২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

গণতন্ত্রের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন জরুরি

গণতন্ত্রের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন জরুরি - ফাইল ছবি

গত ১৭ জানুয়ারি দেশের বিশিষ্ট বিয়াল্লিশজন নাগরিক নির্বাচন কমিশনার ইসির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সপক্ষে অতিরিক্ত কিছু তথ্য দিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে তৃতীয়বার চিঠি দিয়েছেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি চিঠির অনুলিপি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এর আগে ১৪ ডিসেম্বর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বর্তমান ইসির বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে প্রচারিত আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ সংশ্লিষ্ট অনিয়ম, গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগের তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে প্রেসিডেন্টকে প্রথম চিঠি পাঠিয়েছিলেন নাগরিকরা। দ্বিতীয় চিঠির সাথে নির্বাচন কমিশনের প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ সম্পর্কিত অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাত পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদনের কপি সংযোজন করা হয়। দ্বিতীয় চিঠিতে বলা হয়, দীর্ঘ ৯ মাসের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের অধীনস্থ ইলেকটোরাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ভয়াবহ দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়ম সম্পর্কে ২০১৯ সালে বৈশাখী টেলিভিশনে সাত পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। বিশিষ্ট নাগরিকদের পক্ষে পাঠানো চিঠিতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে এটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। কমিশনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত নয় কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের ট্যাক্সের টাকা অভিনব কৌশলে ভাগবাটোয়ারা করে নয়; বরং নিরপেক্ষভাবে জনকল্যাণে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা এবং কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান।

এ দিকে দেশজুড়ে চলছে নির্বাচন। স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন। কয়েক ধাপে পৌরসভা নির্বাচন হয়েছে। আর বাকি আছে কয়েক ধাপ। এরপর হবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এ দেশে একসময় নির্বাচন মানে ছিল উৎসব, বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন মানেই গ্রামেগঞ্জে আনন্দের ফোয়ারা ছোটা। উৎসবের সেই রঙ বিবর্ণ হয়েছে অনেক আগেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, একতরফা নির্বাচন এখন আর মানুষকে টানে না। নির্বাচনের আসল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে কার সাথে? স্বাভাবিকভাবে গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের মধ্যে নির্বাচন হয়। প্রতিযোগিতা হয় বিরোধী দলের প্রার্থীদের মধ্যেও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র অর্থাৎ নির্দলীয় প্রার্থীরাও ভোটের ভাগে কামড় বসান। কিন্তু গত প্রায় এক দশকে জাতীয়-স্থানীয় যত নির্বাচন হয়েছে, বিরোধী দলের কোথাও পাত্তা নেই। নির্বাচনী প্রচারণা পর্যন্ত চালাতে পারেনি তারা। যেখানে একটু দাঁড়াতে চেয়েছে, দলে দলে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পিটিয়ে মাঠ ফাঁকা করে দিয়েছে। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের চাপে ও তাপে তাদের অবস্থা ছিল জয়-পরাজয় পরের ব্যাপার, অংশগ্রহণই যথেষ্ট। তারা অংশ নিয়েছে বা পরিস্থিতির কারণে তাদের অংশ নিতে হয়েছে। এ ধরনের অসম মাঠে কোনো সুষম প্রতিযোগিতা হতে পারে না, হয়ওনি।

এ দিকে পৌরসভা নির্বাচন চলছে। ক্ষমতাসীনদের দাপটে বিরোধীরা মাঠে অবস্থান করতে পারছে না। ভোটের চিত্র দেখলে বিস্মিত হতে হয়। কয়েক বছরে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও স্থানীয় পৌরসভা নির্বাচনে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে পারেনি।

ব্রিটিশদের রাজত্বকালে লর্ড রিপনের শাসনামলে ১৮৮৪ সালে বেঙ্গল মিউনিসিপাল অ্যাক্ট পাসের মাধ্যমে বাংলায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান মিউনিসিপালিটি বা পৌরসভা সৃষ্টি হয়। কমিশনারদের দু-তৃতীয়াংশ নির্বাচিত এবং এক-তৃতীয়াংশ সরকার কর্তৃক মনোনীত হতেন। কমিশনাররা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান ও একজনকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন করতেন। সরকারের পূর্ব অনুমোদন নিয়ে পৌরসভা বিভিন্ন কর, ফি, টোল ও পৌরকর আরোপ করতে পারত। সময়ের বিবর্তনে পৌরসভার কাঠামো এবং নির্বাচিত ব্যক্তিদের পদ ও পদবিতে পরিবর্তন এলেও ২০১৫ সালের আগে দেশে পৌরসভার প্রধান নির্বাহী পদে নির্দলীয়ভাবে নির্বাচনে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যেমন- ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা আইনে সংশোধনী এনে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী পদে নির্বাচনে প্রার্থীকে কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনয়নের বিধান করা হয়। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচন করার বিধানও রাখা হয়।

সে সময় মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট, অন্যান্য বিরোধী দল দেশের বিশিষ্টজনদের কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়। নির্বাচন-পরবর্তী এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়। একমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত ছিল কিন্তু বিএনপি নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারেনি। তার পর বিএনপি ও জামায়াতের লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের অন্তরীণ করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এ সংশোধনীর পর অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হয়নি। দশম জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব পড়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ওপর। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যেমন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ২০১৪, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০১৫, পৌরসভা নির্বাচন ২০১৫ এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ২০১৬-এ ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, ভোটকেন্দ্র থেকে বিরোধী দলের এজেন্টদের তাড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।

গত এক যুগে বাংলাদেশের নির্বাচনে একটা অভিনব স্টাইল দাঁড়িয়েছে। যেখানে বিরোধী দলের ভূমিকা নেই বললেই চলে। ব্যাপারটা হতে হতে সবার গা সওয়া হয়ে গেছে। এখন আর তেমন প্রতিবাদও হয় না। যেন নির্বাচন এমনই হওয়ার কথা। বাংলাদেশের জনগণ আসলেই জানে না সত্যিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন কী এবং কেমন? সবাই মনে করছেন, আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেলে জয় অবশ্যম্ভাবী। তাই দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য যতটা ব্যাকুল থাকেন, জেতার জন্য ততটা নয়। তারা জানেন, মনোনয়ন পেলে নির্বাচনে অবশ্যই জিতে যাবেন।

একটা বিষয় অনস্বীকার্য- উন্নয়নের জন্য সুস্থ রাজনীতি তথা গণতন্ত্র ও সুশাসনের বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনীতিতে সুস্থতার অভাব। ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলগুলোর স্বাভাবিক রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিতে চায় এবং এ-ও নতুন কোনো চিত্র নয়। পাশাপাশি রয়েছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ও অসহিষ্ণুতা। এ অবস্থায় রাজনীতি হয়ে উঠেছে সঙ্ঘাতময় এবং আমাদের অভিজ্ঞতা মোটেই প্রীতিকর নয়। দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এ পরিস্থিতি অস্বস্তিকর। এ অবস্থায় রাজনীতি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সুস্থ ধারায় এবং জনকল্যাণমূলক রাজনীতি নিশ্চিত করতে অধিকতর মনোযোগ দিতে হবে। গণতন্ত্রে মত-পথের ভিন্নতা থাকবেই। এমনকি একই দলের মধ্যে ভিন্ন ধারা থাকতে পারে। কিন্তু এ জন্য অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি করা হবে আর তার মাশুল গুনতে হবে দেশের সাধারণ মানুষের এটি কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সরকারি দলের ‘গৃহদাহ’ কেবল নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। অভিযোগ আছে, স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচনে সরকারি দলের কর্মীরা অধিকতর সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন।

অন্য দিকে বিরোধীরা এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অবাধ, নিরপেক্ষ, প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনের জন্য সবার আগে দরকার সমতল ভূমি। প্রশ্নমুক্ত, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভিত্তি। এ ক্ষেত্রে সব পক্ষেরই থাকবে সমান অধিকার। এসব বিষয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়েছে। সুপারিশ উত্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে; কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ কিংবা পরিবেশ উত্তপ্ত হতে পারে এমন কোনো কিছুই গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শোভনীয় নয়। গণতন্ত্র সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। পরমতসহিষ্ণুতাই হলো গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। সুস্থ ধারার রাজনীতি যেহেতু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যম, তাই এ রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই আগ্রহ ক্রমাগত ভাটা পড়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রশ্নমুক্ত করা না গেলে রাজনীতির চিত্র আরো অস্বচ্ছই হবে। এটি শুভবোধসম্পন্ন কারো কাম্য হতে পারে না।

বিগত কয়েক বছরে নির্ভেজাল গণতন্ত্রের বিকাশে সরকারের সৃষ্ট বাধাগুলো কথিত উন্নয়নের বোলচালে ঢেকে ফেলেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং এর বিকাশ। গণতন্ত্রের বিকাশে সরকার সৃষ্ট বাধাগুলো জনগণকে হতাশ করেছে। তারা উন্নয়নের নামে দুর্বল গণতন্ত্র দেখতে চান না। তারা চান গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একই সাথে হাত ধরাধরি করে চলুক। আওয়ামী লীগ জনগণের মনোভাব যতই বুঝতে পারবে ততই তাদের জন্য মঙ্গল।


আরো সংবাদ



premium cement
সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু

সকল