২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজান

-

মুসলিমদের জন্য বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় রমজান মাস। এটি মুসলিম জাতির জন্য একটি প্রশিক্ষণের মাস। ঈমানদারদের সংযমী চরিত্রের অধিকারী করে গড়ে তুলতে আল্লাহ যেসব মৌলিক ইবাদতের ব্যবস্থা করেছেন, রমজানের সিয়াম সাধনা এর অন্যতম। তাই রমজানের চাঁদ দেখা থেকে শুরু করে সাওয়ালের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত আমরা মহান আল্লাহর নির্ধারিত একটি রুটিন অনুযায়ী জীবনযাপন করে থাকি।

কুরআন নাজিলের মাস রমজান। আল কুরআনের আদর্শ সমাজজীবন বাস্তবায়নে দরকার একদল ত্যাগী, উদ্যোগী মানুষ। এই মানুষ গড়ার জন্যই আল্লাহ ঈমানদারদের জন্য মাসব্যাপী রমজানের সিয়াম ফরজ করেছেন। তাকওয়াভিত্তিক চরিত্র গঠন ও কুরআনি হেদায়াত লাভ করাই রমজানের আসল উদ্দেশ্য।
রমজান শব্দটি ‘রমজ’ থেকে উদগত। ‘রমজ’ অর্থ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়া। যেহেতু রমজানের রোজা গুনাহ, কুপ্রবৃত্তি, আত্মার সবরকম কলুষতা ও অপবিত্রতাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়, সেহেতু এ মাসের নাম ‘রমজান’। আবার অনেকে বলেছেন ‘রমজ’ অর্থ বসন্তকালীন বৃষ্টি। এ বৃষ্টি থেকে প্রকৃতির সব কিছুই যেমন উপকৃত হয়, তেমনি রমজান মাসের রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের বৃষ্টি থেকেও কেউ বঞ্চিত হয় না।

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন : ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।... রমজান হলো সেই মাস, যে মাসে নাজিল করা হয়েছে আল কুরআন, যাতে রয়েছে মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপন্থীদের জন্য সুস্পষ্ট শিক্ষা, হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী বিধান।- সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩, ১৮৫।

কুরআনুল কারিমে সিয়াম নিয়ে সূরা বাকারাতে একবারই আলোচনা করা হয়েছে ১৮৩ থেকে ১৮৭ নম্বর আয়াত পর্যন্ত। সম্পূর্ণ কুরআনে এর আর কোনো পুনরাবৃত্তি হয়নি। তবে সূরা বাকারার যে অংশে এবং যেই প্রেক্ষাপটে সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে, সেটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সূরা বাকারাতে সিয়ামের বিধান আলোচনা করার আগে বনি ইসরাইল জাতির আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণগুলো আলোচনা করা হয়েছে। বনি ইসরাইলদের ভুলগুলোর কথা বলা হয়েছে। এরপরে হজরত ইব্রাহিম আ: সম্পর্কে আলোচনা এসেছে।

মূলত হজরত ইব্রাহিম আ: আরব ও ইহুদিদের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র। আরবরা হজরত ইসমাইল আ:-এর সন্তান। আর ইহুদিরা হজরত ইসহাক আ:-এর সন্তান। তাদের উভয়ের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র স্থাপনকারী হলেন হজরত ইব্রাহিম আ:। আর সবাইকে-ই ইব্রাহিম আ:-এর সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের সম্পর্ককে একই বন্ধনে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এরপরে হজরত ইব্রাহিম আ:-এর বাইতুল্লাহ নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তার পর কিবলা পরিবর্তনের আয়াত নাজিল হয়ে ইহুদিদের নির্ধারিত কেবলা আল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করার বিধানকে রহিত করে মুসলমানদের জন্য বাইতুল্লাকে নতুন কিবলা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিবর্তের আগে মুসলমানরা ইহুদিদের কিবলার দিকে ফিরে তাদের সময় অনুযায়ী মুসা আ:-এর শরিয়তমতো নামাজ ও রোজা পালন করে আসছিলেন। যদিও মক্কায় থাকতে মসজিদে আকসার সেই দিকেই মুখ করে মুসলমানরা নামাজ আদায় করতেন যে দিকে বাইতুল্লাহ ও মসজিদে আকসা একই সমান্তরালে সামনে রেখে নামাজ আদায় করা যায়। কিন্তু মদিনায় এসে সেই সুযোগ আর থাকল না। ফলে একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মুসলমানদের তথা উম্মতে মুহাম্মদীকে পরিচিত করতে তাদের কিবলা পরিবর্তনের মাধ্যমে মুসলমানদের রাজধানী পরিবর্তন হয়ে গেল। এরপরে মুসলমানদের জন্য অবতীর্ণ হলো সিয়ামের স্বতন্ত্র বিধান।

মহান আল্লাহ মানব জাতির ওপর যেসব মৌলিক ইবাদত ফরজ করেছেন তার মধ্যে নামাজ ও রোজা সব নবীর শরিয়তেই ফরজ করা হয়েছিল। অতীতের সব নবীর উম্মতরাই শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর উম্মতদের মতো রোজা পালন করতেন। অবশ্য রোজার নিয়মকানুন, সংখ্যা ও সময় বা মুদ্দতের ব্যাপারে বিভিন্ন নবীদের শরিয়তে ভিন্নতা ছিল।

রোজা ফরজসংবলিত আয়াতের দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর তরফ থেকে যত শরিয়ত দুনিয়াতে নাজিল হয়েছে, প্রত্যেকের শরিয়তেই রোজা রাখার নির্দেশ ও বিধিব্যবস্থা ছিল।

মাহে রমজানে রোজা রাখার তাৎপর্য অপরিসীম। রোজা ছাড়া অন্য যেসব ইবাদত আছে সেগুলোর কোনো না কোনো বাহ্যিক প্রকাশের আশ্রয় নিতে হয়। রোজা একমাত্র ইবাদত যার কথা আল্লাহ ও রোজাদার ছাড়া অন্য কেউ জানতে পারে না। এক ব্যক্তি যদি সবার সামনে সাহরি খায়, ইফতারে সময় সবার সাথে মিলে ইফতার করে আর দিনের বেলায় গোপনে কিছু খায় বা পান করে, তবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। রোজার এ দিকটি নিয়ে চিন্তা করলেই বোঝা যায়, রোজাদার একমাত্র আল্লাহকে ভয় করেই এমন কোনো কাজ করে না, যাতে তার রোজা ভঙ্গ হতে পারে। রোজা পরকালের বিচারের প্রতি মানুষের আকিদা-বিশ্বাস দৃঢ় ও মজবুত করে। এক মাস দৈনিক ১২-১৪ ঘণ্টা ধরে রোজা রেখে সম্পূর্ণ মাসে প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানকে কমপক্ষে ৩৬০ ঘণ্টা সময় এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। আল্লাহ প্রতি বছর এক মাস ধরে মুসলমানদের ঈমানের ধারাবাহিক পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। এ পরীক্ষায় সে যখন পুরোপুরি উত্তীর্ণ হন তখন তার মধ্যে আল্লাহকে ভয় করে অন্যান্য গুনাহ থেকে ফিরে থাকার এক অভূতপূর্ব যোগ্যতা তৈরি হয়। সাথে সাথে ঈমানদার ব্যক্তিকে রোজা দীর্ঘকালীন শরীয় হুকুম-আহকাম পালনে যোগ্য করে গড়ে তোলে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রমজানে সিয়াম পালনের হুকুম দেয়ার সাথে সাথে এর মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন : ‘যাতে তোমরা মুত্তাকি বা পরহেজগার হতে পারো।’
রোজার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া-ভিত্তিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহত্ত্ব ঘোষণা করা এবং তাঁর সব নেয়ামতের পূর্ণ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা। তাকওয়া শব্দটির অর্থ ভয় করা, বেঁচে থাকা/বিরত থাকা, সুরক্ষা, আত্মরক্ষা/আত্মশুদ্ধি, নিষ্কৃতি/মুক্তি ইত্যাদি। আর কেয়ামতের দিন সবাই বাঁচতে চাইবে, সুরক্ষা চাইবে। তাকওয়া অর্জনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণ করতে গিয়ে মুমিনকে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচতে চেষ্টা-সাধনা করা, অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য কার্যক্রম থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা বা নিরাপদ দূরত্বে রাখা।

তাকওয়ার অধিকারী বান্দা তথা মুত্তাকির পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ২ নম্বর ও ১৭৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন : ১. তারা গায়েবের (যে বিষয় প্রত্যক্ষ জ্ঞান নেই; কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। ২. সালাত কায়েম করে। ৩. আল্লাহর দেয়া রিজিক থেকে খরচ করে। ৪. শেষ নবী মুহাম্মদ সা: এবং তাঁর পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের ওপর নাজিলকৃত কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। ৫. আখেরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে। ৬. ওয়াদা পূরণ করে। ৭. ব্যক্তিগত অসুবিধা, বিপদ মুসিবতে ও সত্যের সংগ্রামে বাতিলের সাথে প্রত্যেক সঙ্ঘাতময় মুহূর্তে সবর বা ধৈর্য অবলম্বন করে।
তাকওয়া-ভিত্তিক জীবনযাপন করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে অফুরন্ত পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতেই এ পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা তালাকে ২ থেকে ৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন, যারা আল্লাহকে ভয় করে জীবনযাপন করে- ১. দুনিয়ার সব বিপদ-আপদ থেকে তাদের বাঁচানো হবে। ২. এমন জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করে দেয় হবে, যা তারা কল্পনাও করতে পারবে না। ৩. জীবনের সব কাজকে সহজ করে দেয়া হবে। ৪. জীবনের সব গুনাহ থেকে নিষ্কৃতি দেয়া হবে। ৫. কিয়ামতের কঠিন দিনে তাকে একটি বিরাট প্রতিদান বা উত্তম প্রতিদান দেয়া হবে। তারাই হলেন ‘মুকাররাবুন’। সাবেকুনাস সাবেকুন উলাইকাল মুকাররাবুন। সূরা ওয়াকিয়াহ, আয়াত ১১-১২। মাহে রমজান মূলত ইবাদতের মৌসুম। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের সিয়াম সাধনার এই অফুরন্ত নেয়ামতকে যথাযতভাবে ধারণ করার তাওফিক দান করুক।


আরো সংবাদ



premium cement
শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৪০ নিউইয়র্কে মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করবে যুক্তরাষ্ট্র! টাঙ্গাইলে লরি-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে নিহত ১ জিম্বাবুয়ে সিরিজে অনিশ্চিত সৌম্য বেনাপোল সীমান্তে ৭০ লাখ টাকার স্বর্ণের বারসহ পাচারকারী আটক

সকল