২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ভারত হিন্দুস্তান এবং ইন্ডিয়া

ভারত হিন্দুস্তান এবং ইন্ডিয়া - ফাইল ছবি

ভারতের সংবিধানে দেশটির নাম ভারত। ইংরেজরা তাকে ইন্ডিয়া বানিয়ে দিয়েছে। তবে রাষ্ট্রের সঙ্কীর্ণমনারা এটাকে হিন্দুস্তান বানিয়ে দিয়েছে। আমরা তো এটা ভাবতাম যে, পাকিস্তান অস্তিত্বে আসার পর বোধ হয় এই দেশের নাম হিন্দুস্তান রাখা হয়েছে। কেননা, পাকিস্তান দ্বারা উদ্দেশ্য মুসলমানদের রাষ্ট্র। আর হিন্দুস্তান দ্বারা উদ্দেশ্য হিন্দুদের রাষ্ট্র। সাধারণভাবে অল্প শিক্ষিত মানুষ এটাই ভাবে। কিন্তু এটা ঠিক নয়। কেননা ভারত যখন স্বাধীন হয়নি, তারও অনেক আগে থেকে এটাকে হিন্দুস্তান বলা হতে থাকে। এতদসত্তে¡ও হিন্দু মহাসভা হিন্দুদের দেশ হিসেবে এর প্রচলন ঘটাচ্ছে, যাকে আরএসএস বাস্তবায়নে তৎপর। অথচ এই দেশকে হিন্দুস্তান বলার প্রথম কৃতিত্ব মুসলিম কবিদের। স্বয়ং আল্লামা ইকবালও এটাকে হিন্দুস্তান বলেছেন। ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তা হামারা’ তার বিখ্যাত কবিতা এ কথার ইঙ্গিত দেয়। নাম নিয়ে তর্ক করা উচিত নয়। কথায় বলে, নামে কী আসে যায়। কিন্তু যখন একই রাষ্ট্রের তিন তিনটি নাম হয়, তখন বিতর্ক হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কেননা, কমপক্ষে নিউ জেনারেশন অবশ্যই জানতে পারবে আসলটা কী? অথচ একজন নাগরিক হিসেবে যখন শপথ নেয়া হয়, তখন ভারত শব্দ উচ্চারণ করা হয়। দেশের সংবিধান শুরু হয়েছে ভারত শব্দ দিয়েই। কবিরা ভারতকে হিন্দুস্তান কেন বলেছেন এবং কিভাবে বানালেন সেটা জানা নেই। তবে আজ দেশ স্পষ্টভাবে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের ওপর চলছে। কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন দলের মতাদর্শ নিরেট হিন্দুত্ববাদ এবং বিরোধী দলের ৯০ শতাংশ সেকুলারিজমের দাবিদার।

এ দেশ সেকুলার। এর সংবিধানও সেকুলার। আর সংবিধানই এ দেশে বসবাসরত সব ধর্মের অনুসারীদের একই রকম অধিকার দিয়েছে। তবে বর্তমান সরকার স্পষ্টরূপে হাতির দাঁতের মতো, যেটা খাওয়ার জন্য একরকম এবং প্রদর্শনের জন্য অন্য রকমের নামান্তর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ আওর সব কা বিশওয়াশ’- সবার সাথে সবাইকে সাথে নিয়ে, সবার উন্নয়ন এবং সবার আস্থার কথা বলেন। আর এটাই তার শ্লোগান। তাহলে এটাকে বাস্তবায়ন করা হয় না কেন? যদি এ দেশে কারো সাথে বৈষম্য করা হয়, সেটা বাস্তবায়নের সুযোগ না দেয়া হোক। তার জন্য কাগজে নীতি প্রণয়ন করা হোক। কিন্তু কার্যত এর বাস্তবায়ন না হলে আমরা একে সবার উন্নয়ন কিভাবে বলতে পারি? আজ কোনো আরএসএসের মুখে ভারত শব্দ উচ্চারিত হতে শুনতে পাবেন না। বরং তারা হিন্দুস্তানই বলবে। তাদের মতে এ দেশ হিন্দুদের। তবে তাদের দৃষ্টিতে হিন্দু কারা, এটা এক ভিন্ন প্রশ্ন। কেননা, এই দেশে হিন্দুদের এতটা সামষ্টিক সংখ্যা নেই, যা দাবি করার দলিল হতে পারে। এই দেশের মুসলমানরা গর্বের সাথে হিন্দুস্তান বলতেন। স্বাধীনতার আগে ড. আল্ল­ামা ইকবাল থেকে নিয়ে স্বাধীনতার অনেক পরে, বরং কয়েক বছর আগ পর্যন্ত খুমার বারাবাঙ্কভি পর্যন্ত তাদের বিখ্যাত কবিতাগুলোতে হিন্দুস্তান শব্দই উল্লেখ করেছেন। তাদের পরের কবিরাও তাদের কবিতায় গর্বের সাথে দেশের নাম হিন্দুস্তানই লিখেছেন। কেউই ভারত লেখেননি, ইন্ডিয়াও লেখেননি। সবাই একে হিন্দুস্তানই লিখেছেন। এখন এ প্রশ্ন অবশ্য উত্থাপিত হয় যে, হিন্দুস্তান লেখাতে সমস্যা কোথায়।

এর জবাবও এটাই যে, যখন এ দেশ শুধুই হিন্দুদের নয়, তাহলে এটাকে হিন্দুস্তান কিভাবে লেখা হবে এবং সর্বদা কিভাবে মানব যে, এ হিন্দুস্তান আমার। যেখানে এর ওপর একটি বিশেষ মতাদর্শীদের নিজস্ব আধিপত্য বিস্তার করার হীনউদ্দেশ্য রয়েছে। উর্দু লেখক, কবি-সাহিত্যিকরা কখনো চেষ্টা করেননি যে, ভারত লেখা হোক। হিন্দুস্তান লিখতে তাদের ভালো লাগত এবং তারা এটা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য ও সহজ মনে করতেন। অথচ দেশের একক নাম হিন্দুস্তান রাখার আইনি প্রক্রিয়াকরণও হচ্ছে এবং সেটা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ারও প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের সামনে এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে যে, তারা কি এটা মেনে নেবে? কেননা, যেই সেটা অস্বীকার করবে, তার গায়ে রাষ্ট্রদ্রোহীর ছাপ লেগে যাবে। এ জন্য বিষয়টি বেশ জটিল ও কঠিন আকার ধারণ করছে। তবে এটা স্পষ্ট করাও জরুরি। এ কারণে এখন ইতিহাসবিদদেরও আগ্রহ নেই এবং অতীতের পরিস্থিতির সাথে মোদি সরকারেরও কোনো সম্পর্ক নেই। যারা বিশাল সংখ্যায় মোদির স্লোগান দিচ্ছে, তারা যখন এটা অনুভব করবে, তখনই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। নামে কী আছে, এটা প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু এই চিন্তাকে ছড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। কেননা, ভারত বা এই দেশ এতটা সঙ্কীর্ণ নয় যে, তারা হঠাৎ ভারতকে হিন্দুস্তান বানিয়ে দেবে। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। কেননা, নাম পরিবর্তন দ্বারা জাতীয় নিবন্ধনের ওপরও প্রভাব পড়বে। জাতীয়ভাবে জনগণকে নিজস্ব ভঙ্গিতে শিক্ষা গ্রহণ করতে দেয়া উচিত। মুসলমানদের সমস্যা তো আরো প্রকট। কেননা, তারা একক ধর্মীয় রীতিতে দৃঢ় থাকতে পারবে না। শুধু রাজনীতির কথা বলছি না। এখন এ দৃষ্টিভঙ্গি পুস্তকের মধ্যেও ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের মাঝে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এটা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।

বলা বাহুল্য, এখন ধর্মীয় বিদ্বেষ মাথায় উঠিয়ে প্রকাশ্যে হিন্দু-মুসলমান শ্রেণিভেদ করা হচ্ছে এবং দেয়াল তুলে দেয়া হচ্ছে। আজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য অনুভব করানো হচ্ছে। দেশব্যাপী অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে এ খেলা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভেতর ভেতর সুপরিকল্পিতভাবে এটাকে উত্থাপন করা হচ্ছে। তবে এটা সত্য যে, এ দেশ ভারত হোক, ইন্ডিয়া হোক কিংবা হিন্দুস্তান, তাতে মুসলমানদের জন্য বিশেষ কিছু আসবে যাবে না। কেননা, মার খেতে খেতে মুসলমানদের এমন পরিবেশে থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে। মুসলমানদের কাছ থেকে তাদের শিল্প ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। তাদের পরিচয় মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধর্মীয় বিষয়াবলিতে পূর্ণ প্রতারণার সাথে সংস্করণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তিন তালাকের বিরুদ্ধে প্রণয়নকৃত আইন তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে লোকসভায় এটা আইনে পরিণত হয়েছে এবং কেউ কিছু করতে পারেনি। মুসলমানরা তিন কোটি স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে মাত্র। তিন কোটি মুসলমানের স্বাক্ষর যখন প্রেসিডেন্টের কাছে জমা দেয়া হয়, তখন তিনি এটাকে দেখার প্রয়োজনও বোধ করেননি।

তাহলে মুসলমানরা কার কাছে কিসের আশা করবে? এ জন্য দেশকে ভারত বলা হোক, ইন্ডিয়া বলা হোক কিংবা হিন্দুস্তান বানিয়ে দেয়া হোক তাতে কিছুই আসে যায় না। মুসলমানকে সর্বদা নরম খড়কুটো ভাবা হয়েছে। তারা শেষ হবে না। মুসলমান এভাবেই জুলুম নির্যাতন সইতে সইতে সময় পার করবে।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দু টাইমস হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement