২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমেরিকার অনন্যতার মরীচিকা

মার্কিন গণতন্ত্র এত শক্তিশালী নয় যে, তা ব্যর্থ হবে না। - ছবি : সংগৃহীত

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ইলেক্টোরাল ভোট গণনা সম্পন্ন করার মাধ্যমে জো বাইডেনকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দানের জন্য ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের দুই চেম্বারের অধিবেশন আহ্বান করেছিলেন। সাধারণত এটা হচ্ছে একটি আনুষ্ঠানিক নিয়মবিধি, যেটা প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়।

প্রথমে কয়েকজন রিপালিকান আইনপ্রণেতা ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট পদে বহাল রাখার জন্য নির্লজ্জভাবে ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছিলেন। তারা ইলেক্টোরাল কলেজের ফলাফল নিয়ে আপত্তি উত্থাপনের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রলম্বিত করার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর নির্বাচন বাতিল করার জন্য এক নজিরবিহীন তাণ্ডব চালানো হয়। হাজার হাজার ট্রাম্প সমর্থক মার্কিন গণতন্ত্রের প্রতীক ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালিয়ে তা ‘দখল করে’ নেয়। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (এমএজিএ) লিখিত হ্যাট পরিহিত ও ট্রাম্প পতাকা বহনকারীরা ভবনটির অফিস ও ফ্লোরে হামলা ও ভাঙচুর চালায় এবং আইনপ্রণেতাদের হাউজ গ্যালারিতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বলে। ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র মুরিয়েল রোউসার মার্কিন রাজধানীতে দ্রুত কারফিউ জারি এবং দুই সপ্তাহের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।

আমেরিকার গণতন্ত্রের হৃৎপিণ্ডে হামলা ও সহিংসতার ছবি টেলিভিশনের পর্দায় এবং সোস্যাল মিডিয়ার টাইমলাইনে ব্যাপকভাবে দেখা যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ মানুষ এবং সারা বিশ্বের অনেক মানুষ শোকাভিভূত হয়। তবে যে ঘটনা ঘটেছে তা বিস্ময়কর ছিল না।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির ভিত্তিহীন অভিযোগ করে তার কাছ থেকে প্রেসিডেন্সি ‘চুরি’ করে নেয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন এবং তার সমর্থকদের শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরকে ভয়ঙ্করভাবে প্রতিরোধ করার জন্য উসকে দেন। তিনি তাকে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত রাখতে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সসহ রিপাবলিক কর্মকর্তাদের কোনো রাখঢাক না করে সরাসরি চাপ প্রয়োগ করেন। এমনকি তিনি জর্জিয়ার সেক্রেটারি অব স্টেট ব্রাড রাফেনসপারজারকে ওই রাজ্যটিতে তাকে জয়ী ঘোষণা করতে প্রয়োজনীয় ভোট সংগ্রহ করার নির্দেশ দেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে দাঙ্গার মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে হোয়াইট হাউজের কাছে ৭০ মিনিটের এক বক্তৃতায় ট্রাম্প তার সমর্থকদের খোলামেলাভাবে ‘ক্যাপিটল ভবনে’ যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘দুর্বলতা দেখিয়ে আমাদের দেশকে পেছনে ঠেলে দেয়া যাবে না।’

