১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হারিয়ে যাওয়া কিছু স্মৃতি

হারিয়ে যাওয়া কিছু স্মৃতি - ফাইল ছবি

১৯৬৮ সালে আমি যখন পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস করাচিতে স্টাফ ইকোনমিস্ট হিসেবে যোগ দিই তখন এর ডাইরেক্টর প্রফেসর নুরুল ইসলাম বিদেশে ছিলেন। অবশ্য এর আগে তিনি এবং পিআইডিইর কিছু ফরেন অ্যাডভাইজার ঢাকায় এসে লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে আমাদের নিয়োগ দিয়ে গিয়েছিলেন। ডাইরেক্টর ফিরে আসার অল্প ক’দিনের মধ্যেই বেশ ক’জন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ইনস্টিটিউটে এলেন। তাদের মধ্যে যাদের নাম মনে আছে তারা হলেন, E.A.G. Robinson, Harry G. Johnson, Fei, Ranis. আর এসেছেন Yale-Pakistan প্রজেক্টের ডাইরেক্টর Professor Mark W. Leiserson. তারা মিলে হলরুমে ক’দিন অর্থনীতি বিষয়ে গোলটেবিল বৈঠক করলেন। ইনস্টিটিউটের বাইরের কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদও এতে যোগ দেন। আমরা নবীনরা দর্শক। বেশ মনোজ্ঞ আলোচনা হলো। আমি লক্ষ করলাম, পিআইডিইর অন্যতম রিসার্চ ইকোনমিস্ট ড. এস এন এইচ নকভি জনসনের পাশে বসে ছোট ছোট কাগজে কী লিখে জনসনের হাতে তুলে দিচ্ছেন আর তিনি তাতে কলম চালিয়ে তা আবার ড. নকভির হাতে ফেরত দিচ্ছেন। সে কাগজটি ড. নকভি সযত্নে তার ব্যাগে রেখে আবার আরেকটি কাগজ বের করছেন আর আগের মতো তাতে কিছু লিখে জনসনের হাতে দিচ্ছেন আর তিনি তাতে কলম চালিয়ে ড. নকভিকে ফেরত দিচ্ছেন। যে পাঁচ-সাত দিন সেশন চলল সে ক’দিনই এভাবে অবিরাম দু’জনের মধ্যে নিঃশব্দ কাগুজে আলাপ চলল। আমার মনে হয় ড. নকভি জনসনকে লিখিত প্রশ্ন করছেন আর তিনি তার লিখিত উত্তর দিচ্ছেন। দু’জনেই আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিষয়ে স্পেশালিস্ট। ক’দিনের সেশনে দু’জনের মধ্যে একটি মৌখিক বাক্যবিনিময় হতেও দেখিনি। তৃতীয় কোনো ব্যক্তির ধ্যানভঙ্গ বা মনোযোগ নষ্ট বা দৃষ্টি আকর্ষণ না করে মতবিনিময়ের এ কৌশলটি আমার কাছে বড় চমৎকার লাগল। সভ্য দুনিয়ার অনেক কিছুই সুন্দর আর অনুকরণীয়। ড. নকভি পরবর্তী জীবনে ইসলামিক অর্থনীতিতে গবেষণা করে জগতজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন।

একদিন স্পিকারস ডায়াসের আমার কক্ষ থেকে বেরিয়ে সামনের বারান্দায় নেমে দেখি মি. রবিনসন নামে জনৈক সিনিয়র স্টাফ ইকোনমিস্ট আবদুল গফুরের সাথে আলাপ করছেন। আবদুল গফুর প্রেমিকার চিঠি পেয়ে তাকে বিয়ে করতে ইয়েল থেকে পিএইচডি না করেই সদ্য দেশে ফিরেছেন। আমি তাদের পাশে এসে চুপ করে দাঁড়ালাম। আলাপের এক পর্যায়ে কি একটি বিষয়ের ওপর আমি মন্তব্য করতেই রবিনসন আলাপ ভঙ্গ করে দক্ষিণ দিকে হাঁটা দিলেন। হয়তো ভাবলেন, এই ছেলের সাথে কী আলাপ করব। প্রবুদ্ধ পণ্ডিত রবিনসন। মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে। গায়ের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। তবু একদম সোজা হয়ে দাঁড়ান। সুস্থ পাতলা শরীর।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠকালে রবিনসন এবং জনসনের কত নাম শুনেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমেদের কাছে প্রথম জনসনের নাম শুনি। জনসন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. আহমেদের পিএইচডি গাইড ছিলেন। মনে আছে, এম এ ক্লাসে ড. আহমেদ আমাদের আন্তর্জাতিক অর্থনীতি পড়াতে গিয়ে জনসনের বই অনুসরণ করতেন। সেই জনসনকেও দেখলাম। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জনসন মধ্যবয়সে অবতীর্ণ হয়েছেন। লিখতে বসে কাগজ ছেঁড়েন প্রচুর। রবিনসনকে এই প্রথম দেখলেও Imperfect Competition-এর লেখক তার স্ত্রী জোয়ান রবিনসনকে সেই ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যখন পড়ি তখনই এক সেমিনারে দেখেছি।

ইনস্টিটিউট থেকে তাদের বিদায়ের আগে আমরা সবাই মিলে অ্যাসেম্বলি ভবনের নিচতলার পশ্চিমের মাঠে অ্যাসেম্বলি ভবন পেছনে রেখে গ্রুপ ফটো তুলি। ফটো তোলার জন্য ক্যামেরাম্যানের নির্দেশমতো সারিবদ্ধভাবে সিনিয়ররা বসেছেন। মেহমানদের সাথে সবার মাঝে চেয়ারে বসেছেন প্রফেসর ইসলাম। তাদের পেছনে আমরা একধাপ সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়েছি। আমার এক পাশে ড. নকভি, অন্য পাশে কে মনে নেই। ক্যামেরাম্যান ক্যামেরায় আমাদের অবস্থান দেখে ফাইনাল ক্লিক করার আগে সামনে বসা কারো প্যান্টের ভাঁজ ঠিক করে দেন কাউকে একটু সরে বা চেপে দাঁড়াতে বা বসতে নির্দেশ দেন। এমনি সময় আমাদের ব্যাচমেট স্টাফ ইকোনমিস্ট ইয়াসমিন নিয়াজ কোথা থেকে দৌঁড়ে এসে আমার এবং ড. নকভির মাঝে চাপাচাপি করে প্রবেশ করে দাঁড়িয়ে পড়েন। ক্যামেরাম্যান আবার এসে সবার পজিশন ঠিক করে দেন। এবার ক্যামেরায় ফাইনাল ক্লিকের পালা। ক্যামেরায় তিনটি স্ন্যাপ নেয়া হলো। ইয়াসমিনের এমন আচরণে আমি বিব্রত বোধ করি।

সে সময়ে পিআইডিইর ইকোনমিস্ট অ্যান্ড ডেমোগ্রাফারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ফটোর কপিগুলো স্টুডিও থেকে আনার দায়িত্ব আমার ওপর বর্তায়। ছবিতে দেখি ইয়াসমিন আমাকে ঘেঁষে এমনভাবে দঁড়িয়েছে যে, ফটোটির দিকে তাকালেই আমার লজ্জা লাগছে। মনে হলো, আমার জন্য ফটোটাই মাটি হয়ে গেছে। যদিও বিশ্বের বেশ ক’জন বরেণ্য অর্থনীতিবিদ এই গ্রুপ ফটোতে ছিলেন, কিন্তু পরে আমি এটির আর কোনো যত্ন নিইনি। এ গ্রুপ ফটোটি আমি পরে আমাদের এক ব্যাচ পরের স্টাফ ইকোনমিস্ট আসাদুজ্জামানের সাথে ঢাকার বাসায় পাঠিয়ে দেই। মা ফটোটি অতি যত্নের সাথে বাঁধাই করে দেয়ালে টানিয়ে রেখেছিলেন। আমি ঢাকায় ফিরে ফটোটি দেয়াল থেকে নামিয়ে তাকের উপর রেখে দেই। এর পর থেকে অযত্নে অবহেলায় এই মূল্যবান গ্রুপ ফটোটি নষ্ট হয়ে গেল।

এ ছাড়াও একবার ইনস্টিটিউটে এসেছিলেন হোলিস বি চেন্নেরি। দীর্ঘকায় সুপুরুষ চেন্নেরি একাই এসেছিলেন। তার লেখা ‘ইনপুট-আউটপুট অ্যানালাইসিস’ বইটি আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। ইনস্টিটিউটের হলে তিনি একটি বক্তৃতা দেন। চেন্নেরির বক্তৃতার মাঝপথে এক জায়গায় প্রফেসর ইসলাম দ্রুতগতিতে আসন ছেড়ে উঠে ব্ল্যাকবোর্ডে আঙুল লাগিয়ে বলেন, if you take log of it, the result will be different’. এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে চেন্নেরি বক্তৃতা চালিয়ে যান। এ ছাড়াও এখানে কিছু দিন থেকে গবেষণা করে গেছেন জেমস এ মিরলেস। কৃষাঙ্গ লম্বা এ অর্থনীতিবিদের চোখে মুখে চেহারায় প্রতিভার আলো জ্বল জ্বল করে। পরে তিনি অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ লাভ করেন।

বিশ্ব ব্যাংকের এক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এখানে বক্তৃতা করতে আসেন। শ্রোতাদের মাঝখান থেকে কেউ তাকে একটি প্রশ্ন করলে তার মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ ধারণ করে। তিনি সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজ বক্তৃতা চালিয়ে যান। পিআইডিই সে সময়ে অর্থনীতির গবেষণায় বিশ্বের দরবারে একটি মর্যাদাপূর্ণ আসন লাভ করেছিল। তবে এর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে প্রফেসর ইসলাম সজাগ ছিলেন। একবার তিনি কথাপ্রসঙ্গে পিআইডিইর এক ঘরোয়া আলোচনায় বলেছিলেন, ‘Do you think all the articles that are published in the P.D.R. are read? Only few of them are actually read. Most of them are overlooked’. আমার বিবেচনায় তার মূল্যায়ন যথার্থ।

প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে আরেকটি ঘটনার কথা বলি। কে একজন বললেন, রিসার্চ ইকোনমিস্ট ড. এ এস এন এইচ নূর উদ্দীন চৌধুরীর পিএইচডি থিসিসটি বেশ ভালো। এটি যেন আমি পড়ে দেখি। তিনি যুক্তরাষ্ট্র্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট করেছেন। আমি ড. চৌধুরীর কাছে থিসিসটি চাইলাম। তিনি বললেন, এটি এখন ডাইরেক্টরের কাছে। আমি তাকে এটি তার কাছ থেকে এনে আমাকে কয়েক দিনের জন্য পড়তে দিতে অনুরোধ করলাম। তিনি বললেন, ‘আমি চাইব কী করে, তিনি তো আমার সাথে এক রকম কথাই বলেন না’।

এরপর আমি আমার রিসার্চ গাইড ড. এ আর খানকে অনুরোধ করলাম ডাইরেক্টরের কাছ থেকে ড. চৌধুরীর থিসিসটি এনে কয়েক দিনের জন্য আমাকে পড়তে দেয়ার জন্য। তিনি বললেন, ‘ডাইরেক্টরের পিএকে বলুন। সে বললেই চলবে।’ আমি তাই করলাম। কিন্তু থিসিসটি পাচ্ছি না। ড. খান আমার কাছে একদিন জানতে চাইলেন আমি থিসিসটি পেয়েছি কি না। আমি বললাম, ‘না’। তিনি বললেন, ‘আপনি এখনো তার কাছ থেকে থিসিসটি নিতে পারলেন না’! আমি ভাবলাম আমি নিজেই ডাইরেক্টরকে বলব। আমি তার কাছে যেতে চাইলাম। পিএ বললেন, ‘হি আসক্ড মি নট টু এলাউ এনিবডি ইনসাইড নাউ’।

আমি তার কথা শুনলাম না। ভেতরে চলে গেলাম। ডাইরেক্টর সিনিয়র রিসার্চ অ্যাডভাইজার ফ্রাঙ্ক চিল্ডের সাথে সোফায় বসে একটি গবেষণা পেপার নিয়ে আলোচনা করছেন মনে হলো। ভেতরে ঢুকতেই তিনি মুখ তুলে চাইলেন। আমি বললাম, ‘ড. নূর উদ্দীন চৌধুরীস থিসিস ইজ উইথ ইউ। আই নিড ইট ফর এ ফিউ ডেজ’। তিনি বললেন, ‘ইউ উইল গেট ইট টুমরো’। আমি কক্ষে চলে এলাম। মুহূর্তের মধ্যেই তার পিএ এসে বলল, ‘ডাইরেক্টর ওয়ান্টস টু মিট ইউ’। আমি আবার গেলাম। তিনি কিছুটা বিরক্তির সুরে বললেন, ‘তোমাকে পিএ নিষেধ করা সত্ত্বে¡ও ভেতরে এলে কেন’?

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর তিনি বললেন, ‘আর এমন করবে না, যাও।’ ফ্রাঙ্ক চিল্ড তখনো আছেন। ডাইরেক্টরের কক্ষ থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসতেই পিএ আমাকে আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডিড হি সে ইউ এনি থিং?’ বাংলা তিনি বুঝেন না। ডাইরেক্টর আমাকে বাংলায় কী বলেছেন তিনি তা বুঝতে পারেননি। আমি বললাম, ‘নো নাথিং’।

তিনি মনে হলো হতাশ হলেন। আমি কক্ষে চলে এলাম। ডাইরেক্টর পরদিন ঠিকই ড. চৌধুরীর থিসিসটি আমাকে ডেকে দিলেন। দিন ১৫ পর আমি তারই হাতে থিসিসটি ফেরত দিয়ে আসি। এর বেশ আগে কথা প্রসঙ্গে আমার ব্যাচমেট স্টাফ ইকোনমিস্ট আনোয়ার চৌধুরী একদিন আমাকে বলেছিল, ‘প্রফেসর ইসলাম ইজ এ ম্যান অব স্ট্রং সেন্টিমেন্ট’। আমি তার এ মন্তব্যের অর্থ বুঝিনি। আজ জীবন সায়াহ্নে এসব কেবলই স্মৃতি।

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ভাইস প্রিন্সিপাল, মহিলা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা।


আরো সংবাদ



premium cement