২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

অর্থনীতির প্রকৃত বিকাশ চাই

-

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি নানা বৈপরীত্যে ভরা। কোনো ধরনের অর্থনীতির তত্ত্বের সাথেই এখনকার অর্থনীতির মিল নেই। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি, তাহলে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি প্রহেলিকা। আমাদের গড় আয়ু যেমন বেড়েছে, তেমনই ১৯৭৫-এর পর থেকে গড় আয়ু দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। এর আগে এমনটি কখনো হয়নি। মানব উন্নয়ন সূচকের দিক দিয়ে আমরা অনেক অগ্রগতি করেছি, শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়েছি। এগুলো ইতিবাচক। একই সাথে সুশাসনের অতিদ্রুত অবনতি হয়েছে। শাসনব্যবস্থায় চরম অবক্ষয় ঘটেছে। একটি দেশ যখন মধ্য আয়ের পর্যায়ে উন্নীত হয়, তখন যদি সেখানে সুশাসন না থাকে তাহলে তার অর্থনীতিতে অনেক বেশি বিরূপ প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশে সেটিই ঘটছে।

আমাদের দেশে সামগ্রিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। তার মধ্যে একটি, কৃষি খাত। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ এক কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছিল। এখন আমরা উৎপাদন করছি প্রায় চার কোটি টন। গত ৫০ বছরে এ দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন অন্তত তিন গুণ বেড়েছে।

সব মানুষের সমান সুযোগ সুবিধা অর্জন করা অর্থাৎ সামষ্টিক অর্থনীতি- সে রকম অর্থনীতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। ধনী আরো ধনী হচ্ছে; গরিব আরো গরিব হচ্ছে- এ ধরনের অর্থনীতি দেশে দৃশ্যমান। উন্নত বিশ্বে একজন দরিদ্র মানুষ যার চাকরি নেই- সেও সরকারি ভাতা পায়, চিকিৎসা-শিক্ষাসহ সব ধরনের সেবামূলক সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্র থেকে পেয়ে থাকে। এ রকম একটি অর্থ ব্যবস্থায় সরকারকে ট্যাক্স দিতে কষ্ট হয় না। একটি রাষ্ট্রে যখন জনগণের ৮০ শতাংশ দুঃখ দুর্দশা লাঘবের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে- তখন সাধারণ মানুষ তাদের আয়ের একটি অংশ সরকারকে দিতে কার্পণ্যবোধ করে না। এটি হলো, উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক চরিত্র। এ রকম অর্থনীতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। সে সম্ভাবনাও কম। জনগণ সরকারকে প্রতি বছর যত টাকা ট্যাক্স, ভ্যাট এবং আবগারি শুল্ক বাবদ প্রদান করে- তা রাষ্ট্রের গঠনমূলক কাজে ব্যয় হয় মাত্র ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। বাকি ৫০ শতাংশ অদৃশ্য হয়ে যায়। অর্থাৎ এই বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আয় রাষ্ট্রের কাজে ব্যয় না হয়ে ব্যক্তির পকেটে চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে লুটপাটের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের খবর প্রতিদিনই প্রকাশ পাচ্ছে গণমাধ্যমে। মানুষের উন্নয়ন না ঘটলে দেশের উন্নয়ন হয়েছে- এটা বলা যাবে না। জনগণের উন্নতির ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের অর্থনীতির উন্নতি। একটি দেশের সাধারণ মানুষ যখন ভালো থাকে, তখন বলা যায় দেশটির অর্থনীতির ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি এর উল্টো চিত্র। ৫ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে উঠেছে- ঢাকায় অতি দরিদ্র বেড়েছে চার গুণ। ভিক্ষুকে সয়লাব রাজধানী, প্রায় আড়াই লাখ ভিক্ষুক রয়েছে ঢাকায়। রাজধানীর যেকোনো স্থানে দাঁড়ালে দেখা যাবে- চার থেকে পাঁচজন ভিক্ষুক ভিক্ষা চায়, যা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। রাজধানী ঢাকাতেই দরিদ্র মানুষ সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। তবে দেশে সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে। এই দুই বিভাগে অর্ধেকের বেশি মানুষ এখন বাস করছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। বিশ্লেষকরা এমন দৃশ্য দেখে বলছেন, সরকার যতই বলুক- দেশের অর্থনীতি আগের চেয়ে ভালো হচ্ছে; কিন্তু প্রকৃত অর্থে মানুষের আয় আগের মতো হচ্ছে না। জিনিসপত্রের দাম গত ১০ বছরে দুই থেকে তিন গুণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চার থেকে পাঁচ গুণ বেড়েছে। সেই তুলনায় আয় বাড়েনি। ফলে আয় ও ব্যয়ের বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে না পারলেÑ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। সায়েমের (ঝঅঊগ) গবেষণায় আরো দেখা যায়- আয় কমে যাওয়ায় গত দুই বছরে দেশের অতি দরিদ্র মানুষ খাবার কিনতে আগের চেয়ে শতকরা ৩০ ভাগ খরচ কমিয়েছেন আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে কমিয়েছেন শতকরা ৬৩ ভাগ।

এক তথ্যে জানা যায়, আগে দেশে ২১ শতাংশ মানুষ গরিব ছিলেন- এখন গরিব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। ‘উন্নয়ন’ একটি লোভনীয় শব্দ। এই শব্দ দ্বারা রাজনীতি করা হচ্ছে। মানুষের কল্যাণ ছাড়া দেশ উন্নত হয় না। বিশেষ শ্রেণী নয়- সাধারণ মানুষের উন্নতি ঘটলে বলা যাবে, দেশের সার্বিক উন্নতি ঘটেছে।

পত্রিকার খবরে সম্প্রতি বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব মতে- বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে। একটি কার্যকর অর্থনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে না উঠলে এ রকম অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলতেই থাকবে। গত ২৯ জানুয়ারি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ছিল- টিআইয়ের দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০২০ রিপোর্টে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা টিআই বলছে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। দুর্নীতির ধারণা সূচকে দুই ধাপ অবনতি ঘটেছে বাংলাদেশের। দুর্নীতিই বাংলাদেশের সব অর্জনকে মøান করে দিচ্ছে। বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে আমাদের দেশে সুশাসনের উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। এটা না থাকলে দেশে গরিব মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে ক’জন সাংবাদিক সংবাদ প্রকাশ করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন- মার্ক টালি তাদের অন্যতম। ২০১১ সালে ৮ ডিসেম্বর তিনি ভারতের ইনস্টিটিউট অব স্মল এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে একটি বক্তব্য দেন, যা অর্থনীতির জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন- ‘কে বড়, কে ক্ষুদ্র তা গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ এ ধরনের একটা কথাই অর্থনীতিবিদ ই এম শুমাখার আমাদের শিখিয়েছেন। ‘অর্থনীতির মূলে থাকবে মানুষ’- ক্ষুদ্র মানুষই গড়ে তুলবে বৃহৎ অর্থনীতি। ক্ষুদ্র উদ্যোগের মধ্যেই রয়েছে সৌন্দর্য। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিন্দু বিন্দু উদ্যোগেই সৃষ্টি হয় সিন্ধুসম কল্যাণ।

লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement
ইভ্যালির রাসেল-শামীমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেম্যান আর নেই বিএনপি নেতাকর্মীদের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ খণ্ডালেন ওবায়দুল কাদের আটকের পর নাশকতা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলো ইউপি চেয়ারম্যানকে বদর যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন পণবন্দী জাহাজ ও ক্রুদের মুক্ত করার প্রচেষ্টায় অগ্রগতি হয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঝালকাঠিতে নিখোঁজের ২ দিন পর নদীতে মিলল ভ্যানচালকের লাশ বাল্টিমোর সেতু ভেঙে নদীতে পড়া ট্রাক থেকে ২ জনের লাশ উদ্ধার যুক্তরাষ্ট্রে ছুরিকাঘাতে নিহত ৪ সুইডেনে বসবাসের অনুমতি বাতিল কুরআন পোড়ানো শরণার্থীর ভালো আছেন খালেদা জিয়া

সকল