১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মতুয়া প্রসঙ্গ

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মতুয়া প্রসঙ্গ - ফাইল ছবি

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের মাসাধিককাল পরও একটা শ্রেণীর ধারণা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন যতটা না আমাদের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগদান, তার চেয়ে বেশি এই দেশের একটি সম্প্রদায়ের একটা বিশেষ জায়গায় গমন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন এ দেশে এসেছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গে বিধান সভার ভোট শুরু হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি অতি জটিল; সর্বসাধারণের জ্ঞাত নয়। ফলে সাধারণভাবে মনে করা যেতে পারে, মোদি হয়তো ‘এক-ঢিলে দুই পাখি’ শিকার করেছেন। কিংবা দুটি উদ্দেশ্যের মিলে যাওয়া কাকতালীয়- এইভাবে ভেবে নেয়া শ্রেয়; এটা মেনে নেয়া কঠিন যে, আমাদের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের চেয়ে মতুয়াদের এলাকায় যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মোদি এবারই এ দেশে এসেছেন এমন নয়- তাহলে এই সময়ে ওই বিশেষ এলাকায় উড়ে যাওয়ার মাহাত্ম্য কী? পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে এবার প্রধানমন্ত্রী মোদির দল বিজেপির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতার তৃণমূলের মহারণ। অন্য জোটটির একাংশ প্রায় ক্ষয়ে যাওয়ার উপক্রম। একটি অংশের তিন দশকের ভুল-ভ্রান্তি কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা। আর জোটের নতুন দলের অবস্থা ‘পরীক্ষা প্রার্থনীয়’র মতো। ফলে বঙ্গ-নির্বাচনে তৃণমূলের ক্ষমতা ধরে রাখা আর বিজেপি বাংলা দখলের জন্য মরিয়া-এটাই এবারের নির্বাচনের রসায়ন। ‘সংযুক্ত মোর্চা’ হয়তো এই যুযুধানে একটু পিছিয়েই থাকবে।

মোদির বাংলাদেশ সফর, বিশেষত, মতুয়া অঞ্চলে সফর নিয়ে খোদ তৃণমূল প্রধান অনেক বেশি সোচ্চার। মমতা ব্যানার্জি একাধিকবার এই সফরকে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন এবং নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা নিতেও বলেছেন। তবে কমিশন বিষয়টিকে আমলে নিয়েছে বলে কিছু লক্ষণীয় নয়। মমতার চড়া সুরের কারণে এ কথার মান্যতা দিতেই হবে যে, মোদির ওই বিশেষ জায়গা সফরের মধ্যে এমন কিছু কারিশমা কিংবা কেমিস্ট্রি নিশ্চয়ই আছে, যা চলতি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। অন্যথায় খোদ মমতা এই নিয়ে কথা বলতেন না। ভারত হরেক জাতের মানুষের দেশ। জাতপাত ভারতে নতুন কিছু না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত থাকলেও নির্বাচনে এসবের প্রভাব ছিল না তেমন। কিন্তু গত দুটো নির্বাচনে বঙ্গে জাতপাত প্রাসঙ্গিক ছিল। এবার উঠে এসেছে, মতুয়ারা কোন দিকে যাবে? মমতার দলের প্রধান কথা, বাংলা বাঁচাও। কেন? তৃণমূল মনে করে, বিজেপি হিন্দুত্ব কায়েম করতে চায়। ওখানে কিছু বুদ্ধিজীবী লিখছেন, ‘বাঙালিয়ানা আর হিন্দুত্ব পরস্পরবিরোধী; বিজেপি বাংলার ক্ষমতায় আসতে পারলে বাঙালিয়ানা বদলে হিন্দুত্ব প্রাধান্য পাবে; তাতে মানুষে মানুষে যে-সম্প্রীতি ছিল সেটা ভেঙে পড়বে।’ বিজেপি এসব অস্বীকার করে চলছে।

বাম জমানায় শ্রেণীভিত্তিক উন্নয়ন নীতি এবং সমাজের জাতপাতের ব্যাপারটি অনেকাংশে চাপাই ছিল। কিন্তু জাতপাতের ভিত্তিতে সামাজিক বৈষম্য, নিম্নবর্ণের সামাজিক সম্মানের প্রশ্ন এবং জাতিসংগঠনের আবেদন অদৃশ্য হয়ে যায়নি। এসবই এবারের নির্বাচনে ফিরে এসেছে; কেউ আবার উসকে দিচ্ছে। এবার মতুয়া সম্প্রদায়ের মেরুকরণে বোঝা যাবে, পার্টি সোসাইটি ছেড়ে বাঙালি কি কাস্ট পলিটিক্সে ঝুঁকবে!

একটু ফিরে তাকালে দেখি, মতুয়ারা সংগঠিত। এঁদের টিকে থাকার মধ্যে জাতপাতের ধারণাটি খুবই প্রবল। সাতচল্লিশের বেদনালিপ্ত ইতিহাসও আছে তাদের সামনে। ফলে কেবলমাত্র জাতপাতের রাজনীতির মধ্যে আটকে না থেকে ঐতিহাসিক পর্যালোচনার দরকার আছে। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘মতুয়া কোনো বিশেষ জাতির বা কাস্টের নাম নয়। এটি একটি ধর্মীয় এবং সামাজিক আন্দোলন, যা শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের শেষে মূলত পূর্ববঙ্গের নমশূদ্র ও অন্যান্য নিম্নবর্গীয় কৃষক স¤প্রদায়ের মধ্যে।’

আমরা এও জানি, শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর এটি শুরু করেছেন; তারই পুত্র শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর সংগঠিত করেন এই গোষ্ঠীকে। শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বেই ফরিদপুরের ওঁড়াকান্দি গ্রাম মতুয়া তথা বঙ্গীয় দলিত আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি হয়ে ওঠে। শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর মূলত ব্রাহ্মণ্যআধিপত্য ও আচারনিষ্ঠ বৈদিক হিন্দু ধর্ম থেকে নিম্নবর্গের কৃষকদের বিশ্বমানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। নমশূদ্র ছাড়াও অনেক দলিত-অদলিত স¤প্রদায় এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল সে-সময়ে। আদতে শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর ধর্মীয় আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষকদের শিক্ষিত ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় বলীয়ান দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু গান্ধীজির স্বদেশি ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে তারা দূরে অবস্থান করেছেন।

কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের বিরোধও ছিল স্পষ্ট। ১৯৩৫-এ ভারতীয় আইন সভায় তাদের জন্য আসন সংরক্ষিত হয় এবং মতুয়াদের কেউ কেউ নির্দলীয় প্রার্থী হিসাবে বাংলায় নির্বাচিত হন- এর মধ্যে গুরুচাঁদ ঠাকুরের পুত্র প্রমথরঞ্জন ঠাকুরও ছিলেন। বস্তুত, এই গ্রুপের সমর্থনের অভাবেই ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস অবিভক্ত বাংলায় সরকার গঠন করতে পারেনি। তবে দেশভাগের রাজনীতিতে এই মতুয়া জোট ভেঙে যায়। প্রমথরঞ্জনের নেতৃত্বে বড় গ্রæপটি কংগ্রেসের বাংলা ভাগকে সমর্থন দেয়। অন্য দিকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মুসলিম লীগকে সমর্থন দেন।

র‌্যাডক্লিফ মিশন হিন্দু-মুসলমান কারো দাবিই সে-অর্থে পূরণ করেনি। ফলে নমশূদ্র এলাকা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পড়ে যায়। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল থেকে যেতে চাইলেও ১৯৫০-এর পর মণ্ডল নিজেও চলে যান, সঙ্গে হাজার হাজার নমশূদ্র কৃষক। কিন্তু ভারতে গিয়ে এই শ্রেণীর কপালে ভালো কিছু জোটেনি। প্রথমত কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ- এদের দেখা হয় ‘অর্থনীতির বোঝা’ হিসাবে। ফলে জায়গা হয় নানা ক্যাম্পে। আরো পরে, পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আন্দামান; যার মানেই হলো, দণ্ডকারণ্যের গভীর জঙ্গল। আর কিছু চলে গেল উত্তর ২৪ পরগনা আর নদীয়ায়। পুনর্বাসন আর নাগরিকত্ব হয়ে গেল প্রধান সমস্যা। যোগেন মণ্ডল এবং প্রমথরঞ্জন ঠাকুর দু’জনই উদ্বাস্তুদের এই দিকে মনোনিবেশ করলেন। আবার প্রমথরঞ্জন ঠাকুর কংগ্রেসের ওপর আস্থা হারিয়ে ১৯৬৪ সালে কংগ্রেস ছেড়ে বাবা-দাদার আদর্শের সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে তৎপর হলেন।

অটল বিহারি বাজপেয়ির ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইনের মূল কথা ছিল, নাগরিকত্ব পেতে ১৯৭১ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করা জরুরি। কনসেপ্ট ছিল, ’৭১-এর পর যারা এসেছে তারা মূলত মুসলিম। কিন্তু হলো উল্টো। মতুয়ারা ’৭১ পূর্ব বিভিন্ন সময়ে ভারতে প্রবেশ করলেও কোনো কাগজই আর হাতে নেই। দীর্ঘদিন বসবাস করার পর প্রমাণ করা কঠিন যে, তারা ’৭১-এর আগেই এসেছেন। নাগরিকত্ব পেতে মতুয়া নেতারা ২০০৯ থেকে মূল স্রোতের রাজনীতিতে আসতে শুরু করলেন- রাজনৈতিক আনুক‚ল্য ছাড়া নাগরিকত্বের সমাধান সম্ভব নয়, এই ধারণা থেকে। তখন থেকেই বামদল এবং তৃণমূল মতুয়া সমর্থন পেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ২০১১-এর নির্বাচনে এই সমর্থন গেল তৃণমূলের ঝুড়িতে। এখানেই বিজেপির আগমন- ‘২০২১ সালে বাংলার দখল চাই’। ২০০৩ সালে বাজপেয়ির সমস্যার ২০১৯-এ মোদি সরকার এক-সমাধান সূত্র বের করে মতুয়াদের কাছে টানতে চাইছে। ফলে উনিশের লোকসভা নির্বাচনে মতুয়াদের দলে টানতে সক্ষমও হলো বিজেপি। সেটাই ধরে রেখে ২০২১-এ বাংলার দখল চাইছে বিজেপি। হয়তো সেজন্যই রাজধানী ঢাকা ছেড়ে মোদির এই ছুটাছুটি।

