১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’

-

ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণফসল হলো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। ২১ ফেব্রুয়ারি এ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সাধনা ও সংগ্রামের ইতিহাস। ‘The Mother Language Lovers of the world’ নামক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা কানাডা প্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার আবেদন জানান। তাদেরই প্রচেষ্টায় এবং বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) ১৬০তম অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ করা হয়। মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ওই দিনই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ঘোষণায় বিশ্বের প্রায় আট হাজার মাতৃভাষা সম্মানিত হলো। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কোর সদর দফতরসহ ১৯৪টি সদস্য দেশে নিজ নিজ মাতৃভাষার আলোকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালিত হচ্ছে। দিবস তাই বাঙালি জাতির ইতিহাসে গৌরবময় ও অবিস্মরণীয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক অবদান সর্বজনবিদিত। ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, ভাষার জন্ম আজ থেকে পাঁচ লাখ বছর আগে। ভাষা আন্দোলন এ জাতির জীবনে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা, যা বাঙালি কখনো ভুলতে পারে না। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়নি। ভাষা আন্দোলন ছিল ‘লাহোর প্রস্তাব’ অনুযায়ী পাকিস্তান আন্দোলনেরই বর্ধিতরূপ। ইতিহাসের পেছনে যেমন ইতিহাস থাকে, তেমনি বায়ান্নর পেছনেও ছিল আটচল্লিশ। ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ সংঘটিত হয় বাংলা ভাষার দাবিতে প্রথম সফল গণবিস্ফোরণ। আমরা দেখেছি ১৯৪৭ সালেও রয়েছে ভাষা আন্দোলনের এক গৌরবময় সূচনা-পর্ব। বায়ান্নর গোড়ায় যেমন ছিল আটচল্লিশ, তেমনি আটচল্লিশের গোড়ায় ছিল সাতচল্লিশ। বলতে গেলে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি রচিত হয়েছিল ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টে ভারতবর্ষ ভাগাভাগির মাধ্যমেই। সে হিসাবে বলা যায় ১৪ আগস্টের আগে রচিত হয় ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত-পর্ব, তেমনি ১৯৪৭ সাল ছিল এ আন্দোলনের সূচনা-পর্ব। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম সফল বিস্ফোরণ এবং বায়ান্নর একুশ ফেব্রুয়ারি ছিল চূড়ান্ত বিস্ফোরণ-পর্ব। এর একটাকে অন্যটা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার উপায় নেই। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই আমাদের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার চেতনা তথা স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও সূত্র অন্বেষণ করতে গেলে সবার আগে মনে আসে বহু ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথা। এর পরেই আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাশেম ও তমদ্দুন মজলিসের ঐতিহাসিক ভূমিকা।

মাতৃভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মানুষ অর্জন করে। রাষ্ট্রভাষা শিক্ষা দ্বারা, সাধনা দ্বারা, জ্ঞান-গরিমা নিয়ে অর্জন করতে হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে রাষ্ট্রভাষা সক্রিয় থাকে। চর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষাকে বিকাশশীল রাখতে হয়। মাতৃভাষা দ্বারা জীবনটাকে বেশি উপভোগ করা যায়। আর মাতৃভাষকে অবলম্বনে করেই রাষ্ট্রভাষা গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রভাষা কেবল সংবিধানে থাকলে হবে না, রাষ্ট্রীয় জীবনে সম্ভাব্য সর্বস্তরে তার প্রকৃষ্ট ও জীবন্ত ব্যবহার থাকা দরকার। রাষ্ট্রভাষা তথা জাতীয় ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে প্রয়োজন ‘জাতীয় ভাষানীতি’। অনেকের ধারণা মাতৃভাষা পরিমণ্ডলের বাইরে বাংলা ভাষার ব্যবহার স্থায়ী হবে না। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের মতো’। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, মাতৃভাষাকে ছোট করা মানে, নিজের মাকে ছোট করা। সরোজিনী নাইডু বলেছেন, ‘মাতৃভাষা একটি জাতির হৃদয়, একজন মানুষের আত্মা’। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহের বহু ভাষায় পাণ্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের মাতৃভাষা বাংলা চর্চা করতেন। তিনি জানতেন, মাতৃভাষা চর্চা ছাড়া ও মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে কোনো ভাষা ভালোভাবে শেখা যায় না। মাতৃভাষা মানুষের একান্ত আপন। মাতৃভাষা সৃষ্টিকর্তার সেরা দান। মানুষ যদি তার মাতৃভাষাকে যথাযথ সম্মান ও মূল্যায়ন না করতে পারে তাকে চিরদিন গ্লানিতে ডুবে থাকতে হয়। মাতৃভাষার মর্যাদা জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক। যারা মাতৃভাষার মর্যদা দেয় না তারা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে মূলত বিশ্বাস করে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভাষা মাত্রই সামাজিক। সমাজ পেছনে পড়ে থাকলে ভাষা এগোতে পারে না। তাই সমাজের দরিদ্রতা, বৈষম্য, নিরক্ষরতা দূর করে মাতৃভাষা বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটাতে হবে। মাতৃভাষা বাংলা বাঙালির জীবনে খরস্রোতা নদী আর শহীদ মিনার ‘বাঙালির হিমালয়’।

১৯৫২ সালের রক্তঝরা একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতিসত্তার চাবিকাঠি। ১৯৪৭ পরবর্তী জাতীয় জীবনে সব গণজাগরণ, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনার মূলে জড়িয়ে আছে ফেব্রুয়ারি মাসের স্মৃতি। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন জাতির সংগ্রামী চেতনার মহাকাব্য। এটি কোনো সাধারণ সন তারিখ নয়। এটি শোক, প্রেরণা, শপথ আর অঙ্গীকারের মিলিত স্রোতোধারা। ২১-এর পথ ধরেই বাঙালি হেঁটেছিল স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার দিকে। মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে বাংলাদেশের মানুষ। ২১ ফেব্রুয়ারি একই সাথে শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি দেশের সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সম্প্রসারিত। আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আর ইতিহাসের কাছে ফিরে যাওয়ার তাগিদ দেয় একুশে ফেব্রুয়ারি। রফিক, শফিক, সালাম, বরকত জব্বার, আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহসহ অনেকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের বীর। তারা তাদের জীবন উৎসর্গ করে ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধিকার, অধিকার ও স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে দেদীপ্যমান। ২১ ফেব্রুয়ারির ইতিহাস ছাত্র-জনতার ইতিহাস। এর নায়ক কিম্বা মহানায়ক তারাই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আমাদের জীবনে দিগন্তবিস্তারী প্লাবন ডেকে এনেছিল। ভাষাকে প্রতিক্রিয়াশীলতা ও নির্মমতার আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্য এসেছিল অমর একুশে। তাই ভাষার দাবি বাঁচার দাবি, ভাষার আন্দোলন আমাদের বাঁচার আন্দোলন। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় চেতনার প্রথম সূর্যসিঁড়ি। এটা কেবল ভাষার লড়াই নয়, তা আমাদের জাতীয় চেতনার উর্বর উৎসব। জাতির জীবনে তাই ভাষা আন্দোলন দুর্জয় সংগ্রামী চেতনার প্রসূতি। একুশ মানে নিজেকে চেনা। একুশের চেতনার মূল জায়গায় শুধু ভাষার দাবি ছিল না। এ দাবি ছিল গণতন্ত্রের দাবি। আর এ দাবির ধারাবাহিকতাতেই আন্দোলন হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, একটা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুত্থান আজ ঐতিহাসিক বাস্তবতা।

আমরা বাংলা ভাষার অধিকার অর্জন করেছি; কিন্তু ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারিনি। ভাষার কারণে এত প্রাণের বিসর্জনের পরেও মাতৃভাষা বাংলা নিজ দেশে যেন অনেকটা উপেক্ষিত! ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা আর ভাষাকে সমৃদ্ধ করা এক নয়। তাই বলে ইংরেজি চর্চা বর্জন করতে হবে তা কিন্তু নয়; বরং ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রেও ইংরেজি জানা বেশি প্রয়োজন। ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও মর্যাদা যেন ২১ ফেব্রুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসকেন্দ্রিক না হয়। সুতরাং মাতৃভাষা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নিতে হবে আজ।

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা


আরো সংবাদ



premium cement