১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিভক্তি না ঐক্য, এখনই ভাবার সময়

-

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। একটি জাতির জীবনে চরম আবেগময় একটি মুহূর্ত। আমাদের জাতীয় জীবনে তো বটেই। কারণ আজ থেকে ৫০ বছর আগে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সামনে রেখে এ জাতি স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৯ মাস যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে অবশেষে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। তবে এ জন্য এ জাতিকে দিতে হয়েছিল অনেক চড়া মূল্য। ঝরাতে হয়েছে এক সাগর রক্ত আর অনেক মা-বোনের সম্ভ্রম। তার পরও ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দুই শতাধিক বছরের যে গোলামির জিন্দেগি সূচিত হয়েছিল, তার অবসানে এ জাতি সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল।

রক্তে কেনা এ স্বাধীনতা তাই এ জাতির জীবনে সব সময়ই বিশেষ কিছু। সবচেয়ে বড় ও গৌরবময় অর্জন। আবালবৃদ্ধবনিতা, বিশেষ করে জাতির ভবিষ্যৎ তরুণ-যুবাদের জন্য অনন্ত প্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যে এ জাতির জীবনে আবেগ ও আনন্দের মিশেলে এক অনন্য মুহূর্ত হিসেবে দেখা দেবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এক বছর আগে এ দেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণ জাতির এ আবেগ-উচ্ছ্বাসে নতুন মাত্রা যোগ করে। গত বছর ১৭ মার্চ জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে শুরু করে বছরব্যাপী নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে মুজিববর্ষ পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু জাতি যখন বিপুল উদ্দীপনায় এ উদযাপন শুরুর দিকে এগোচ্ছিল, তখনই অলক্ষুণে করোনা অতিমারীর ভয়াল থাবা সব পরিকল্পনা লণ্ডভণ্ড করে দেয়। তা সত্ত্বেও সীমিত পরিসরে বছরব্যাপী নানা আয়োজনে মুজিববর্ষ পালন অব্যাহত থাকে। অবশেষে এ বছর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মবার্ষিকীতে ১০ দিনব্যাপী কর্মসূচির মাধ্যমে যার মেলবন্ধন ঘটে সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালার সাথে।

বহুল প্রতীক্ষিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যখন সমাগত, দেশ করোনার প্রাথমিক ধাক্কা ইতোমধ্যে সামলে নিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশকে টেক্কা দিয়ে বাংলাদেশ আগেভাগে করোনার টিকা দেয়া শুরু করতে সক্ষম হয়েছে। করোনার ছোবল আর বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতি। এভাবে যখন করোনার ঝুঁকিমুক্ত অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পরিবেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত বলে অনুমিত হচ্ছিল, তখনই ফের আঘাত হানতে শুরু করল করোনার নতুন ঢেউ। এক দিকে এই নতুন আপদ, অন্য দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিয়ে সৃষ্ট তিক্ত বিতর্ক আনন্দের আমেজকে কেমন যেন বিষিয়ে তুলতে শুরু করে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে নজরকাড়া সব আয়োজনের মধ্যে অন্যতম ছিল বিশ্ব নেতাদের, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো, সরকার/রাষ্ট্রপ্রধানদের অংশগ্রহণ। এদের অনেকেই এ অনুষ্ঠানে সশরীরে অংশ নিয়ে এ আয়োজনকে মহিমান্বিত করেছেন। অন্যরা তা না পারলেও বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করেন এবং এর উত্তরোত্তর আরো উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান। স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অতুলনীয় সহযোগিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ বিবেচনায় এ অনুষ্ঠানে ভারতের অংশগ্রহণ বিশেষ গুরুত্ব পাবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। স্বাধীনতার পর নানা বিষয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের মিঠেকড়া সম্পর্ক সত্ত্বেও ভারত আমাদের আজন্ম বন্ধু এবং নিকটতম প্রতিবেশী। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের স্বাভাবিক রীতি-প্রথা অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই ভারত গুরুত্ব পেতে পারে। এ নিয়ে দ্বিমতের কোনো অবকাশ থাকার কথা নয়। কিন্তু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উগ্র সাম্প্রদায়িক, মুসলিমবিদ্বেষী ও নাগরিকপঞ্জির নামে দৃশ্যত বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকার কারণে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র আপত্তি ওঠে। অনেকে প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসে।

সরকারের জন্য বিষয়টি এক কঠিন সমস্যা তৈরি করে। এক দিকে ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যার কিনা এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশাল ভূমিকা রয়েছে, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের দাওয়াত কবুল করেছেন এবং সাগ্রহে এতে যোগদানের অপেক্ষায় আছেন। অন্য দিকে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদির অতীত ও বর্তমান নিয়ে কঠোর সমালোচনা করে বিভিন্ন সংগঠন যেকোনো মূল্যে তার আগমন ঠেকাতে বদ্ধপরিকর বলে ঘোষণা দিতে থাকে। অবশেষে কিছু সংগঠন ২৬ মার্চ কোনো কর্মসূচি রাখবে না বলে ঘোষণা করায় বিষয়টির একরকম রফা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। তবে অন্য কিছু সংগঠন তাদের অবস্থানে দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকে।

বায়তুল মোকাররম থেকে একদল লোক মোদিবিরোধী মিছিল বের করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এবং দৃশ্যত ক্ষমতাসীন দলের অনেক রাজনৈতিক কর্মীও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি প্রতিবাদকারীদের প্রতিহত করতে মারমুখি অবস্থান নেয়। এ সময় ওখানে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ফেসবুক-ইন্টারনেটের এ যুগে এ খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। কোনো কোনো জায়গায়, বিশেষ করে হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, প্রতিবাদী মিছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের রূপ নেয়। ফলে গত কয়েক দিনে অকালে ঝরে পড়ে অনেক তাজা প্রাণ। প্রতিবাদী মহলের দাবি, অন্তত ১৭ জন গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। ধ্বংস হয়েছে অনেক সহায়-সম্পদ। যে অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল এ দেশের মানুষের অনাবিল আনন্দের উৎস, তা দেখল রক্তে রঞ্জিত রাজপথ। উদ্বেগের বিষয় হলো, সরকারি দলের রাজনৈতিক কর্মীরা সরাসরি সহিংসতায় উসকানি দিয়েছে। কোনো কোনো ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল লোকজন সরাসরি সংঘর্ষে অংশ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাপ্রবাহে কার কতটুকু দায় ছিল সে বিতর্কে না গিয়েও বলা চলে, ইতিহাসচর্চায় আগামী দিনে এ দেশের মানুষ এ ক’টা দিন ভুলে থাকতে পারবে না।

দেশটি স্বাধীন হয়েছিল অনেক রক্তগঙ্গা পেরিয়ে। একজন শান্তিপ্রিয় জননেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ’৭১-এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত রক্তক্ষয় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যখন তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন, তখনো সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে দেশ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এই প্রেক্ষিতেই ভাবনায় আসে, তিনি কেন স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতাকারীদের অনেককেই উদারভাবে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। আমি একটি উত্তরই খুঁজে পেয়েছি; সেটি হলো, তিনি মনে করেছিলেন, এটি বিভেদের সময় নয়, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সময়। ’৯০-এর দশকে বঙ্গবন্ধু তনয়া যখন প্রথমবার সরকার গঠন করেন, তিনিও ঐকমত্যের সরকার গঠনের ডাক দিয়েছিলেন। আমার কাছে তার সেদিনকার আহ্বানকে বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথের অনুসৃতি বলেই মনে হয়েছে।

দেশ ও দশের স্বার্থে একজন জননন্দিত জাতীয় নেতার কর্মনীতি এমনটিই হওয়ার কথা। ইতিহাসে তার প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। ইতিহাস থেকে আমি দু’টি উদাহরণ দেবো। মহানবী সা: যখন মক্কা বিজয় করেন, এত দিন যারা তাঁকে এত কষ্ট দিয়েছে, তাঁকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করতে চেয়েছে, তাদের সবাইকে তিনি উদারভাবে ক্ষমা করে দেন, কোনো প্রতিশোধ নেয়ার কথা চিন্তাই করেননি। তিনি চাইলে সে দিন মক্কায় রক্তের নহর বইয়ে দিতে পারতেন। মক্কাবাসীরা তাঁকে এবং তাঁর সহচরদের যে অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, তাতে এটাই কি তাদের যতার্থ প্রাপ্য ছিল না? কিন্তু মহানবী সা: সে পথে হাঁটেননি। তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিলেন। অনাগত দিনের পৃথিবীবাসীর জন্যে এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এর ফল কী হয়েছিল তা তো ইতিহাস। তাঁর এ মহানুভবতায় এতদিনকার মরণপণ শত্রুদের মস্তক আপনিই নুয়ে পড়ল। এদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও দিগি¦জয়ে অতুলনীয় ভূমিকা রাখলেন। দ্বিতীয় উদাহরণটি নিকট অতীতের। দীর্ঘ সংগ্রামের পর দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ জননেতা নেলসন ম্যান্ডেলা যখন বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে সক্ষম হন, তার এতদিনকার শত্রু শ্বেতাঙ্গ নিপীড়কদের সাথে সব শত্রুতা ভুলে গিয়ে সবাইকে নিয়ে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে হাত দেন। তা না করলে আজো দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের চিরায়ত সঙ্ঘাত অব্যাহত গতিতে বহমান থাকত।

যে প্রশ্নটি আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, দেশ কি এভাবে অনৈক্য, হানাহানি আর বিভ্রান্তির চোরাবালিতে ঘুরপাক খেতে থাকবে? হিংসা হিংসার জন্ম দেয়। রক্তপাত আরো রক্তপাতের পটভূমি তৈরি করে। দেশের প্রধান দু’টি দলের দুই প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান উভয়েই ঘাতকের বুলেটে প্রাণ হারিয়েছেন। কাজেই, প্রিয়জন হারানোর বেদনা অন্য কারো চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কম বোঝেন এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু গত ক’দিনে যেভাবে বুলেটের আঘাতে একের পর এক জীবন ঝরানো হলো, তাতে মনে হতে পারে এ দেশে এখন সবচেয়ে সস্তা বুঝি মানুষের প্রাণ। মনে রাখা দরকার, যারা মারছে আর যারা মরছে- সবাই এই মাটিরই সন্তান। উদ্বেগের ব্যাপার হলো, এত রক্তক্ষয়ের পরও কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। একটি মহল ইস্যুটিকে আরো টেনে নিতে চায়। আবার ক্ষমতাসীনদের তরফে প্রতিহিংসামূলক হামলা-মামলাও অব্যাহত রাখা হয়েছে। এর কোনোটিই কাম্য নয়। দেশকে নামে-বেনামে ক্রমাগত বিভক্ত করে কার কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা হচ্ছে তা গভীরভাবে চিন্তা করার এখনই সময়। দেশী-বিদেশী যেসব মতলববাজ দেশটাকে লুটেপুটে খেতে চায়, তারা কখনোই চাইবে না এ দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হোক। এখন, আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি তাদের ফাঁদে পা দিয়ে দেশকে সর্বস্বান্ত করব, নাকি নিজেদের মধ্যকার বিভেদ কমিয়ে এনে দেশ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেবো। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলে জাতির জীবনে এমন অমানিশা নেমে আসতে পারে, যেখান থেকে বেরোনোর পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।


আরো সংবাদ



premium cement