২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, কিছু কথা

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, কিছু কথা - ফাইল ছবি

বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং গত ৫০ বছরের যাবতীয় অর্জনের সাথে গণমাধ্যমের বিশাল সংযোগ রয়েছে। ভাষা আন্দোলন ও পূর্ববাংলার বিভিন্ন আন্দোলনের কর্মসূচি বেগবান করার পেছনে সংবাদপত্রের ভূমিকা উপলব্ধি করে পাকিস্তান সরকার। সেই উপলব্ধি থেকে সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। সেই লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে গঠিত হয় ন্যাশনাল প্রেস ট্রাস্ট। পাকিস্তান সমর্থিত মর্নিং নিউজ প্রকাশনার দায়িত্ব নেয় প্রেস ট্রাস্ট। একটি বাংলা পত্রিকার প্রয়োজন মেটাতে ট্রাস্টের মালিকানায় ১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর প্রকাশ করা হয় দৈনিক পাকিস্তান। এই দৈনিক পাকিস্তানই দেশ স্বাধীনের পর হয় দৈনিক বাংলা। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকবাহিনীর অন্যতম টার্গেট হয় ইত্তেফাক ও দ্য পিপলস। বোমা মেরে বিধ্বস্ত করা হয় এ দু’টি সংবাদপত্র অফিস। অগ্নিসংযোগ করা হয় সংবাদ অফিসে। কর্মক্ষেত্রেই পুড়ে মারা যান সাংবাদিক শহীদ সাবের। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস প্রকাশিত হয়নি সংবাদ, পিপল, হলিডে। ইত্তেফাক দুই মাস বন্ধ থাকার পর ২১ মে থেকে আবার প্রকাশিত হতে থাকে। তবে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ায় প্রাণ দিতে হয়েছে ইত্তেফাকের সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, সংবাদের শহীদুল্লাহ কায়সার, পয়গামের খোন্দকার আবু তালেব, পূর্বদেশের আ ন ম গোলাম মোস্তফা, অবজারভারের লাডু ভাই খ্যাত শেখ আবদুল মান্নান, সেলিনা পারভীন ও শিবসাধন চক্রবর্তীকে।

সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের সেই অগ্রসর ভূমিকা স্বাধীনতার পর কেন থাকেনি বা নেই- এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব পাওয়া কঠিন। সরকারপক্ষের দাবি, বিশ্বের বহু দেশের চেয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম অনেক বেশি স্বাধীন। সম্প্রতি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম যে পরিমাণ স্বাধীনতা ভোগ করে, অনেক উন্নত দেশেও তা নেই।’ উদাহরণ হিসেবে বলেছেন, ‘যুক্তরাজ্যে একটি ভুল সংবাদ পরিবেশনের কারণে ১৬৭ বছরের পুরনো পত্রিকা ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’, যেটি একসময় বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ছিল, সেটি বন্ধ হয়ে যায়।

বিবিসিকে পৃথিবীর প্রথম সারির গণমাধ্যম হিসেবে ধরা হয়, সেখানে একজন এমপির বিরুদ্ধে অসত্য সংবাদ পরিবেশনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হয়। সে জন্য বিবিসির প্রধান নির্বাহী থেকে শুরু করে পুরো টিমকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু অসত্য বা ভুল সংবাদ পরিবেশনের জন্য বাংলাদেশের কোনো সংবাদপত্র বন্ধ হয়নি।’

মন্ত্রীর দাবি খণ্ডন বা সমর্থন এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। তথ্য হিসেবে বলতে হয়, বিকাশ-দমন অনেক কিছুই হয়েছে গণমাধ্যমে। পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন মিলিয়ে সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এসব গণমাধ্যম বা এগুলোতে কর্মরতরা কতটা স্বাধীন সেই বিতর্ক পুরনো ও চলমান। ফায়সালা কখনো আসার মতো নয়। এগুলোতে সঙ্কট যে প্রতিনিয়ত গভীর হচ্ছে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন সংবাদকর্মীরা। এই সঙ্কট যখন গভীর হচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপটে তাদের মধ্যে চাকরি হারানোর একটা ভীতিও তৈরি হয়েছে। গত দুই দশকে গণমাধ্যমে পরিবর্তনের বড় দিক হচ্ছে বেসরকারি টেলিভিশন-রেডিওর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এখন অন্তত ৩০টি বেসরকারি টেলিভিশন চালু রয়েছে। আরো ১৫টি সম্প্রচারে আসার অপেক্ষায়। ২৬টি বেসরকারি রেডিও চালু রয়েছে। প্রত্যেক জেলায় কমিউনিটি রেডিও তো আছেই। অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, টেলিভিশন রেডিওর লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ই মূল বিষয় হিসেবে বিবেচ্য। সরকারের চাপ দেখা যায় না। কিন্তু সেটা দৈত্য বা ভূতের মতো এই মাধ্যমে চলে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মীদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকা এবং সরকারের চাপের কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায় ইলেকট্রনিক মিডিয়া মানুষের আস্থা হারিয়েছে।

ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সংবাদপত্র বা অনলাইন- সবখানেই টিকে থাকার সংগ্রাম। তারওপর রয়েছে অর্থনৈতিক সঙ্কট।
সরকার এসব বক্তব্য মানতে রাজি নয়। সরকারের পক্ষ থেকে টেলিভিশন রেডিওর সংখ্যা বৃদ্ধিকেই ইতিবাচক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে চাপ দিয়ে কোনো কোনো পত্রিকায় বড়-বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বন্ধ করার অভিযোগও রয়েছে। সাধারণ মানুষও তা আঁচ করতে পারছে। তাদের তাই আস্থা কমছে গোটা গণমাধ্যমের ওপর। এই বাস্তবতায় কোনো ঘটনা ঘটলে মুহূর্তেই মানুষ এখন ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে তা পাচ্ছে। ফলে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করে পরদিন গিয়ে সেই সংবাদ দেখার আগ্রহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকেও সংবাদমাধ্যমের সঙ্কটের একটা অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়। দেশের অনলাইনের সঠিক কোনো সংখ্যা নেই। অনলাইনেও স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ বা কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের হিমশিম খেতে হয়। ফলে তারাও আস্থার সঙ্কটে পড়ছেন এবং সে জন্য বিজ্ঞাপন যাচ্ছে হাতেগোনা কয়েকটি অনলাইনের কাছে। ফলে বেশির ভাগ অনলাইন পোর্টাল অর্থ সঙ্কটে রয়েছে। এরই মধ্যে বড় কয়েকটি অনলাইন থেকে কর্মী ছাঁটাই হয়েছে।

পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন- পুরো গণমাধ্যমেরই আয়ের মূল উৎস বিজ্ঞাপন। সেখানেও অসুস্থতা। ছোট এই বাজারে এখন অনেক মিডিয়া ভাগ বসাচ্ছে। তা ছাড়া বিজ্ঞাপন এখন ভারতেও চলে যাচ্ছে। সরকারের সাথে সমঝোতার বিষয় যেমন রয়েছে, একই সাথে গণমাধ্যমকে এখন করপোরেট হাউজের সাথেও সমঝোতা করে চলতে হচ্ছে। প্রযুক্তির লড়াইও ব্যাপক। মোবাইল ফোনের তোড়ে স্টিল ক্যামেরা কাবু হয়ে গেছে কবেই। ভিডিও ক্যামেরাও টিকে থাকার লড়াইয়ে পর্যুদস্ত। টেলিভিশন সাংবাদিকতায় একটা সম্ভাবনা দেখা দিলেও সেটা ধপাস করে পড়তির দিকে। টিভিগুলোকে অনেকে সরকারি প্রচারমাধ্যম বলে থাকেন। এক ধরনের আদিষ্ট হয়ে সংবাদ পরিবেশন ও সংবাদকর্মী নিয়োগ হওয়ায় এর বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। টিভি চ্যানেলগুলোতে এখনো বেতনকাঠামো তৈরি হয়নি। যেসব টিভির একটু নাম আছে তাদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা বেশি। টেলিভিশন মিডিয়ার দীর্ঘদিনের আধিপত্য ভেঙে এসেছে সিটিজেন জার্নালিজম, নেট জার্নালিজম, মোবাইল জার্নালিজম। বিকশিত হওয়ার আগেই এ টার্মগুলো ছড়িয়ে গেছে দ্রুত। হালসময়ে ফেসবুক এবং ইউটিউব জার্নালিজমের দাপট। মানুষের কাছে যে মাধ্যম সবচেয়ে সহজলভ্য সেটিই আদরণীয়। পত্রিকার পাতা উল্টানোর ঝামেলা থেকে বাঁচতে মানুষ রিমোট টিপে টিভি ঘুরিয়েছে। এখন টেলিভিশন চ্যানেলের শিডিউলের কাছে বন্দী না থেকে ঝুঁকছে ইউটিউব এবং ফেসবুকে। কারণ এখানে কোনো শিডিউল নেই, ধরাবাধা সময় নেই, এক বছর আগের তথ্যটিও তারা খুব সহজে ফেসবুক-ইউটিউব থেকে খুঁজে নিচ্ছেন।

মূলধারার গণমাধ্যম এতদিন শুধু বার্তা দিয়ে গেছে। অন্যপক্ষ থেকে শোনার বা জানার তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এখন একটি সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে আরো বেশি অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছে দেয়া যাচ্ছে। অনেক ঘটনাই মূলধারার গণমাধ্যমে আগে প্রকাশিত হয়নি। ফেসবুকে ব্যাপক লেখালেখির কারণে শেষ পর্যন্ত মূলধারার গণমাধ্যম সেটিকে তাদের অ্যাজেন্ডায় নিয়ে আসতে বাধ্য হয়। আসলে প্রচলিত গণমাধ্যমে-সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশন সব মাধ্যমকেই লড়তে হচ্ছে নানা ফ্রন্টে। মোবাইল, ইন্টারনেট এবং সর্বশেষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে যে বিশাল চ্যালেঞ্জে ফেলেছে তা বৈশ্বিক ঘটনা। এটি কারো জন্য সমস্যার, কারো জন্য সম্ভাবনারও। মানুষ কোন মাধ্যম বা প্ল্যাটফর্ম গ্রহণ করবে সেটা যার যার বিষয়। মোবাইল ফোন এখন বিশ্বের এক নম্বর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। মোবাইল অডিয়েন্সকে সামনে রেখে সংবাদক্ষেত্রের চেহারাও পাল্টে যেতে বসেছে। সাংবাদিকতা আর শুধু লেখা বা বলা কিংবা দেখানোতে সীমাবদ্ধ থাকছে না।

মূলধারার সাংবাদিকরা যে এসব বিষয় তুলে আনতে পারেন না, এমন অনেক বিষয় সামাজিকমাধ্যমে প্রকাশ পায়। ‘পোস্ট’ বা ‘স্ট্যাটাস’। পোস্ট স্ট্যাটাস যে নামই হোক, সত্য-আধাসত্য, মিথ্যা যাই হোক এগুলো কিন্তু তথ্যমূল্য পাচ্ছে। এতে ফেসবুক ইতোমধ্যে বিকল্প মিডিয়া হয়ে প্রতিটি মানুষকে এখন ইনডিভিজুয়াল সাংবাদিক বানিয়ে দিচ্ছে। একজন পেশাদার সাংবাদিক অনেক সময় যা পারেন না, ফেসবুকাররা সেটা করে দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউটিউব এবং ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের নতুন বাজার দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানি এবং ব্র্যান্ডগুলো অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের প্রচার এবং প্রসারের জন্য ডিজিটাল মাধ্যমকেই বেছে নিচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপন বাবদ প্রতি বছর কত টাকা ব্যয় করে সে সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য দিতে চায় না। এ নিয়ে কোম্পানিগুলোর মাঝে এক ধরনের গোপনীয়তার প্রবণতা দেখা যায়। সাংবাদিকতাকে স্বাধীন পেশা বলা হলেও কখনোই স্বাধীন ছিল না পেশাটি।

ক্ষমতাসীনদের সেন্সর কর্ম-ধর্ম সাংবাদিকতার শুরু থেকেই। আর এই সেন্সরই সাংবাদিকতাকে গতিময় ও সাহসী করেছে। হাতে লেখা সংবাদপত্রকে রাজারা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচারপত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। সাম্রাজ্য রক্ষা, বিস্তার, প্রতিপক্ষ দমন, জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজে ব্যবহার করতেন। বিশ্বের দেশে দেশে সেই ধারার ধরন বদলেছে মাত্র।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement