২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন : একটি আত্মসমালোচনা

আল্লামা শফী ও বাবুনগরী - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ আন্দোলন-সংগ্রামের দেশ হলেও এখানে অরাজনৈতিক আন্দোলন খুব কমই জমেছে। বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের সামাজিক সংগঠন সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সমাজে প্রভাব ফেলেছে কিন্তু ঝড় তুলতে দেখা যায়নি। তবে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশ ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন আন্দোলন-সংগ্রাম করে দেশের মাটিতে বারবার ঝড় তুলছে। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে তারা তীব্র প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৩ সালের শাহবাগের ‘গণজাগরণ’ মঞ্চবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালে মোদির আগমনবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত তারা অরাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মীয় ও সামাজিক অঙ্গনে বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির সাথে সাথে সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রভাবও সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে খসড়া ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০০৯’-এর সংশোধনের প্রতিবাদে যাত্রা শুরু করলেও ‘হেফাজতে ইসলাম’ আন্দোলন সরবে আত্মপ্রকাশ করেছে ২০১৩ সালে। জামায়াত নেতা আবদুুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় পরিবর্তন করে ফাঁসি দেয়ার দাবিতে কিছু বামপন্থী ছাত্রসংগঠন রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে মঞ্চ তৈরি করে আন্দোলন নামে। এই আন্দোলন সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। রাতারাতি বিভিন্ন সুযোগসন্ধানী সেকুলার গোষ্ঠী এতে জড়িত হয়ে পড়ে।

এমনকি শোনা যায়, ওই আন্দোলন চলাকালে ভারতীয় দূতাবাসে ভিসাপ্রার্থীদেরকে শাহবাগ আন্দোলনের সমর্থক কি না, এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এ দিকে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহযোগিতায় আন্দোলনকারীরা মঞ্চস্থলে তিনবেলা খাবার-দাবার পেয়ে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা শাহবাগে অবস্থান করতে থাকে। এ সময় এই আন্দোলনকারীদের ভূমিকা বামপন্থীদের একটি অংশের প্রভাবে ক্রমেই দেশের ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে চলে যেতে থাকে। কখনো কখনো তা ইসলাম বিদ্বেষের রূপ নেয়। এরই মধ্যে গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনের সংশ্লিষ্ট কিছু ব্লগার ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কিছু আপত্তিকর মন্তব্য প্রকাশ করে। এমনই এক ইসলামবিদ্বেষী চক্রের উত্থানে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। গণজাগরণ মঞ্চের নেতা ইমরান এইচ সরকার অসাধারণ ক্ষমতাধর হয়ে পড়েন। তার নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় পতাকা উত্তোলনের ঘটনাও ঘটে। ইমরান সরকারের এ ধরনের আদেশ-নিষেধে সাধারণ মানুষ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। এমন পটভূমিতে হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান, সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম আল্লামা আহমদ শফী শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধিতায় ময়দানে নামেন এবং এ ধরনের ইসলামবিদ্বেষী অপতৎপরতা রোধে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। শফী হুজুরের ডাকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজ সাড়া দিলে শাহবাগ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। এ দিকে সরকার জামায়াত নেতা আবদুুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়ার রায়ের পথ সুগম করার জন্য সংসদে সংশ্লিষ্ট আইন পরিবর্তন করে। এতে আপাতত শাহবাগ আন্দোলনের যবনিকাপাত ঘটে।