অসমে নাগরিকত্ব আইনে মানুষের যন্ত্রণা বেড়েছে। মনে করা হয়েছিল, মুসলিম এবং বাঙালি মুসলিমদের ভারতছাড়া করা যাবে। হলো উল্টোটা। লাখ লাখ হিন্দু-বাঙালি এই আইনে আটকে গেল-লেজে গোবর মাখিয়ে আইনের কার্র্যক্রমই বন্ধ এখন। আর ২০১৯-এ প্রতিশ্রুতি দিলেও পশ্চিমবঙ্গের জন্য এখনতক কোনো আইন করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্য বিজেপি বলছে, রাজ্য সরকার গঠন করেই নাগরিকত্ব আইন তৈরি করা হবে; যদিও এই কাজ রাজ্য সরকারের নয়। আইন করলেই কী! ৫০-৬০-৭০ বছর একটা দেশে বসবাস করে, ভোটাধিকার প্রয়োগ করেও প্রমাণ দিতে হবে ১৯৭১-এর আগে তারা ভারত এসেছিলেন। কী প্রমাণ আছে ওঁদের কাছে? সুতরাং ঝুলন্ত মুলার দিকে চেয়ে থাকা।

পশ্চিমবঙ্গে শতকরা ২৭ ভাগ মুসলিম ভোটার। কম-বেশি ষাটটি আসনের ভাগ্য সরাসরি নির্ধারিত হয় এই মুসলিম ভোটে; অ-প্রত্যক্ষভাবে আরো সত্তর-আশিটি এই ভোটে প্রভাবিত। এমনিতর ত্রিশটি বিধান সভার আসনের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট। ভোটের রাজনীতি এখানেই। বিজেপির লক্ষ্য, এই ত্রিশটি এককভাবে জিতে আসা। ফলে মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুর জন্মভূমিতে মোদির সফর গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ওঁড়াকান্দি মতুয়াদের কাছে অনেক বেশি সম্মানের স্থান। খানিক সমস্যা এই যে, মতুয়ারা বরাবরই ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য ও বৈদিক হিন্দু ধর্মের বিরোধী। মূলত তারা একটি সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনে বিশ্বাসী- এই ধারণা আবার বিজেপির রাজনীতির সঙ্গে যায় না।

নির্বাচনে মতুয়ারা একটি দলকেই সমর্থন করবেন, এমন মনে করার কারণ নেই। তাদের সামনেই রয়েছে অসমের পরিস্থিতি; কাগজের অভাবে তাদেরও এমন অবস্থা মোকাবেলা করতে হবে। ফলে বিজেপি যেভাবে চাইছে, সেই সমর্থন এককভাবে মিলবে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, মতুয়ারা আগের মতো ঐক্যবদ্ধ নেই, নেই একক কোনো নেতা- সেই ঠাকুর পরিবারই দ্বিধাবিভক্ত; সেটা রাজনৈকিকভাবেও। একটি গ্রুপ আবার দলিত সাহিত্য একাডেমি করেছে- এদের কর্ণধার তৃণমূলের প্রার্থী এবারে (বলাগড় কেন্দ্র)। দলিত সাহিত্যের আরেক পথিকৃৎ মোর্চার প্রার্থী (গাইগাটা কেন্দ্র)। সুতরাং ভোট তো ভাগ হয়েই যাচ্ছে। ২০১১ কিংবা ২০১৯-এর অবস্থা যে আর বর্তমানে নেই, সেটাই মতুয়া প্রধান এলাকায় পরিদৃষ্ট হবে। সেজন্য ২ মে দুপুর অবধি অপেক্ষা করা জরুরি। দেখার বিষয়, মতুয়ারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওঁড়াকান্দি সফর কিংবা নাগরিকত্বের ঝুলন্ত মুলা খাবে, না নিজেদের মধ্যকার রাজনৈতিক মেরুকরণে ঝুঁকবে অথবা বাংলাকে বাংলা রাখার জন্য মমতার উন্নয়নের দিকে যাবে- দেখাই যাক। অপেক্ষা সেই ২ মে পর্যন্ত।


আরো সংবাদ



premium cement