২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট - ছবি : প্রতীকী

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। অবস্থাদৃষ্টে মাঝে মধ্যে মনে হয়, আজকের বাংলাদেশে ১৭৫৭ সালের হাওয়া বইছে। এখন যদিও কোনো রাজা বাদশা বা নবাব বাংলাদেশের অধীশ্বর নন। সেই ‘গান-পাউডার’-এর যুগও আজ নেই। পৃথিবী অনেক দূর এগিয়ে এসেছে এত দিনে। গণতন্ত্রের যুগ, আণবিক বোমার যুগ এটি। দেশে দেশে যেমনই হোক গণতান্ত্রিক শাসনের আবহ বিদ্যমান। রাজতন্ত্র কোথাও কোথাও আছে তবে সেই সাবেকি লেবাসে আজকের দুনিয়ার দু-একটি দেশ ছাড়া আর কোথাও নেই। পরিপ্রেক্ষিত বিস্তৃত করব না। বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ রাখলাম।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কেউ কেউ উচ্চকণ্ঠে দাবি করছেন, তারা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। এর বিপক্ষ সোচ্চার এই বলে যে, গণতন্ত্রের কিছুই নেই, তারাই তা প্রতিষ্ঠা করবেন।

একটু পেছনের ইতিহাস টানি। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর আসমুদ্র হিমাচল বিস্তৃত মুঘল সাম্রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে শুরু করে। ১৭২৬ সালে তুরস্ক থেকে আগত সুচতুর যোদ্ধা ও কূটনীতিক আলিবর্দী খাঁ মুঘল সরকারের দুর্বলতার সুযোগে পাটনা থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত মার্চ করে চলে আসেন। ১৭৪০ সালের এক সফল যুদ্ধের পর তিনি বাংলার নবাব হন। অবশ্য এর আগেই তিনি দিল্লির দরবারের নেক নজরে পড়ে মহাব্বত জং উপাধি লাভ করেন। এই আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র ২৪ বছর বয়সের যুবক সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলার নবাব হন। তখন থেকেই শুরু হয় ইংরেজদের ষড়যন্ত্র। এবং নানা দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতের ভেতর দিয়ে ইংরেজ রবার্ট ক্লাইভের ষড়যন্ত্র সফল হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের এই অংশের অবতারণা করলাম এই কারণে যে, আজকের বাংলাদেশের পরিস্থিতির সাথে হুবহু মিল না থাকলেও, উভয় অবস্থারই ভাবগত মিল লক্ষণীয়।

১৯৯১ সাল থেকেই বাংলাদেশের সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে একটি রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে এবং তা দিন দিন ঘনীভূত হয়ে এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, এ সঙ্কটের সমাধান উভয়েরই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে এ সঙ্কটের গুণগত এবং মাত্রাগত পরিবর্তন এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে, আমার মনে হয় এ সঙ্কট বর্তমান সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যকার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের সীমানা অতিক্রম করে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রাচীরে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। যে পথে আজকের দিনের ‘রবার্ট ক্লাইভ’ এবং ‘আমিন চাঁদ’রা ঢুকে পড়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের সরকারি দল এবং বিরোধী দল জানত না নির্বাচন অনুষ্ঠানকারী অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান হওয়ার যোগ্যতা দেশের কোন ব্যক্তি রাখেন বা রাখেন না, কিন্তু তা জানতেন বাংলাদেশে মার্কিন মুলুকের তদানীন্তন রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিল এবং খুলনা ও যশোরে তৎপর তার সহকর্মীরা। যেমন-১৭৫৭ সালে রবার্ট ক্লাইভ জানতেন সিরাজ-উদ-দৌলাকে হটিয়ে কাকে বাংলার নবাব বানানো যায়।

১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ সৈন্য এবং নবাবের সৈন্যরা যুদ্ধে নেমেছেন। বাংলাদেশের জনগণ দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য উপভোগ করেছেন। কোথায় যেন পড়েছিলাম যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেদিন পলাশীর তামাশা দেখেছেন, তারা যদি ইংরেজদের দিকে একটি করে ঢিল ছুঁড়তো তাহলে ইংরেজরা সেদিন পালাবার পথ পেতো না। আজো দেখছি একই দৃশ্য। সরকারি দল আর বিরোধী দল ঝগড়া করছে আর বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন রাষ্ট্রদূত মেরিল নামক ‘ক্লাইভ’দের ঘাড়ের রগ মোটা হচ্ছে- বোতল থেকে দৈত্য বেরিয়ে পড়ছে। মেরিলদের তৎপরতায় এবং উদ্যোগের ফলেই যদি উভয় দলের ঝগড়া থামে, তবে মেরিলদেরকে কি আর কূটনৈতিক রীতিনীতির নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে? না। এখন তারা সেসব রীতিনীতি মেনে চলছেন না। বাংলাদেশে নিয়োজিত বিদেশী কূটনীতিবিদদের এসব রীতিনীতি মানার প্রয়োজন নেই! বাংলাদেশ স্বাধীন এবং এ দেশে গণতন্ত্র আছে- এরই বা কি অর্থ জনগণ যেখানে দৃশ্যপটে নেই?

১৯৯৫ সালের রাজনৈতিক সঙ্কটকালে সরকারি এবং বিরোধী দলের নেতাদের অনেকেই মার্কিন মুলুকে বিস্তর সফর করেছেন। সরকারি দলের নেতাদের সফরের বাহ্যিক কারণগুলো পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছে কিন্তু বিরোধী দল নেত্রী এবং অন্যান্য নেতারা এতবার কেন মার্কিন মুলুক সফর করলেন তা জানা গেল না। আমরা বাংলাদেশের জনগণ মূর্খ, কিছুই বুঝি না! মার্কিন মুলুকে আমাদের দেশের নেতাদের সফরকে একটি বিরাট অর্জন বলে মনে করি!

ইদানীং দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীনদের ভারতনির্ভরতায় আমরা চিন্তিত। জনগণ এবং গণতন্ত্রকে চিরকালের মতো নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে বলে মনে হয়। জনগণ এখন আর ভোটের ব্যাপারে উৎসাহিত নয়। আমেরিকা, চীন ও ভারতের নেতৃত্বে এ এলাকায় বাজার অবাধ হবে, এটাই স্বপ্ন। রাজনীতি তখন কোথায় যাবে চলে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বলতে কিছু থাকবে না। বাজার এখনো সম্পূর্ণ অবাধ হয়নি সত্য, তবে রাজনীতি যেখানে যাওয়ার সেখানে চলে গেছে মনে হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতি যে বাংলাদেশীদের হাতে নেই তা ১৯৯৫ সালে পাঁচ-বুদ্ধিজীবী কর্তৃক গৃহীত সঙ্কট নিরসনের উদ্যোগের লজ্জাজনক ব্যর্থতা থেকে বোঝা গেছে। সে সময়ে নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ অন্তর্কলহে বিদেশীদের এভাবে জড়িয়ে ফেলা কি সরকারি দল, কি বিরোধী দল, কোনো দলের ভাবমূর্তিকেই উজ্জ্বল করেনি। বরঞ্চ এটি তারা একটি আত্মঘাতী কাজ করে ফেলেছিলেন।

আত্মমর্যাদাশীল কোনো জাতি এটি মেনে নিতে পারে না। জনগণ ইদানীং ভোটকেন্দ্রে যায় না। যে জনগণ একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশে পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটাল তাদের পুরোপুরি উপেক্ষা করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণের তাবৎ অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের কথিত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা যে নিছক লোক দেখানো তা আজ স্পষ্ট হয়ে গেছে। দেশে গণতন্ত্র নেই। রাজনীতিকদের স্বাধীনতা বিপন্ন। এমতাবস্থায় দেশের স্বাধীনতা কতটা অর্থবহ?

এ বিষয়টি দেশের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতিকদের স্বার্থান্ধ চোখে ধরা না পড়লেও, দেশের সচেতন জনগণকে ভাবিয়ে তুলেছে। দেশের আপামর জনগণ যদি রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরির হোতাদের ও তাদের সব কর্মকাণ্ড মুখ বুজে মেনে নেয়, তবে বুঝতেই হবে ’৭১-এর অর্জন ব্যর্থ। নতুবা বুঝতে হবে, জনগণ ১৭৫৭ সালে পলাশী নাটকের তামাশা প্রত্যক্ষকারীর পর্যায়েই রয়ে গেছে। দেশ শাসনে তাদের সেদিন যেমন কোনো ভূমিকা ছিল না, আজো নেই।

আজ ২০২১-এ জনগণ চায় ১৭৫৭-এর ছদ্মবেশী নবাবরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরে দাঁড়াক। জনগণের হাতে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ফিরিয়ে দিক কিংবা জনগণ ’৭১-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে উভয় পক্ষের ছদ্মবেশী নবাবদের হাত থেকে রাজনীতি করার ক্ষমতা ছিনিয়ে নিক। দেশকে একটি শুদ্ধ গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করুক। দেশের জনগণকে শুধু ভাত-কাপড় আর ভোটের কাঙাল যারা মনে করেন তাদের স্মরণ রাখা উচিত, মর্যাদাপূর্ণ জাতিসত্তাও এ দেশের জনগণের কাম্য। ভাত কাপড় যারা পাচ্ছে না তারা বিদ্যমান ব্যবস্থায় যেমন ভোট দিলেও পাবে না, না দিলেও পাবে না। তেমনি যারা পাচ্ছে তারা ভোট দিলেও পাবে, না দিলেও পাবে- ভোট যাকেই দিক না কেন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটি পথ রাজনীতিকদের বের করতেই হবে। নইলে দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে এবং নেতাদের আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার দুয়ারও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে সরকারের সে কথা ভাবতে হবে। অন্যথায় দেশের পার্থিব উন্নয়নের যে বড়াই সরকারি দল আজ করছে তা বিফলে যাবে।

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ও ভাইস প্রিন্সিপাল,
মহিলা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা


আরো সংবাদ



premium cement