ইসলামের হেফাজত অর্থাৎ বাংলাদেশে ইসলামবিরোধী অপতৎপরতা বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই এই সংগঠনের উদ্ভব হয়েছে বলে জানা যায়। মূলত কওমি মাদরাসাভিত্তিক এই সংগঠনের মূল জনশক্তি মাদরাসার ছাত্ররা হলেও দেশের ইসলামপ্রিয় জনগণের মধ্যে এর ব্যাপক সমর্থন লক্ষ করা যায়। মূল নেতৃত্বে অরাজনৈতিক মাদরাসা শিক্ষকসহ দেশবরেণ্য আলেমরা থাকলেও এতে বিভিন্ন পদে থাকা নেতারা বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে প্রায় সব নেতাই কওমি মাদরাসায় শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। দেশে বেশ কিছু পুরোনো এবং ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা রয়েছে। এসব মাদরাসা থেকে গ্রাজুয়েশন নিয়ে ছাত্ররা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজেরা কওমি মাদরাসা গড়ে তুলেছেন। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই হেফাজতে ইসলামের গণভিত্তি অত্যন্ত মজবুত ও সমাজের গভীরে প্রোথিত রয়েছে। সারা দেশে প্রায় ৪০ হাজারের বেশি কওমি মাদরাসায় অর্ধকোটির বেশি ছাত্র পড়ালেখা করছে। আবার কেবল কুরআন-হাদিসের চর্চা হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই মাদরাসাগুলোর প্রতি ভালোবাসা, সম্মান এবং আস্থা ব্যাপকতার দেখা যায়। ফলে প্রতিটি কওমি মাদরাসা স্থানীয় এলাকাবাসীর আর্থিক ও নৈতিক সমর্থনে চলে থাকে। আর বিভিন্ন বিপদ-আপদে, রোগবালাইয়ের কালে সাধারণ মানুষ ওই সব মাদরাসায় দান-সাদাকাহ করে উপকার ও আত্মতুষ্টি পেয়ে থাকেন। এইভাবে এই মাদরাসাগুলোর শিকড় মানুষের হৃদয়ের অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত রয়েছে।

‘হেফাজতে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার পরই তারা ১৩ দফা দাবি সরকারের কাছে পেশ করে এবং এই দাবিতে ৬ এপ্রিল ২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে লাখো মানুষের সমাবেশ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ঝড় তোলে। দাবি পূরণ না হওয়ায় হেফাজত পুনরায় একমাস পর ৫ মে শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ ডাকে। তবে এই সময় তাদের অরাজনৈতিক অবস্থান ‘হাইজ্যাক’ হয়ে যায়। জাতীয় পার্টি এবং বিএনপি হেফাজতের সমাবেশকে পূর্ণ সমর্থন জানায়। সরকার একে সমূহ বিপদ হিসেবে দেখতে পায়। প্রথম দিকে সরকার দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে। ফলে এক দিকে সমাবেশের অনুমতি দেয় এবং অন্য দিকে সমাবেশস্থলে ঢোকার পথে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে পল্টন এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয় পুলিশের সাথে এবং বেশ কিছু হতাহতের ঘটনাও ঘটে। এ দিকে সমাবেশ শুরু হলেও মূল নেতা আল্লামা শফী অজানা কারণে সমাবেশস্থলে আসতে পারেননি। এতে সমাবেশ হালছাড়া জাহাজের মতো হয়ে পড়ে। কোনো কর্মসূচি বা সিদ্ধান্ত বা দিকনির্দেশনার অভাবে নেতৃত্ব, কর্মীবাহিনী ও সমর্থকরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় রাতের আঁধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং ৬ মে সকালে পুরো শাপলা চত্বর বিরাণভূমিতে পরিণত হয়। এই ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ও সংখ্যা একটি ধোঁয়াশার মধ্যে পড়ে যায়। বিভিন্ন মহল বিভিন্ন সংখ্যা বললেও হেফাজত আনুষ্ঠানিকভাবে আজ পর্যন্ত কোনো পরিসংখ্যান বা সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি এই ঘটনার পর কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিতেও তারা সমর্থ হননি।

পরবর্তীতে বিভিন্ন জাতীয় নেতার যাতায়াত লক্ষ করা যায় হাটহাজারী মাদরাসায় আল্লামা শফী হুজুরের কাছে। এর মধ্যে হুজুরের আত্মীয়দের কেউ কেউ আর্থিকভাবে অনেক লাভবান হয়েছেনও বলে অভিযোগ শোনা যায়। বাস্তবে দেখা গেছে, হেফাজতের আন্দোলন ওখানেই স্তিমিত হয়ে পড়েছে এবং তখন থেকে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সাথে হেফাজতের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চলমান ছিল। ইতোমধ্যে ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে আইন পাস করে কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর ‘দাওরায়ে হাদিস’ ডিগ্রিকে স্নাতকোত্তর সমমান দেয়া হয়। যার পরিণতিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিশাল ‘শোকরানা মাহফিলে’ প্রধানমন্ত্রীকে কওমি জননী উপাধি দেয়া হয়, কিন্তু শফী হুজুরের ইন্তেকালের পর হেফাজতের সরকারবিরোধী অংশ নেতৃত্বে চলে আসে। ৫ মের পর গ্রেফতার হওয়া তৎকালীন মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী নতুন আমির নির্বাচিত হওয়ার পরপরই হেফাজতে ইসলাম মনে হয় খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কার্যবিরোধী আন্দোলন।

এই আন্দোলনে মাওলানা মামুনুল হক রাতারাতি হেফাজতের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে যান। তিনি তার স্বভাবসুলভ জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে আন্দোলনকে শানিত করে তোলেন এবং কমী-সমর্থকদের কলিজায় যেন জ্বালা ধরিয়ে দেন। তবে কিছু দিনের ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনে সমগ্র দেশকে উত্তপ্ত করে হঠাৎ যেন অগ্নি নির্বাপিত হয়ে যায়। হেফাজতের প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করার পর এ ব্যাপারে তাদেরকে আর সরব হতে দেখা যায়নি।

তবে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে সাংস্কৃতিকভাবে দেশ দু’টি ধারায় ভাগ হয়ে যায়। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং সরকার সমর্থিত জনতা হেফাজতের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়ে। ইতোমধ্যে সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশের নেতৃত্বে হেফাজত বিরোধিতা চরম আকার ধারণ করে। অন্য দিকে ভাস্কর্যের বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী এবং দেশদ্রোহী বলে দাবি ওঠে, যদিও হেফাজত নেতারা নিজেরা প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাশীল বলে দাবি করেছেন। অর্থাৎ হেফাজতের এই অদূরদর্শী আন্দোলন পুরো ইসলামী সংস্কৃতিকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। এই আন্দোলনের আরো একটি বিষবাষ্প দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে দেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যের ধারক ‘ওয়াজ মাহফিলগুলোতে’ হাঙ্গামা শুরু হয়ে যায়। ওয়াজ মাহফিলের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি সংবলিত নিয়ন্ত্রণ, ওয়াজ চলার সময়ে স্থানীয় সেকুলার নেতাদের বাধাদান, আলেমদের প্রকাশ্যে স্টেজে উঠে গালাগাল করা, হামলা করে প্যান্ডেল ভেঙে দেয়া ইত্যাদি ছিল এই ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া।

হেফাজতের আন্দোলনের সর্বশেষ ঢেউ জাতি দেখতে পায় গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত জাতীয় অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। গত ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে জুমার নামাজের পর হেফাজতের আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি না থাকলেও উপস্থিত মুসল্লিরা স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ করতে চাইলে পুলিশ ও লাঠিসোটাধারী একদল মারমুখী গোষ্ঠীর সাথে সংঘর্ষ বাধে। এতে প্রায় ৬০ জন মুসল্লি আহত হন। সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্ররা স্থানীয় জনতাকে নিয়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল বের করলে সেখানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে চারজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। পরদিন ২৭ মার্চ হেফাজতের বিক্ষোভ দিবস চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইউনুসিয়া মাদরাসার ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন নিহত হন। পরদিন ২৮ মার্চ হেফাজতের সকাল-সন্ধ্যা হরতালে পুনরায় সংঘর্ষে আরো কয়েকজন ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এই সংঘর্ষ চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন সরকারি ও সাংস্কৃতিক স্থাপনায় ধ্বংসলীলা চালানো হয়। হেফাজত দৃঢ়ভাবে এই ধ্বংসযজ্ঞের দায়ভার অস্বীকার করলেও বিভিন্ন মিডিয়া এটাকে হেফাজতের তাণ্ডব বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে এই তিন দিনে হেফাজতের ১৭ থেকে ২১ জন কর্মী-সমর্থক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলেও সে ব্যাপারে কিছু ইলেকট্র্রনিক মিডিয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য বা বার্তা ছিল না।

তবে এই আন্দোলন নিয়ে তোলপাড় হয়তো বা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, যদি না হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হক সোনারগাঁওয়ের রয়েল রিসোর্টের ঘটনায় জড়িয়ে না যেতেন। তিনি সেখানে তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে ব্যাপারে সন্দেহ না থাকলেও তার এই পুরো ব্যাপারটি দেশের ইসলামদরদি জনগণকে হতাশ করেছে। হোটেলে দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম প্রথম স্ত্রীর নামে লেখানো, দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি অত্যন্ত সীমিত আকারে প্রকাশমান রাখা, একের পর এক কলরেকর্ড ফাঁস হওয়া এবং সারা দেশের হেফাজত কর্মী-সমর্থকরা যখন শোকাভিভূত তখন স্ত্রীসহ অবকাশ যাপনে যাওয়া কোনোভাবেই ইসলামী নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। এই কাজগুলো কতটুকু রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহর সাথে মানায় তা বিবেচনায় রাখার দাবি রাখে। এসব ঘটনায় শুধু হেফাজতে ইসলাম নয়; পুরো ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে একটি বিরূপ ভাবমর্যাদা সৃষ্টি হয়েছে বা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর কথিত সেকুলার গোষ্ঠী এর পুরো ফসল ঘরে তুলছে। মামুনুল হক লাইভে এসে কয়েকবার বক্তব্য দেয়াতে জটিলতা আরো বেড়েছে যা এই মাপের একজন নেতার পরিপূর্ণ অপরিপক্বতার পরিচয় উপস্থাপন করেছে।

ফলে দল হিসেবে হেফাজত একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, অন্য দিকে অজস্র নেতাকর্মী-সমর্থক দারুণভাবে হতাশায় ভুগছেন। স্বাভাবিকভাবেই সরকার এই পরিস্থিতির ফসল পুরোটা ঘরে তুলতে চাইবে। গত কয়েক দিনে হেফাজতের ২২ জন কেন্দ্রীয় নেতা বিভিন্ন নতুন ও পুরাতন মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামে প্রায় তিন শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। এমতাবস্থায় আল্লামা বাবুনগরী হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে হেফাজতের কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন। বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় নেতাকে জেলহাজতে রেখে হঠাৎ তিনি কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। প্রথম আলো পত্রিকায় গত ২৭ এপ্রিলের রিপোর্ট পড়ে মনে হয় পরিকল্পিত চাপের মুখেই বাবুনগরী এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। শফী হুজুরের ছেলে আনাস মাদানির নেতৃত্বে সরকারের পছন্দের অংশ সক্রিয় হয়ে উঠছে। সচেতন মহলের ধারণা, এমনই সন্ধিক্ষণে হেফাজতের নেতৃত্ব ছিনতাই কবলিত হয়ে পড়েছে।

এহেন পরিস্থিতিতে এখন সময় এসেছে হেফাজতে ইসলামের আত্মসমালোচনা করার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- ৫ মের শাপলা চত্বরের ঘটনার বিন্দুমাত্র শিক্ষাও তারা নেননি। আত্মপ্রকাশের পর থেকে অদ্যাবধি, তারা সুনির্দিষ্ট মিশন ঠিক করতে পারেননি। সেই সাথে তাদের কাঠামোগত ভয়াবহ দুর্বলতা রয়ে গেছে। মাদরাসার ছাত্রদেরকে রেডিমেট কর্মীবাহিনী হিসেবে পাওয়ায় তাদেরকে অসাবধানতার সাথে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর কাঠামোর দুর্বলতার কারণে বিভিন্ন ইস্যুতে সুপরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট পন্থায় আন্দোলন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে প্রতিটি আন্দোলন ধ্বংসাত্মকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে অথবা নীরবে মুখ থুবড়ে পড়ছে। আন্দোলনের শুরুতেই তারা রাজপথে নেমে যাচ্ছেন; অপরিপক্ব নেতারা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে মাঠ গরম করছেন; কর্মী-সমর্থকদের বিভ্রান্ত করছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের সামর্থ্যরে চেয়েও বেশি ওজনের বক্তব্য রাখছেন। এই ধরনের অরাজনৈতিক আন্দোলনের প্রথম পর্যায় হলো, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে বসে তাদেরকে ইস্যুটির কানসার্নগুলো জানানো, বুঝানো। তা না করে সহসাই হুমকি-ধমকি দিলে আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপটিই উপেক্ষিত হয়ে পড়ে। হেফাজত আন্দোলনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো অদূরদর্শিতা। শুরু থেকে প্রতিটি আন্দোলনেই নেতাদের দূরদর্শিতায় ভয়াবহ দুর্বলতা দেখা গেছে।

আন্দোলনটাকে তারা কিভাবে সফল করতে চান, এটা কোথায় গিয়ে শেষ হতে পারে, আন্দোলনের বিভিন্ন ধাপে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এবং তার প্রতিবিধান কিভাবে হবে ইত্যাদি বিষয়ে কোনো ধরনের হোমওয়ার্ক ছাড়াই তারা চূড়ান্ত আন্দোলনে নেমে পড়ছেন। পরিণতিতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা দুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। তারা মুখে বলছেন, বর্তমান সরকার শতবর্ষ ক্ষমতায় থাকুক কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু তাদের আন্দোলনের বডি-ল্যাঙ্গুয়েজকে সরকার হুমকি হিসেবে দেখছে। কাজেই সংগঠন অরাজনৈতিক হলেও আন্দোলনগুলো রাজনৈতিক হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য পূর্ণাঙ্গ ইসলামের কথা বলতে হলে সেখানে রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবীভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। কাজেই অরাজনৈতিক আন্দোলনের কথা বললে সরকারকে কনফিডেন্সে নিয়েই আন্দোলন করতে হবে। এই জন্য যে অভিজ্ঞতা দরকার তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে হেফাজতের নেতৃত্বের মধ্যে। ওয়াজ মাহফিল বা অন্যান্য সমাবেশে শ্রোতার লম্প-জম্ফ দেখে পুরো দেশকে বিবেচনা করলে ভুল হবে। সেখানে অবশ্যই সচেতনতার সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক কথা বলতে হবে। গরম করা মেঠো বক্তৃতা আর গঠনমূলক আন্দোলনের পার্থক্য বুঝতে হবে। আর নেতাদের সবাইকেই ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যে পুরোপুরি স্বচ্ছতা অর্জন করতে হবে যেমনটি ছিলেন নবী মুহাম্মদ সা:। কারণ ঐতিহাসিকভাবেই ইসলামী আন্দোলন অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সামান্য কাদার ছোঁয়া পুরো আন্দোলনকেই কর্দমাক্ত করে তোলে।

হেফাজত নেতাদেরকে আরো একটি বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। সামগ্রিকভাবে মিডিয়া কেন তাদের ব্যাপারে বৈরী হয়ে গেল? সমস্যাটা কোথায়? মাঝে-মধ্যে প্রতীয়মান হয়, মিডিয়া যেন হেফাজতে ইসলামের প্রতিপক্ষ। এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। তাদেরকে হয়তো হেফাজত নিজেদেরকে পরিষ্কার করে বোঝাতে পারেননি। তারা কি ভুল বুঝছেন নাকি হেফাজত ভুল পথে আছে, সেটা পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সাথে বসতে হবে। তাদেরকে নিজেদের মিশন, কর্মপদ্ধতি, গন্তব্য, উদ্দেশ্য, সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি বুঝাতে হবে। সর্বোপরি, মিডিয়া সংশ্লিষ্টদের সামনে ইসলামের সুমহান চিত্র পুরোপুরি সফলভাবে তুলে ধরতে হবে।

‘হিকমাহ’ বা কৌশল ইসলামী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রাসূল সা: সারাটি জীবন এই ‘হিকমাহ’ মোতাবেক আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। ব্যক্তিগত দাওয়াত থেকে শুরু করে যুদ্ধের ময়দান এবং আন্তরাষ্ট্রীয় বিষয়াদি পর্যন্ত পদে পদে সতর্ক কৌশল অবলম্বন করেছেন। তার আন্দোলনী জীবনের পুরো ২৩টি বছরই তিনি বৈরী পরিবেশে কাজ করেছেন। কাজেই হেফাজতকেও কৌশল বা ‘হিকমাহ’ অবলম্বন করতে হবে। সুতরাং রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে সরকারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়াটা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। ওয়াজ মাহফিলগুলোতে কৌশলে দ্বীনের কথা বলুন এবং বিশুদ্ধ দ্বীনের পক্ষে জনমত গঠন করুন। উগ্র ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে শ্রোতা-জনতাকে ক্ষণিকের জন্য উত্তেজিত করা যায়। কিন্তু সুদূরপ্রসারী ও টেকসই আন্দোলনের জন্য তৈরি করা যায় না। কাজেই এগুলো পরিহার করা দরকার। সাম্প্রতিককালের এসব অদূরদর্শী এবং অপরিপক্ব তৎপরতার জন্যই আজ পুরো কওমি মাদরাসার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ চলে এসেছে। গত বছরের করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় যখন দেশজুড়ে মাদরাসাগুলোতে কুরআন-হাদিসের চর্চা অব্যাহত ছিল, আজকে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় দেশ ও জাতি সেই অব্যাহত কুরআন-হাদিস চর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে দেশের ওপর আল্লাহর গজব তীব্রতরভাবে আপতিত হতে পারে। বুঝতে হবে, আজকাল প্রতিবাদ-বিক্ষোভ আন্দোলনকে সহিংসতার মাধ্যমে হাইজ্যাক করা হয় বা স্যাবোটাজ করা হয়। যেকোনো হরতাল প্রতিবাদের সময় তৃতীয় কোনো সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ধ্বংসযজ্ঞ করে তার দায় প্রতিবাদকারীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর সন্ত্রাসী তকমা বেঁধে দেয়। এই কৌশল না বুঝলে ভীষণ বোকামি হবে।

আজকে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ‘হেফাজতে ইসলাম আন্দোলন’কে সুনির্ধারিত লক্ষ্য, মিশন, কর্মপদ্ধতি, সুসংগঠিত কাঠামো এবং কৌশল ঠিক করতে হবে। আর নীতি-নৈতিকতা, ইসলামের সুমহান আদর্শ, মূল্যবোধ এবং স্পিরিটকে কোনোভাবেই বিসর্জন না দিয়ে নমনীয় অথচ ইস্পাত দৃঢ় কৌশল নির্ধারণ করে ইসলামকে হেফাজতের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে দেশের ইসলামপ্রিয় জনতাকে সঙ্গে নিয়ে ইসলামী মূল্যবোধকে সংরক্ষণ বা হেফাজত করা সম্ভব হতে পারে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

Email: maksud2648@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement