২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কম্পিউটার গেমের ফাঁদে শিশুরাও

কম্পিউটার গেমের ফাঁদে শিশুরাও - ছবি : সংগৃহীত

পাঁচ ছয় বছর বয়স থেকে বার তের বয়সের ছেলেমেয়েরা এখন নানা ধরনের গেমসে আসক্ত। মা বাবা অনেকসময় সন্তানদের আদর করে ট্যাব বা স্মার্টফোন কিনে দেন। না কিনে দিলে ওরা লুকিয়ে মা বাবার স্মার্টফোন ব্যবহার করে গেমস ও নানা ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে। মা বাবা টের পান যখন তাদের বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কেটে নেয়া হয়। তখনই খোঁজখবর শুরু হয় কেন কাটল, কারা কাটল। ঘরে খোঁজখবর না নিয়ে টাকা লেনদেনের সবচেয়ে বড় কোম্পানির কাছে যাও। সে কোম্পানি কোনো পাত্তা দিলো না। মন আরো খারাপ হয়ে গেল। প্রভাবশালী মা বাপ হলে চার দিকে ফোন লাগান। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। রাগে মন ও মাথা কড়মড় করছে।

শেষ পর্যন্ত জানা গেল ঘরের ভেতর ইঁদুর লুকিয়ে আছে। নিজের অতি আদরের আট বছরের ছেলে গেমস খেলছে। ছেলে বলবে আমি তো জানি না খেলতে টাকা লাগে। বাবা মা বললেন, দেখি তো তুমি কী গেম খেলো। খোঁজ পাওয়া গেল গুলশানের মেইন এভিনিউর উদয় টাওয়ারে গেমস বিক্রেতা কোম্পানির অফিস। এটি একটি ডিজিটাল সার্ভিস কোম্পানি। কোম্পানির নাম ডটলাইন বিডি ডট কম। বিদেশী কোলাবোরেশনের একটি কোম্পানি। নানা ধরনের ডিজিটাল সার্ভিস দেয় এরা। তার মধ্যে গেম বিক্রি করাও একটা সার্ভিস। আপনি এখনই ডটলাইনসের ওয়েবসাইটে গেলেই ফায়ার ফ্রি নামের খেলাটির সন্ধান পাবেন। তাদের একজন অফিসার খুব যত্নসহকারে আমাকে খেলাটি বুঝিয়েছিল। কিন্তু আমি তেমন বুঝতে পারিনি। আমি এমনিতেই টেকনিক্যাল জিনিস বুঝতে পারি না। জীবনের ভেতরও আমি জটিল বিষয়ে প্রবেশ করি না। না বুঝেই সংসার করি। ইতোমধ্যে চুয়ান্ন বছর পার হয়ে গেছে বেশ আরামেই। যত ঝুট ঝামেলা আছে তা আমার বিবি সামাল দেন। আসলে তিনিই এ পরিবারের কর্তা। তিনিই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমি আনন্দে খাই দাই গান শুনি, বই পড়ি। আর মোবাইল ঘাঁটি। করোনাকালে প্রায় সারাদিন শুয়েই থাকি। ঘুমাই না, মোবাইল ঘাঁটি (ব্রাউজ করি)। বিনিময়ে টক ঝাল মিষ্টি ভাষা বর্ষিত হয়। আমিও তা উপভোগ করি সংসারের শান্তির জন্য।

কোম্পানির ডিজিটাল সার্ভিসের হেড জিহাদ সাহেবের সাথে অনেক্ষণ কথা হলো। তিনি খুবই বিনয়ী মিষ্টভাষী। কোম্পানির সমাজসেবামূলক কাজের বর্ণনা দিলেন। জানতে পারলাম কোম্পানি অনেক সমাসজসেবামূলক কাজ করে। কোম্পানির চেয়ারম্যানের মানবতাবাদী মনোভাবের কথা জেনেছি। চেয়ারম্যান দুপুরে সাধারণ স্টাফ, পিয়ন চাপরাশি সবাইকে নিয়ে খাবার খান। তিনি আরো অনেক সমাজকল্যাণমূলক কাজ করেন।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো গেমসের নামে টাকা কাটার কোনো সমাধান হলো না। ফায়ার ফ্রি গেমটা কোম্পানি বিদেশ থেকে কিনে বাংলাদেশে বিক্রি করে। তাদের এ রকম আরো অনেক গেম আছে। এটা একটা ট্র্যাপের মতো। শিশুরা ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক ট্র্যাপে ঢুকে পড়বে। টাকা লেনদেন কোম্পানি ওখানে ওঁৎ পেতে থাকে। ডটলাইনের সাথে টাকা লেনদেন কোম্পানির হয়তো তেমনি চুক্তি। পাহাড় পর্বত জঙ্গলে আদিবাসীরা যেমন ট্র্যাপ বসিয়ে শিকার ধরে ঠিক তেমনি। এটা আমার ধারণা। একবার ঢুকে পড়লে আর বের হতে পারবেন না।

মধ্যবিত্ত মা বাপ ছেলেকে বা মেয়েকে মারধর করছেন মোবাইল কেড়ে নিয়েছেন। তাতেও সমস্যার সমাধান নেই। ডটলাইনের নাকি কিছুই করার নেই। আমি ডটলাইনের ওয়েবসাইটে দেখেছি সেখানে বহু অভিযোগ আপত্তি। সবাই অনুরোধ করছে তাদের আনসাবস্ক্রাইব করার জন্য। আমাদের টাকা কাটা বন্ধ করুন। কিন্তু কে কার কথা শোনে।

কোম্পানির বক্তব্য এটা সিস্টেমের ব্যাপার, তাদের কিছু করার নেই। টাকা লেনদেন কোম্পানির কাছে ফোন করুন তারা আপনাকে মানুষই মনে করবে না। শেষ পর্যন্ত মা বাপ কোম্পানির নম্বর, পিন সবকিছু পরিবর্তন করে হয়তো মুক্তিলাভ করে।

ডটলাইন বলছে, এখানে সাবস্ক্রাইব করার কিছু নেই। আপনি ফায়ার ফ্রিতে ঢুকে আপনার বিকাশ নম্বর বা ক্রেডিট কার্ড নম্বর দিয়ে গেমস খেলবেন। তাহলে অভিযোগের উত্তর দেন না কেন আপনারা?

আপনারা মধ্যবিত্ত মা বাপকে রক্ষা করুন। ধনীরা না হয় চার পাঁচ হাজার টাকাকে টাকা মনে করে না। তাহলে কী একবার গেমে ঢুকলেই তো টাকা কাটার কোম্পানির নম্বরটা রেকর্ড হয়ে গেল। তারপর আর বের হওয়ার পথ খোলা থাকে না। ডটলাইন একটি ব্যবসায়ী কোম্পানি। লাভ আর ব্যবসা তার মূল লক্ষ্য। শিশুদের কল্যাণ দেখা তার কাজ নয়। জিহাদের কাছে তাদের চেয়ারম্যানের যে গুণাবলির কথা শুনেছি তাতে চেয়ারম্যানের কানে ভোক্তাদের অভিযোগগুলো যাওয়া উচিত ছিল। জিহাদ নিজেরও বিষয়টা নিয়ে ভাবার দরকার ছিল। সবাই হয়তো বলবেন এটা কোম্পানির নীতিমালায় পড়ে না।

পরিচালকমণ্ডলী নীতিমালা তৈরি করেন কোম্পানি হয়তো মনে করে শিশু কল্যাণ সরকারি বিষয়। নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর রয়েছে। আবার কথা হলে বা দেখা হলে হয়তো বলবেন, আমরা বিষয়টাকে নিয়ে এভাবে দেখিনি বা ভাবিনি। অপর দিকে টাকা কাটার কোম্পানি একেবারেই মাড়োয়ারি মার্কা একটি কোম্পানি যার একান্ন ভাগ শেয়ারের মালিক হচ্ছে একটি এনজিও ব্যাংক। টাকা কাটার কোম্পানি এ বাজারে একচেটিয়া একটি কোম্পানি। নগদ নামে একটি সরকারি কোম্পানি বাজারে এসেছে। এর সার্ভিস চার্জ টাকা কাটার কোম্পানির চেয়ে অর্ধেক। কিন্তু এর নেটওয়ার্ক খুবই কম। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে মাড়োয়ারি কোম্পানির কাছেই যেতে বাধ্য হয়। ভোক্তাদের অভিযোগ শোনার জন্য যারা রয়েছেন তারা খুবই বাজে ও কর্কশ ব্যবহার করেন। কারণ তারা বাজারের রাজা।

ডটলাইন আরো অনেক ডিজিটাল সার্ভিস দিয়ে থাকে। গেম বিক্রি তাদের ছোট্ট একটি ব্যবসা। টাকা কাটার কোম্পানির সাথেও তাদের চুক্তি রয়েছে। গেম যারা বিক্রি করেন বিশেষ করে শিশুদের গেম তার ব্যাপারে কোম্পানিগুলোর সজাগ থাকা দরকার। সরকারেরও এ ব্যাপারে বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। মা বাবাও তাদের মোবাইল ফোন নিরাপত্তায় রাখবেন, যাতে শিশুরা অনায়াসে তার নাগাল না পায়।


আরো সংবাদ



premium cement