২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

পশমিনা, শাহতুশ এবং কাশ্মির

পশমিনা, শাহতুশ এবং কাশ্মির - ফাইল ছবি

পাকিস্তানে প্রতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি ‘কাশ্মির সংহতি দিবস’ পালন করা হয়। অধিকাংশ পাকিস্তানির জন্য এই দিবসের অর্থ, ঘরে বসে ছুটি কাটাও। কিছু পাকিস্তানি এটাও জানে যে, পাকিস্তান শব্দে ‘ক’ কাশ্মিরের প্রতিনিধিত্ব করে এবং কাশ্মিরকে পাকিস্তানের ‘প্রধান ধমনী’ বলা হয়। কেননা পাকিস্তানের সব প্রধান নদীর পানি অধিকৃত জম্মু-কাশ্মির থেকে এসেছে। খুব অল্প পাকিস্তানিই এটা জানে যে, ২০১৯ পর্যন্ত উর্দু অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরের একমাত্র সরকারি ভাষা ছিল। ৫ আগস্ট, ২০১৯ অধিকৃত এ রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্তির পর উর্দু ভাষার বিশেষ মর্যাদাও বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং নতুন দিল্লি থেকে জারিকৃত একটি ঘোষণায় বলা হয়, আগামীতে শুধু উর্দু নয়, বরং ইংরেজি, হিন্দি, কাশ্মিরি ও ডোগরি ভাষাও অধিকৃত রাজ্যের সরকারি ভাষা হবে। উর্দু ভাষাকে হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীরা শুধু মুসলমানদের ভাষা মনে করে থাকে এবং দীর্ঘ দিন ধরে অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে এই ভাষার বিলুপ্তি চাচ্ছিল। কিন্তু উর্দু ভাষা কাশ্মিরি সভ্যতা ও কৃষ্টির অংশ হয়ে গেছে। ১৮৮৯ সালে মহারাজা প্রতাপ সিং ফারসির স্থলে উর্দুকে কাশ্মির রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। কেননা এ ভাষাতেই কাশ্মির উপত্যকা ছাড়াও জম্মু ও লাদাখেও কথা বলা ও ভাবের আদান-প্রদান হতো। এখনো শুধু কাশ্মির অংশ থেকে উর্দু ভাষায় ৫৯টি দৈনিক ও ২৯টি সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং জম্মু থেকে ২৪টি দৈনিক ও ৩৯টি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট কয়েক বছর আগে উর্দুকে দাফতরিক ভাষা বানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা বাস্তবায়ন করা হয়নি। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের সব গুরুত্বপূর্ণ রায় ইংরেজিতে লেখা হয়ে থাকে। কিন্তু অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরের দাফতরিক ভাষা উর্দু। নয়াদিল্লি থেকে জারিকৃত ফরমান বিধিবদ্ধ আইনি মর্যাদা ওই সময় পাবে, যখন রাজ্য অ্যাসেম্বলি এই আইন মঞ্জুর করবে। আর রাজ্য অ্যাসেম্বলি ২০১৮ থেকে স্থগিত হয়ে আছে।

শুধু উর্দু ভাষাই নয়, বরং অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরের মুসলমানও উগ্রপন্থীদের লক্ষ্য। ৫ আগস্ট, ২০১৯ ভারতীয় সংবিধানের ধারা ৩৭০ ও ৩৫-এ বাতিল করে সুপরিকল্পিতভাবে রাজ্যের অধিকাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু বানানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে এবং এ রাজ্যে বহিরাগতদের বাসিন্দা বানানো হচ্ছে। কাশ্মিরিদের ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত পরিচয়কে বিলুপ্ত করা ছাড়াও তাদের অর্থনীতিকেও ধ্বংস করা হচ্ছে। একদিকে কাশ্মিরি ছাত্র-ছাত্রী এবং কাশ্মিরি ব্যবসায়ীদের ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বের করে দেয়া হচ্ছে, অপর দিকে কাশ্মিরে স্থানীয় শিল্পকেও ধ্বংস করা হচ্ছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে অব্যাহত জুলুম-নির্যাতনে হাজার হাজার কাশ্মিরি নারী বিধবা হয়েছেন। অধিকাংশ অসহায় বিধবা নারী শাল কারখানা-ইন্ডাস্ট্রিতে আশ্রয় পেতেন। কিন্তু কিছু দিন ধরে কাশ্মিরের শাল ইন্ডাস্ট্রি এক মারাত্মক সঙ্কটময় সময় পার করছে। পাকিস্তানে যখন ৫ ফেব্র“য়ারি কাশ্মিরিদের পক্ষে সভা-সমাবেশ ও র‌্যালি বের করা হয়, তখন কাশ্মিরের স্বাধীনতার স্লোগান তো অবশ্যই দেয়া হয়, কিন্তু কাশ্মিরিদের এই সমস্যা নিয়ে কথা বলা হয় না, যার সমাধান না হওয়ার কারণে তাদের বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ছে। কাশ্মিরের শাল ইন্ডাস্ট্রির সাথে কমপক্ষে সাত লাখ মানুষ জড়িত, যেখানে একটি বিশাল অংশ হচ্ছে নারীদের।

বিশ্বজুড়ে কাশ্মিরে তৈরি পশমিনা ও শাহতুশ শালের খ্যাতি রয়েছে। শত শত বছর আগে যখন এ শিল্প শুরু হয়, তখন এটা কাশ্মির উপত্যকার শাল বুননকারী ও লাদাখবাসীকে এক অর্থনৈতিক সম্পর্কে বেঁধে ফেলে। কাশ্মিরের শাল বুননকারীরা লাদাখের পশমিনা (পশমধারী) ছাগলের লম্বা লম্বা চিকন পশম থেকে তৈরি কাঁচা সুতা (উল) থেকে শাল তৈরি করত। এ শাল ইউরোপে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকলে, ডোগরা শাসকরা শাল বুননকারীদের ওপর কর আরোপ করেন। সর্বপ্রথম মহারাজা গুলাব সিং শাল বুননকারীদের ওপর কর আরোপ করলে তারা কাশ্মির ত্যাগ করে লাহোর ও অমৃতসরে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু গুলাব সিং তাদের গৃহবন্দী করে ফেলেন। মহারাজা রনবীর সিং তাদের ওপর আরো কর আরোপ করলে ২৪ এপ্রিল, ১৮৬৫ সালে শ্রীনগরে কাশ্মিরি শাল বুননকারীরা এক শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করে। ওই মিছিলে গুলি করা হয় এবং ২৮ জন কাশ্মিরি শহীদ হন। এ প্রতিবাদ মিছিল মূলত ভারতে শ্রমিকদের নিজেদের অধিকারের পক্ষে প্রথম সুগঠিত প্রতিবাদ ছিল ক্ষমতার বলে যাকে দমন করা হয়েছিল।

১৯৯০ সালে অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে স্বাধীনতা আন্দোলন জোরালো হলে নয়াদিল্লিতে বসে ষড়যন্ত্রকারী শাসকরা লাদাখবাসীদের শ্রীনগরের বিরুদ্ধে উসকে দিতে শুরু করে। যখন শ্রীনগরে স্বাধীনতার স্লোগান জোরালো হতে লাগল, তখন নয়াদিল্লি লাদাখবাসীদের বলল, তোমরা লাদাখকে জম্মু-কাশ্মির থেকে পৃথক করার দাবি জানাও। সর্বপ্রথম লাদাখ বুড্ডিস্ট অ্যাসোসিয়েশন শুধু লাদাখকে জম্মু-কাশ্মির থেকে পৃথক করার দাবি করেনি, বরং কাশ্মিরিদের সামাজিক বয়কট করে তাদের কাছে পশম বিক্রি করতেও অস্বীকৃতি জানায়। ভারতের শাসকরা লাদাখবাসীর কাঁচা পশমি সুতা লুধিয়ানার মিলগুলোতে বিক্রি করতে উৎসাহিত করেছেন। এর দ্বারা কাশ্মিরের শাল ইন্ডাস্ট্রি মারাত্মকরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে পশমি সুতা (উল) শুধু লাদাখেই উৎপন্ন হয় না; বরং চীন, নেপাল ও মঙ্গোলিয়াতেও উৎপন্ন হয়। কাশ্মিরের শাল ইন্ডাস্ট্রি থেকে কয়েক জন ভারতীয় আমদানিকারকও ফায়দা নিতে থাকেন। তারা শাল বুননকারীদের মঙ্গোলিয়া থেকে কাঁচা পশমি সুতা এনে দিতে শুরু করেন। কিন্তু মঙ্গোলিয়ার পশমি সুতা শালের মূল্য বাড়িয়ে দেয় এবং এতে কাশ্মিরি শালের চাহিদা কমে যায়। পাশাপাশি, ভারত সরকার তিব্বতের বরফ অঞ্চলের চিরু হরিণের পশম দিয়ে তৈরি শাহতুশ শালের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তাদের দাবি, হরিণ মেরে কাঁচা মাল সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে কাশ্মিরের শাল ইন্ডাস্ট্রি মারাত্মক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে এবং হাজার হাজার ব্যক্তি এ কাজ ছেড়ে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান কী করতে পারে?

পাকিস্তান ও চীন আগে থেকেই ‘প্যা’ নামে অর্থনৈতিক সহযোগিতার কয়েকটি প্রকল্প শুরু করেছে। পাকিস্তান ও চীনের যৌথ উদ্যোগে গিলগিট ও সিংকিয়াংয়ের উঁচু পাহাড়ি এলাকায় পশমিনা ছাগলের বৃদ্ধি ও পশমি সুতা উৎপাদনের প্রকল্প শুরু করা উচিত। এ ছাড়া তিব্বতের বরফ অঞ্চলের চিরু হরিণের পশম থেকে তৈরি করা শাহতুশও চীন থেকে আনা যেতে পারে। এ কাঁচামাল ওপারের কাশ্মিরিদের অনেক কাজে আসতে পারে এবং আজাদ কাশ্মিরেও কাশ্মিরি শাল ইন্ডাস্ট্রি উন্নয়ন করা যেতে পারে। আজাদ কাশ্মিরে শাল ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নে মূলত পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উপকার হবে। কাশ্মিরিদের সাথে সংহতি প্রকাশের সর্বোত্তম পন্থা এটাই যে, পশমিনা ও শাহতুশ সুতা (উল) উৎপাদনসহ এমন প্রকল্প শুরু করা, যা কাশ্মিরিদের কৃষ্টি ও ভাষাকে উগ্রপন্থীদের নোংরা পরিকল্পনা থেকে রক্ষা করবে।

পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
ঢাবির কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে প্রথম হয়েছেন যারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত ইন্টার্ন চিকিৎসকদের নিজ দেশে ৫ বছর পর ফিরল দিপক চট্টগ্রামে ৬ কিশোর গ্যাংয়ের ৩৩ সদস্য আটক শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠন মজবুত করতে হবে : শামসুল ইসলাম ইউরো ২০২৪’কে সামনে রেখে দল নির্বাচনে বিপাকে সাউথগেট ভারতীয় পণ্য বর্জনকে যে কারণে ন্যায়সঙ্গত বললেন রিজভী মাকে ভরণ-পোষণ না দেয়ায় শিক্ষক ছেলে গ্রেফতার প্রথম বাংলাদেশী আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির এলিট প্যানেলে সৈকত ঢাবির সব ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিরাপত্তা-বিষয়ক আলোচনা করতে উত্তর কোরিয়ায় রুশ গোয়েন্দা প্রধান

সকল