তবে সে দিনের দাঙ্গা ও সহিংসতার জন্য ট্রাম্প একাই দায়ী নন। বহু রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা ও কর্মকর্তা এবং রক্ষণশীল মিডিয়া ব্যক্তিত্বরাও নির্বাচনকে তাদের কাছ থেকে চুরি করা হয়েছে বলে হাজার হাজার ট্রাম্প সমর্থককে প্ররোচিত করেন। আদর্শিক আনুগত্যের বাইরে গিয়ে স্বল্প দৃষ্টির রাজনৈতিক বাস্তবতা অথবা পুরোপুরি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা প্রেসিডেন্টকে তার সমর্থকদের সংবিধানকে অবজ্ঞা করে সহিংসতায় লিপ্ত হতে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে তামাশায় পরিণত করতে উসকে দেন।
এমনকি অনেক উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকা রিপাবলিকান ব্যক্তিত্ব শেষ সময় পর্যন্ত নির্বাচন বাতিল করার ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের বেআইনি উদ্যোগ আয়োজনের নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানান। ট্রাম্পের লাখ লাখ সমর্থক ও অনুগামীদের সমর্থন হারানোর আশঙ্কায় তারা ট্রাম্পের তৎপরতার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখেন। অন্য দিকে অন্যদের অনেকে প্রেসিডেন্টের অদ্ভুত দাবি-দাওয়া এড়িয়ে যান এই যুক্তিতে যে, তার প্রভাব দ্রুত কর্পূরের মতো উড়ে যাবে। কিন্তু ডানপন্থী উগ্রবাদ ক্রমান্বয়ে সেখানে প্রধান ধারা হিসেবে আবির্ভূত হয়।

এক দিনের সহিংসতার পর যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল সুরক্ষিত এবং বাইডেনের বিজয়কে স্বীকৃতি বা সত্যায়ন করার পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে উভয় রাজনৈতিক পক্ষ থেকে রাজনীতিবিদরা দৃঢ়তার সাথে ট্রাম্পের নিন্দা জানান এবং নতুন প্রশাসন ও দেশ যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। কিন্তু কেন এত দীর্ঘ সময় ধরে ট্রাম্পের জেনোফোবিয়া এবং রাষ্ট্রে বিভাজন সৃষ্টিকারী বক্তব্যকে মেনে নেয়া হয়েছে? তাকে কেন এত দিন ধরে আইনের শাসন এবং ক্ষমতার পৃথকীকরণকে হেয় করার অনুমতি দেয়া হলো? এটা কেবল নির্বাচনের পর কয়েক সপ্তাহ নয়, তার শাসনামলের পুরো সময় তিনি এই চর্চাই করে এসেছেন। শ্বেতাঙ্গ, শ্রেষ্ঠত্ববাদ, বর্ণবাদী মনোবৃত্তি এবং ভয়ানক ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডে তার সমর্থনকে কেন এত দিন মেনে নেয়া হলো? এমনকি মিডিয়া ও এই সহিংসতার জন্য অপ্রস্তুত ছিল। কয়েক মাস ধরে প্রেসিডেন্ট খোলামেলাভাবে বিভিন্ন পন্থায় অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য পথ খুলে দিয়েছিলেন। হাজার হাজার উচ্ছৃঙ্খল ট্রাম্প সমর্থক নিয়মিত তাদের বন্দুক উঁচিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ‘চুরি বন্ধ করো’ বলে স্লোগান দিয়েছে।

বিংশ শতাব্দীজুড়ে ল্যাটিন আমেরিকা থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে ‘আইনসঙ্গতভাবে’ একনায়ক এবং ফ্যাসিবাদীরা ক্ষমতায় এসেছেন। তারা তাদের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছেন, আইনের শাসনকে হেয় প্রতিপন্ন এবং বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা কয়েক বছর ধরে ঘটেছে।
তাদের এসব কর্তৃত্ববাদী একনায়কতান্ত্রিক শাসনামলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সত্যিকার অর্থে নস্যাৎ হয়ে গেছে। দুঃখজনকভাবে, বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে ব্যাপক অস্বীকৃতি সত্ত্বেও বর্তমানে যুক্তরাজ্য থেকে পোল্যান্ড তথা পশ্চিমা বিশ্বে সত্যিকার অর্থে এ ধরনের ঘটনাই ঘটে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র সঙ্কটে পড়েছে। জনপ্রিয় নেতৃত্বকে বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে হেয় করতে দেয়া হচ্ছে। অপর দিকে দক্ষিণপন্থী ‘চরমপন্থা’ ‘প্রধান রাজনৈতিক ধারায়’ পরিণত হয়েছে।

অসুস্থ অবস্থা থেকে দেশের উত্তরণ ঘটাতে চাইলে আমেরিকার নতুন নেতৃত্বকে এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমেরিকার সম্প্রসারণবাদিতা তথা আধিপত্যবাদিতার ধারণা বা মনোবৃত্তিকে পরিত্যাগ করে গণতন্ত্রবিরোধী এমনকি তাদের রাজনীতিবিদদের ফ্যাসিবাদী মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে তাদের দেশের মতোই অন্যান্য দেশে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা থেকে তাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে। এমনকি নির্বাচনে এবং আদালতে পরাজিত হওয়ার পর ট্রাম্পইজমের মতো বিপজ্জনক রাজনৈতিক প্রবণতা রাতারাতি শেষ হয়ে যাবে না।

ইতালিতে ‘বার্লুম কোনিজমের’ উদাহরণের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। ইতালির মিডিয়া টাইকুনও সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লোসকোনি ট্রাম্পের মতোই প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থাকে হেয় ও গুরুত্বহীন করতে কাজ করেন, বিচার বিভাগকে তছনছ করে দিয়ে দুর্নীতিকে বৈধতা দান এবং পেশাদার রাজনীতিবিদদের তার ৯ বছরের শাসনামলে সমালোচনায় জর্জরিত করেন।

যৌন কেলেঙ্কারির কারণে প্রায়ই নৈতিকভাবে অধঃপতিত ও মর্যাদাহীন এবং দুর্নীতির অভিযোগে ইউরোপের একটি গণতান্ত্রিক দেশের নেতৃত্ব দিতে অযোগ্য এবং বরখাস্ত হওয়া সত্ত্বেও বার্লুসকোনি ২০১১ সালে পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত দু’দশক ধরে ইতালির রাজনীতিতে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু ইতালির রাজনীতিতে নেতৃত্বের আসন থেকে খসে পড়লেও যেকোনোভাবে বার্লুসকোনিজমের অবসান ঘটেছে বলে মনে করা যাবে না। তিনি ক্ষমতার রাজনীতিতে আবার ফিরে আসার জন্য তার শুধু প্রচেষ্টা অব্যাহতই রাখেননি, বরং ইতালির মিডিয়া এবং রাজনীতিতে যে জনতুষ্টিবাদ ধরন ও কার্যপ্রণালী চালু করেছেন এবং সাথে সাথে তার প্রবর্তিত জাতীয়তাবাদ ও নব্য ফ্যাসিবাদকে আইনসম্মতভাবে যে বৈধতা দিয়েছেন তা এখনো পর্যন্ত ইতালির রাজনীতিকে পঙ্গু করে রেখেছে। মিডিয়াও রাজনীতিতে তার বর্তমান উপস্থিতি এবং ম্যাথিও স্যালভিনির মতো চরম ডানপন্থী রাজনীতিবিদদের বর্তমান জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে, ইতালিতে বার্লোসকোনি এখনো জীবিত।

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পইজমের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে। এমনকি ট্রাম্প চূড়ান্তভাবে হোয়াইট হাউজ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একদা আমেরিকার রাজনীতিতে যেসব কর্মকাণ্ড এবং আচার-আচরণ নিষিদ্ধ ছিল সেগুলোকে যেভাবে তিনি বৈধতা দিয়েছেন তা আগামী দিনগুলোতে আমেরিকার গণতন্ত্র সঠিক পথে আনার প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে বাধাগ্রস্ত করাতে পারে।

সুতরাং সংক্ষেপে বলা যায়, আমেরিকা যেকোনো ধরনের শাসন থেকে যে ব্যতিক্রম থাকবে বা বাদ যাবে তা বলা যাবে না। মার্কিন গণতন্ত্র এত শক্তিশালী নয় যে, তা ব্যর্থ হবে না। আমেরিকায় ট্রাম্পইজম বা ট্রাম্পতন্ত্র রয়েছে। আমেরিকানরা দ্রুত এসব সত্যের মুখোমুখি হতে পারেন। তাই নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, ‘আমেরিকাকে ভালোভাবে গড়ে তোলার জন্য অতীত ঐতিহ্যে ফিরে যেতে হবে।’

লেখক : রয়েল হলোওয়ে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের একজন হিস্টোরিয়ান।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement