

কেরালা উপকূল থেকে প্রায় আড়াই শ’ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই মনোরম লাক্ষাদ্বীপের জনসংখ্যা ৬৫ হাজারের কাছাকাছি। এখানে লোকসভার একটি আসনও রয়েছে যেখান থেকে সর্বদা মুসলমান প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে আসছেন। কংগ্রেস নেতা মরহুম পি এম সাঈদ দীর্ঘ দিন এই আসনের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং তিনি কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটেও যোগ দিয়েছিলেন। তার ইন্তেকালের পর তার পুত্র ওই আসন থেকে নির্বাচিত হন। এখন এখানে এনসিপির মুহাম্মাদ ফায়সাল পার্লামেন্ট সদস্য। এ এলাকাকে শান্তিপ্রিয় ও উন্নত ভাবা হতো। কিন্তু বিজেপির মনঃপুত হয়নি যে, এ দেশে এমন কোনো অঞ্চল থাকুক, যেখানকার সব ভোটার মুসলমান হবেন এবং তারা নিজেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে গর্ববোধ করবেন। এ কারণেই শাসকদল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু-কাশ্মিরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার মর্যাদাকে বিলুপ্ত করে তাকে ইউনিয়ন টেরিটরি বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছে। এখন দেশের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল লাক্ষাদ্বীপে অস্থিরতা ছড়ানোর প্রস্তুতি চলছে।

লাক্ষাদ্বীপ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। প্রশাসক এখানকার প্রধান। এখানে সর্বদা কোনো আইএএস (ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস) কর্মকর্তাকে প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু বিগত ডিসেম্বর, ২০২০ সালে গুজরাট বিজেপির অন্যতম নেতা প্রফুল্ল­ খোড়া প্যাটেলকে এখানকার প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়েছে। এখানে তার বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়নের নামে এক নয়া প্রকল্প প্রণয়ন করেছেন তিনি।

এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে ‘লাক্ষাদ্বীপ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি রেগুলেশন’ (এলডিএআর)। এতে গরু জবাই, গরুর গোশত ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। অথচ সবাই জানেন, এখানকার সব নাগরিক (৯৭ শতাংশ) মুসলমান যারা বছরের পর বছর ধরে গরুর গোশত খেয়ে আসছেন। আর এটাই এখানকার জনপ্রিয় খাদ্য। অপর প্রস্তাবটি হচ্ছে- এখানে পর্যটনকে চাঙ্গা করার জন্য মদের দোকান খুলতে হবে। উল্লে­খ্য, এই মুসলিম দ্বীপে, যেখানকার বেশির ভাগ জনগণ ধর্মীয় রীতির অনুসারী, সেখানে কখনোই মদের দোকানের অনুমতি দেয়া হয়নি এবং এখানকার সব অধিবাসীই মদপানের বিরোধী। প্রফল্ল­ প্যাটেল এ প্রস্তাবও দিয়েছেন যে, উন্নয়নের লক্ষ্যে যে কারো জমি অধিগ্রহণ করা যাবে। স্থানীয় অধিবাসীদের আশঙ্কা, এই আইনের আওতায় তাদের জমি ছিনিয়ে নেয়া হবে। অপর এক প্রস্তাব- ওই সব লোককে পঞ্চায়েতি নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা প্রদান করা, যাদের দুইয়ের অধিক সন্তান রয়েছে। এ প্রস্তাব এই বাস্তবতা সত্ত্বেও করা হয়েছে যে, লাক্ষাদ্বীপে জন্মের হার সবচেয়ে কম। এ ছাড়া প্রশাসক প্রফুল্ল­ প্যাটেল এখানে ‘গুণ্ডা আইন’ বাস্তবায়ন করার প্রস্তাবও পেশ করেছেন। এ প্রস্তাব এমন এক এলাকার জন্য করা হয়েছে, যেখানে ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী অপরাধের হার সমগ্র ভারতের মধ্যে সবচেয়ে কম।

এসব প্রস্তাবে ভালোভাবেই অনুমান করা যায়, সব কিছুই করা হচ্ছে এ অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি এবং এখানকার মুসলিম অধিবাসীদের কোণঠাসা করার জন্য। এ কারণেই এখানকার মুসলিম নাগরিকদের মাঝে এ ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের শঙ্কা, প্রফুল্ল­ প্যাটেলের প্রস্তাব এক ব্যাপক পরিকল্পনার অংশবিশেষ যা তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিচিতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ কারণেই চারিদিকে প্রফুল্ল­ প্যাটেলের প্রস্তুতকৃত গেরুয়া খসড়ার নিন্দার ঝড় চলছে এবং অতি দ্রুত এটাকে প্রত্যাহার করার দাবি জোরালো হচ্ছে। বিস্ময়কর হচ্ছে, এ খসড়া প্রণয়নের আগে প্যাটেল স্থানীয় জনগণ তো দূরের কথা, এখানকার জনপ্রতিনিধিদের সাথেও কোনো পরামর্শ করেননি। আর আবশ্যিকভাবে তিনি অগণতান্ত্রিক পন্থায় এখানে তার নিজের গেরুয়া অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সর্বস্তরে এর বিরোধিতা হওয়া উচিত।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ৩০ মে, ২০২১ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement