২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নুরুননাহার ও আমি

নুরুননাহার ও আমি - ফাইল ছবি

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বামপন্থী নেতাকর্মীদের মুক্তিযোদ্ধা হয়েও পাকিস্তান আমলের মতো আত্মগোপনে থাকতে হতো। ভয়ভীতি, শঙ্কার মধ্যে চলাফেরা করতে হতো। এমনই সময়ে নওগাঁর আত্রাইয়ের রসূলপুর গ্রামের নুরুননাহার নামে একটি মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়। কমরেড আবদুল মতিনের জনদরদি কৃষকনেতা মাহতাবের বাড়িতে বিয়ে হয়। বহু দিন যাবৎ জেলে বা আত্মগোপনে থাকায় তখন বহু কমিউনিস্ট নেতার সংসার ভেঙে গেছে, পুত্র-কন্যারা ঠিকমতো লালিত-পালিত হতে পারেনি। ঠিক সেই সময় বাম রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আত্মগোপনকারী এক ব্যক্তির সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হলেন এবাদুর রহমানের ছোট মেয়ে নুরুননাহার। তার বাবা ছিলেন হাইস্কুল শিক্ষক। আমাদের বিয়ে, পূর্ব অনুরাগ বা প্রণয়ঘটিত নয়। শেক্সপিয়রের প্রখ্যাত নাটক ‘দ্য টেম্পেস্ট’-এর কাহিনীর সাথে নুরুননাহারের জীবনের হয়তো মিল পাওয়া যাবে। পিতার সাথে নির্জন দ্বীপের অধিবাসী টেম্পেস্টের মিরান্ডা যখন বড় হলো তখন সে বুঝতে পারল অন্য কোনো পুরুষ তো দূরের কথা কোনো মানুষের চেহারা সে দেখেনি। একদা সমুদ্রের ঝড়ের কবলে থেকে রক্ষা পাওয়া দ্বীপে আশ্রয় গ্রহণকারী রাজপুত্র ফার্ডিনান্ডকে সে দ্বিতীয় পুরুষ হিসেবে দেখতে পায় এবং পরে তার সাথেই বিয়ে হয়। আমাদের উভয়ের পরিবার বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। আমাদের বিয়ের সময় নুরুনের মা’সহ তার সব ভাই ও পরিবারের সবাই কারাগারে বন্দী। তার বড় ভাই কৃষক নেতা ওহিদুর রহমান যিনি পরবর্তীকালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনিও বন্দী। নুরুননাহার বামপন্থী রাজনীতির দুর্ভোগ, দুর্বিষহ কষ্ট যন্ত্রণা ছোটকাল থেকেই দেখেছে। আমার সাথে বিয়েটা সে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে। দাম্পত্য জীবনে আমাদের কোনো আক্ষেপ ছিল না। বিয়ের অনুষ্ঠানে নতুন কাপড় বা গয়নাগাটি দেয়া নেয়ার কোনো আয়োজনও ছিল না। বাড়ির মালিকের ব্যবস্থাপনায় একটি রাজহাঁস জবাই করে সবাইকে আপ্যায়ন করা হয়। খাসি জবাই দিলে জানাজানি হবে, তাতে আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন শঙ্কা ছিলো।

রাজশাহীর বেলদার পাড়ার এক বাড়িতে অবস্থানকালে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। তখন একই শহরে লক্ষ্মীপুরে বড় বোনের বাসায় অবস্থানকারী আমার স্ত্রীকেও একই দিন গ্রেফতার করা হয়। সে কোনো রাজনীতি কিংবা দলের সাথে জড়িত ছিল না, কোনো মামলাও ছিল না।

রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে ও আমার স্ত্রী, এ কারণেই তাকে গ্রেফতার করে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ। তাকে শহরের পবা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত আদালতে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টে সাড়ে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

আমাকে রাজশাহী থেকে ঢাকায়, পরে ময়মনসিংহ জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমাদের এই বন্দী জীবনের মধ্যে একদিন খবর পেলাম আমার স্ত্রী একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তান প্রসব করেছে। এখন কারাগারে বন্দী আমি, আমার স্ত্রী ও সদ্যজাত আমার সন্তান। এসবির লোকজনের মাধ্যমে আমি খবরটি জানতে পারি। ‘ছোট্ট মা-মণি আমার/ খবর পেয়েছি জন্মেছ তুমি/ আমার অসমাপ্ত কাজের মাঝে/ রূপ ধরে স্নেহাশার।’ কবিতাটি আমার লেখা পুস্তকে সঙ্কলিত আছে। ’৭৪-এর শেষের দিকে আমার মা মওলানা ভাসানীর কাছে গেলে তিনি তাকে একটি পত্র লিখে মরহুম গাজীউল হকের কাছে পাঠান। গাজীউল হক সাহেব আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে আমার স্ত্রীকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হন। মুক্তি পেয়ে সে আমাদের নওগাঁর মাস্টার পাড়ার ‘শেষস্মৃতি’ বাসাতেই ওঠে। কিছুদিন পর আমার মা ও স্ত্রী শিশুসন্তানসহ আমাকে দেখার জন্য ময়মনসিংহ শহরে আসে। কিন্তু ডিসি দেখা করার অনুমতি না দেয়ায় তারা আবার নওগাঁয় ফিরে যায়। এই ছিল তখনকার বাংলাদেশ।

’৭৭-এর প্রথম দিকে আমি জেল থেকে ছাড়া পাই। ছাড়া পেয়ে মোহাম্মদ তোহার সাথে দেখা করি, এরপর তার ঐকান্তিক চেষ্টায় আবদুল মতিনসহ আরো অনেক বামপন্থী নেতাকে জেল থেকে বের করতে সক্ষম হই। মরহুম তোহা জেনারেল জিয়ার মাধ্যমে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেন। জিয়া কারাগারে বন্দী প্রায় সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে ছেড়ে দেন। মোহাম্মদ তোহা আতাউর রহমান খানকে উদ্ধৃত করে বলতেন, ‘রাজনীতিতে প্রতিশোধ নীতির কোনো শেষ নেই।’

জিয়াউর রহমান রাজবন্দীদের ব্যাপারে উদার ছিলেন। ’৭৮ সালে বিএনপি গঠিত হলে আমি তাতে যোগ দিই। বিএনপি থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। নির্বাচনী এলাকার জনগণ থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ নেতাসহ সব ধরনের, সব পেশার সরকারি-বেসরকারি সব লোক আমার বাসায় এসেছেন। তাদের সামলে নিতে নুরুননাহারকে কখনো বেগ পেতে হয়নি। কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত না থাকলেও রাজনীতির ঝুট-ঝামেলা, ঝাপটা থেকে সে মুক্ত ছিল না। বামপন্থী রাজনীতির কষ্টের জীবনের দায় তাকে নিতে হয়েছে। ’৯০-এর শেষের দিকে যখন সংসদ সদস্য হিসেবে বারবার গ্রেফতার হই, তখন তাকে কারাগার থেকে আদালতে, আইনজীবীদের চেম্বার থেকে এসবি অফিস, ডিসি অফিস, রাজনৈতিক নেতার বৈঠকখানা থেকে পত্রিকা অফিস সবখানে ছোটাছুটি করতে হয়েছে। তার অবর্তমানে তার মহিমান্বিত সেসব গুণ এখন স্মৃতিপটে একের পর এক ভেসে উঠছে। আমি যখন সরকারের প্রতিমন্ত্রী তখন সে কালেভদ্রে মন্ত্রীর বাসায় থাকত। একজোড়া চটি-স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে সে চলত, কম দামি শাড়ি পরিধান করত, অলঙ্কার ছিল না, পরতও না, তার সাদাসিধে বাহুল্যবর্জিত পরিমিত জীবন। সাধারণ গণপরিবহনেই ঢাকা-নওগাঁসহ সব স্থানে যাতায়াত করত। কখনো কোনোদিন মন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে কোথাও পরিচয় দেয়নি। উপদেশ অনুরোধ কোনো ব্যক্তিকে সে করেনি। সে অবগুণ্ঠনবতী, অন্তঃপুরবাসিনী ছিল না। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় তার সৎসাহস ও চরিত্রের দৃঢ়তা ছিল। সে একা চলতে জানত, ঢাকা থেকে আমেরিকা। আবার আমেরিকা থেকে ঢাকা। তেমনি অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ভারতের ব্যাঙ্গালোরে আসা-যাওয়ার ঝক্কি-ঝামেলাও তাকে একাই পোহাতে হয়েছে।

সেই বিয়ের আসর থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে কারো কাছে কখনো কিছুই চায়নি। কোনো অনুযোগ বা অভিযোগ ছিল না তার। এমন নিরহঙ্কার, স্বল্পভাষী মহিলা একদা নওগাঁ শহরে মাদকবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে মাদকের শহর ‘নওগাঁ বাঁচাও’। তার এই আন্দোলনের ফলে সাধারণ জনগণ তার পেছনে সাহস করে দাঁড়ায়। কিন্তু মাদক সাম্রাজ্যের লোকেরা এ পরিস্থিতিতে চুপ করে বসে থাকেনি। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। স্থানীয় প্রশাসন ওপরে ওপরে তার সাথে থাকলেও ভেতরে ভেতরে তারা সেই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত, এমন খবর আমার কাছে চলে আসে। আমি তাকে এ ব্যাপারে বেশিদূর না এগোতে পরামর্শ দিলাম। সে আমার পরামর্শ গ্রহণ করল।

নুরুননাহার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুখে-দুঃখে, সুদিনে-দুর্দিনে, উত্থান-পতনে আমার জীবনসাথী ছিল। যৌথ জীবনে, ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে আমি অপরাধী। তার আকস্মিক বিদায় যেন আমাকে অভিযুক্ত করে গেল। দাম্পত্য জীবন সফল হয় উভয় পক্ষের সযত্ন প্রচেষ্টায়, নিরলস সাধনায়। আজ আমার মনে পড়ে আমাদের ক্ষুদ্র সংসারে নুরুননাহারের সাধনাই ছিল ঐকান্তিক। আমার এক বন্ধু আজ থেকে ২৬ বছর আগে মন্তব্য করেছেন, ‘চা অনেকেই খাওয়ায় কিন্তু সবাই চা দিতে জানে না, আপনার গৃহের আতিথিয়েতায় আন্তরিকতা আছে, কৃত্তিমতা নেই।’ পল্লী গ্রামের লোকেদের কাছে এই আন্তরিকতাটাই একসময় বেশি সমাদৃত হতো। এখন টাকার ঝনঝনানিতে তা হয়তো ম্লান হয়ে গেছে। তবে কারো মৃত্যুর পর তাকে ঘিরে সব ভালো-মন্দ যেন আবার মূর্ত হয়ে ওঠে। কারো জানাজায় লোক উপচে পড়ে, কারো জানাজায় হাতেগোনা লোক উপস্থিত হয়।

বাগদাদ থেকে আগত নুরুননাহারের মাতৃকুলের পূর্বপুরুষ ‘শেখ গুলবদন শাহ’ তারাটিয়ায় আস্তানা গড়েছিলেন। তারা মানুষকে ধর্মোপদেশ, দান-খয়রাত, বিপদে সাহায্য, অসহায়কে আশ্রয় দান এমন পুণ্যকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করেছিলেন। তাদের মাজার ঘিরে এ দেশে বড় ধরনের ওরস চলে আসছে। নুরুননাহারেরও মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, মাজার নিয়ে কৌতূহল ছিল। এসব জায়গায় যাতায়াত করত, দান-খয়রাত করত, এমনকি তার মৃত্যুও হয়েছে হাইকোর্টের মাজার মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজে। তার মৃত্যুর আকস্মিকতায় সবাই বেদনাহত।

টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিওতে খবর প্রচারিত হতে থাকল আমার মৃত্যু হয়েছে। অবিরাম ফোন আসতে থাকে। ‘আমি বেঁচে আছি, আমার স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে’, এমন উত্তর দেয়া যে বড় কষ্টের নুরুননাহার! পরের দিন নুরুননাহারের লাশ নিয়ে নওগাঁ শহরে পৌঁছালাম। তখন নওগাঁর নওজোয়ান মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। এখানে তার প্রথম জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। চার দিকে এতিম শিশু ও খেটে খাওয়া মানুষের আধিক্য।

বিষয়টি আমার কাছে আশ্চর্য মনে হলো। দলে দলে শিশুরা এসে যখন বলতে লাগল তাদের এতিমখানার কে, কখন নুরুননাহার কর্তৃক উপকৃত হয়েছে। শুনে আমি স্তম্ভিত। ঈদের সময়ে কাপড় পাঠাত; দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়ি চালক একসাথে অনেক নিম্নআয়ের লোককে সে খাবার দিতো। এসব খবর আমার জানা ছিল না। সেখানে আমার কোনো ভূমিকাও ছিল না। আমেরিকায় থাকা তার দুই সন্তানের পাঠানো টাকায় শাহাগোলায় সাড়ে সাত বিঘা জমি কিনে শাশুড়ির নামে সে আয়েশা মসজিদ নির্মাণে হাত দিয়েছিল, এমন খবর কিছুটা হলেও জানতাম। কিন্তু এতিমখানায় বিভিন্ন সময়ে দান করেছে এটা জানা ছিল না। বরিশালের নিভৃত পল্লীতে তার জন্য দোয়া মাহফিলের ছবি ফেসবুকে দেখে বিস্মিত হলাম। ভেতরে ভেতরে জনহিতকর কাজে এই মহিলা এতটা জড়িত ছিল জানতাম না।

লাশ নিয়ে রওনা হলাম আমার পূর্বপুরুষের চকউজির গ্রামে। এখানে সায়েম উদ্দিন মেমোরিয়াল একাডেমি মাঠে দ্বিতীয়বার তার জানাজার নামাজের জন্য লাশ নামানো হয় শোকার্ত অগণিত মানুষের মাঝে। সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ছে। চার দিকে ছড়িয়ে পড়ল গোধূলির সোনালি আভা। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে সবুজ ঘাসের তলে, পলি মাটির নিচে চিরনিদ্রায় শায়িত হলো নুরুননাহার। সে যেন শাহাজাহানকন্যা জাহানারার মতো বলে গেল, ‘বেগায়ের সাজারে না পেষাদে কাশে মাজারে মারা’, সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত থাকবে আমার কবরস্থান; আমার মতো দীন অভাজনের সেই তো শ্রেষ্ঠ আচ্ছাদন। পরের দিন সূর্য উঠল, বাতাস বইল, পাখিসব গাইল, কিন্তু নুরুননাহার আর ফিরে এলো না। আমাদের ছেড়ে চলে গেল সে অনন্তের পথে।

লেখক : রাজনৈতিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক প্রতিমন্ত্রী, বিএনপি নেতা


আরো সংবাদ



premium cement
ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৩৭ বাংলাদেশে নতুন করে বাড়ছে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা হিট অ্যালার্ট নিয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের নতুন বার্তা ভান্ডারিয়ায় পিকআপ চাপায় বৃদ্ধ নিহত হোচট খেল লিভারপুল, পিছিয়ে গেল শিরোপা দৌড়ে যোদ্ধাদের দেখতে প্রকাশ্যে এলেন হামাস নেতা সিনওয়ার! ফের পন্থ ঝড়, ঘরের মাঠে গুজরাটকে হারাল দিল্লি ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র গ্রেফতারের পর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ আরো বেড়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে দুর্নীতি, পুতিনের নির্দেশে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী!  আমেরিকানরা কি ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে?

সকল