২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলা নববর্ষ ও মনুবাদ

-

এক.
প্রথম কথাটি হলো বাংলা সনের জন্মসূত্র। ইতিহাস বলে, বাংলা সন হিজরি সনেরই বিবর্তিত রূপ। সবাই জানেন হিজরি সন চান্দ্রবর্ষ। সৌরবর্ষের চেয়ে চান্দ্রবর্ষ ১১-১২ দিন কম হয়। কারণ সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে আর চান্দ্রবর্ষ হয় ৩৫৪ দিনে। চান্দ্রবর্ষে মৌসুম ঠিক থাকে না। অথচ চাষাবাদ, খাজনা আদায়সহ অনেক কাজ মৌসুমের উপর নির্ভরশীল। মুসলিম জাহানজুড়ে চান্দ্রবর্ষের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম চললেও উপমহাদেশে ভূপ্রকৃতির বৈচিত্র্য মৌসুমগত সমস্যা সামনে নিয়ে আসে। ফলে প্রয়োজন পড়ে সৌরবর্ষের। সম্রাট আকবর এ কারণে হিজরি চান্দ্রবছরকে সৌরবর্ষে রূপান্তরের আদেশ দেন। আদেশ পালন করেন তার দরবারের বিজ্ঞানী ফতহুল্লাহ সিরাজী। ৯৯২ হিজরীতে হিজরি চান্দ্রবর্ষ হিজরি সৌরবর্ষরূপে ভারত উপমহাদেশে চালু হলো। তবে আকবর যেহেতু এ ঘটনার ২৯ বছর আগে সিংহাসনে বসেন, অতএব বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হলো ৯৬৩ হিজরি সাল থেকে। এর আগে বাংলায় প্রচলিত ছিল শকবর্ষ। এর পয়লা মাস ছিল চৈত্র। কিন্তু ৯৬৩ হিজরির মুহাররম মাসে যেহেতু বাংলা মাস ছিল বৈশাখ, তাই নতুন সনের পয়লা মাস বৈশাখকেই ধরা হয়।

কিন্তু প্রশ্ন যেটি সেটি হলো, এখন ১৪২৩ বাংলা হয় কিভাবে? হলো, কারণ রাসূল সা:- এর হিজরত থেকেই এ পঞ্জিকার শুরু। ১৪২৩ এর মানে হলো হুজুর সা:-এর হিজরতের ১৪২৩ বছর। সৌরবছর চান্দ্রবছরের চেয়ে ১১-১২ দিন বেশি। প্রতি ৩০ বছরে চান্দ্র বছর এক বছর বেড়ে যায়। এ জন্য ১৪৩৭ হিজরি সাল মোতাবেক বাংলা ১৪২৩ হয়েছে।
এর মানে বাংলা সনের গোটা ঐতিহ্য হচ্ছে মুসলমানি ঐতিহ্য।

দুই.
নিষাদ বা অস্ট্রিক কিংবা অস্ট্রো-এশীয় গোষ্ঠীর অনার্য লোকেরাই এই দেশের আদি বাসিন্দা। তারা কাউকে উৎখাত করে এ দেশে আসেনি বরং এখানকার বিভিন্ন শূন্য ভূমি আবাদযোগ্য করেছে তারাই। তাদের উত্তরপুরুষরা ছড়িয়ে ছিল এখানকার বিবিধ জনপদে। এখানে ছিল দ্রাবিড়রাও। অনেকেই তাদেরকে বহিরাগত বলে দাবি করেন, অনেকেই বলেন, তারা এই ভূমির সন্তান। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতা তাদের কারুকাজ বলে দাবি করেছেন বহু ঐতিহাসিক। তাদের ছিল উন্নত সভ্যতা এবং সমাজ-সংস্কৃতি। তাদের উপর আগ্রাসন চালায় বহিরাগত আর্যরা । খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে। তারা ভারতে চালু করে আর্যধর্ম, যা পরে হিন্দুধর্মের রূপ নেয়। আর্যরা সর্বদাই অনার্য ধর্ম ও সভ্যতাকে তাচ্ছিল্য করেছে। তারা ঘৃণা করত বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে। বাংলা ভাষাকে বলতো ইতরদের ভাষা। বেদ ও পুরাণে বাংলা ভাষাকে দাসের ও পক্ষীর ভাষা বলা হয়েছে, বাঙালিকে বলা হয়েছে দস্যু। তারা বাঙালি জাতিসত্তা ও ভাষাকে খুন করার সব প্রয়াস অব্যাহত রাখে। তারা লক্ষ্য হাসিল করেই ফেলতো। কিন্তু বাধা দিলো মুসলিম বিজয়। বিজয়ী মুসলিমরা বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে দিলেন নবপ্রতিষ্ঠা। নবউদ্যমে দাঁড়িয়ে গেল এ মাটির সাংস্কৃতিক সত্তা। বাংলার প্রাচীন লোকসংস্কৃতি ও মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে নববিকাশে উজ্জীবিত এ সংস্কৃতিকেই বলা হতো বাংলা সংস্কৃতি। আর্যরা এ বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল বাধ্য হয়েই।

কিন্তু ১৭৫৭ সালের পরে তারা ঘুরে দাঁড়াল। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির দাসত্ব গ্রহণ করে তারা প্রভাব ও সুযোগ-সুবিধায় বলীয়ান হলো। বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে দিলো নববিন্যাস। যা কিছু হিন্দুয়ানি, তাকে তারা অভিহিত করতে শুরু করলো বাঙালিত্ব বলে। বাঙালিত্বকে করে তুলতে চাইলো হিন্দুত্বের সমার্থক।

যার ফলে শরৎচন্দ্রের গল্পে দুই দলের ফুটবল খেলায় এক দল বাঙালি, আরেকদল মুসলমান। শরৎ বাবুর এ বিবরণ হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মানসিকতার প্রতিফলন মাত্র। তারা বাঙালিত্ব বলতে হিন্দুত্বকেই বাজারজাত করে চললেন। অতএব বাংলা নববর্ষকে হিন্দুয়ানি রূপ না দিলে তাদের চলছিল না। আর্য-অনার্যের হাজার বছর পুরনো লড়াই নতুন করে নববর্ষের উদযাপনে প্রতিফলিত হলো। ধীরে ধীরে পয়লা বৈশাখকে পরানো হলো বিশেষ ধর্মআশ্রিত সংস্কৃতির পোশাক আর একে বলা হতে লাগলো চিরায়ত বাংলা সংস্কৃতি।

তিন.
তাদের এ প্রয়াস গণজীবনকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়। তবে গড়ে তুলে এক তাত্ত্বিক ডিকশন, যার প্রধান ভাষ্যকার ছিলেন বাবু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ দু’জনের বুদ্ধিজীবিতা বাংলাকে করে দুই টুকরা, ভারতকে করে তিন টুকরা। তারা জাতীয়তাবাদের মহাভারতীয় ভাষ্য তৈরি করেন। যার দাবি হলো ভারতীয় মানেই হিন্দুত্ব। ভারতে বসবাসকারী সবাই হিন্দু। সে মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ যাই হোক। তার প্রথম ও প্রধান পরিচয় হচ্ছে সে একজন হিন্দু। এটাই হচ্ছে একজন ভারতীয়ের আসল সত্তা। একে গ্রহণ না করলে আপনি ভারতকে অস্বীকার করছেন।

এই চিন্তাধারা জন্ম দেয় শিবসেনা, বজরং দল ইত্যাদিকে। তারা মুসলিম বিদ্বেষকে হাতিয়ার বানিয়ে ভারতময় লাভ করে প্রতিষ্ঠা। তাদের রাজনীতি স্বতন্ত্র এক মতবাদরূপে জীবন লাভ করে। যার প্রথম ও প্রধান ভাষ্য হলো ভারতের সব ধর্মের মানুষকে হিন্দু ধর্মের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি গ্রহণ করতে হবে। তাদের এ মতবাদই হচ্ছে মনুবাদ। মনুবাদের চোখে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে টিকে থাকার অধিকার রাখে না। সে মহাভারতেরই অংশবিশেষ, যদিও বঙ্গভূমিকে প্রাচীন শাস্ত্রজ্ঞরা দেখেছেন অসুরভূমি হিসেবে। কিন্তু নব্যমনুবাদ একে দেখতে চায় মহাভারতের পেটের ভেতর। সুতরাং এখানে সংস্কৃতি থাকলে থাকবে সেটাই, যা হিন্দুবাদের ধারক। ভারতে যেমন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ মানেই হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ, তেমনি এ ভূখণ্ডে বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানেই হবে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ।

চার.
মনুবাদের প্রধান হাতিয়ার হলো সংস্কৃতি। সে যেখানে পা রাখতে চায়, আগে তার সংস্কৃতিকে পাঠিয়ে দেয়। সে যেহেতু আগ্রাসী, ফলে তার সংস্কৃতি আগ্রাসী অবয়ব নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। সেটা কিভাবে?
স্থানীয় সংস্কৃতিকে উচ্ছেদ করো। অস্বীকার করো। অবজ্ঞা করো। মনুবাদের সংস্কৃতিকে বসাও তার জায়গায়।

মনুবাদের সংস্কৃতির ভিত্তি হলো হিন্দু ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বিশ্বাস। যেমন পেঁচা মঙ্গলের প্রতীক, সে লক্ষ¥ী দেবীর বাহন। ইঁদুর গণেশের বাহন, হনুমান রামের বাহন, হাঁস বিদ্যাদেবীর বাহন, সিংহ দুর্গার বাহন, গাইগরু রামের সঙ্গী।

মনুবাদ এদেরকে পূজা দেয় এবং সবার কাছে চায় এদের পূজা। এই পূজার সাংস্কৃতিক রূপ হলো ঘরে ঘরে এদের ছবি, এদের মুখোশ গায়ে জড়ানো, এদের নিয়ে মিছিল-টিছিল ইত্যাদি।
মনুবাদ চায়, আপনি ধর্মে যাই হোন, আপনাকে এসব করতে হবে এবং এটাই আপনার সংস্কৃতি। এর বিপরীতে যা আছে, সেটা উচ্ছেদযোগ্য।

পাঁচ.
মুশকিল হলো মনুবাদ আপনার সামনে সরাসরি আসছে না এবং সম্মোহক বহু উপকরণ হাতে নিয়ে সে সক্রিয়। যায়নবাদ যা করে, সে তাই করছে। কিংবা অবলম্বন করছে সাম্রাজ্যবাদের খাসলতের সবচেয়ে বাজে দিকগুলো। সে টার্গেট এলাকায় ঘাঁটি গাড়ছে প্রধানত গণসংযোগের ক্ষেত্রসমূহে। মিডিয়ায় বিনিয়োগ করছে এবং মিডিয়াসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে গড়ে নিচ্ছে লেনদেনের বিশেষ সম্পর্ক। তার কথাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে সিভিল সোসাইটির কণ্ঠে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শক্তি বিশেষভাবে তার দিকে হেলে পড়ায় তাদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে এতটাই, যতটা মোদিও ভাবেননি।

সে যেহেতু ভারতের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, অতএব বিশ্বরাজনীতির বাস্তবতায় পরাশক্তিগুলো তার প্রতি প্রসন্ন। ইসলামোফোবিয়া সেই প্রসন্নতাকে সহযোগিতার জায়গায় নিয়ে গেছে। ফলে সে পাচ্ছে বৈশ্বিক আনুকূল্য।

অতএব মনুবাদের মিশনকে এগিয়ে নিতে বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ অতিস্বভাবিক। কাজে কাজেই দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন মিডিয়া ও কোম্পানি যখন মনুবাদের প্রতীকগুলো নিয়ে প্রচারণায় মাতে, তখন মোহিত হয়ো না নওজোয়ান!

লেখক : কবি, গবেষক।


আরো সংবাদ



premium cement
কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেভাবেই ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে : কৃষিমন্ত্রী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সিএনজি ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৪ ভান্ডারিয়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে দর্শনার্থীদের ঢল তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু

সকল