২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কোভিড-১৯ ও বর্ণবাদের প্রতিফলন

কোভিড-১৯ ও বর্ণবাদের প্রতিফলন - ছবি : প্রতীকী

এমন একটা ধারণা ছিল যে, ‘কোভিড-১৯ হচ্ছে বিরাট এক সমতাসৃষ্টিকারী।’ এই ধারণাকে এখনি মেরে পুঁতে ফেলা উচিত। যদি কোনো সত্য থাকে, তা হলো এই মারাত্মক রোগটি আমাদের সমাজে বিরাজমান গভীর বিভেদ ও বৈষম্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়ার আরেকটি বিষয়। এর পরে বলতে হয়, এ ব্যাধির চিকিৎসা একই লজ্জাকর দৃশ্যের পুনঃচিত্রায়ন যেন না হয়। বছরজুড়ে ধনাঢ্য সেলিব্রিটি আর সরকারি কর্মকর্তারা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘আমরা কোভিড ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ।’ এ যেন মার্কিন গায়িকা ম্যাডোনার ঘটনা। তিনি গোলাপের পাপড়ি ছিটানো দুধে গোসল করতে করতে তার প্রাসাদ থেকে বললেন, “এই অতিমারী বা ‘প্যান্ডেমিক’ হচ্ছে একটা বিরাট সাম্য প্রতিষ্ঠাকারী।” ‘আমি নিজেও প্রত্যেক রাতে বলতাম, আমরা সবাই একই নৌকার সহযাত্রী। এটা ডুবলে সবাই একসাথে ডুবতে যাচ্ছি’- বললেন ম্যাডোনা। সিএনএন এ তথ্য দিয়েছে।

ম্যাডোনার এ কথার মতো উক্তিগুলো মিডিয়াকে বেশ আকৃষ্ট করেছে। এর কারণ কেবল এটাই নয় যে, তারা বিখ্যাত ব্যক্তি এবং সোস্যাল মিডিয়ায় তাদের আছে বিপুলসংখ্যক অনুসারী। কারণ এটাই যে, তাদের এ ধরনের ফাঁকা বুলিতে থাকে ভণ্ডামি। সত্য হলো- তারা সেটারই পুনরাবৃত্তি করছেন যা দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার, সেলিব্রিটি আর ধনী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ‘স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিউর’ অর্থাৎ ‘আদর্শ পন্থা’। কথা হচ্ছে, আমাদের সবাই কি এক? বিশ্বব্যাপী বেকারত্বের হার আকাশচুম্বী, শত শত মিলিয়ন মানুষ সন্তানদের মুখে খাবার দিতে পারছেন না, অসংখ্য নাম না জানা ও হতাশ পরিবার যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে আফসোস করছে। তারা এ আশা ও প্রার্থনা করে টিকে আছেন যে, অতিমারী তো বটেই, দারিদ্র্যের অভিশাপও যেন তাদের বিনাশ না ঘটায়। তবে কেউ এমন দুরূহ প্রত্যাশা করতে পারেন না।

আমরা সবাই ‘এক নৌকার যাত্রী’ নই। নিশ্চিতভাবেই বলা চলে, তা আমরা ছিলাম না কোনো দিন। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ দিনে সাড়ে পাঁচ ডলারেরও কম অর্থের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। এই বিষণ্ন চিত্র অসাম্যের উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। মানবজাতি দীর্ঘদিন এ কারণে বিপন্ন হয়ে আছে।

বিশ্বের দরিদ্রদের অনেকের দুর্গতি আরো বেড়েছে যুদ্ধের কারণে উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার ফলে। তারা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ আর সহিংসতার যুগপৎ শিকার। বিত্তবানরা সম্পদশালী হয়েও তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে এবং নিজেদের প্রধানত অবাঞ্ছিত সম্পদের কিছুটা কাজে লাগাতে অনিচ্ছুক।

উদ্বাস্তুদের বেলায় নৌকার নজির বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। যুদ্ধ আর দারিদ্র্যের আগুন থেকে বাঁচার জন্য কয়েক মিলিয়ন উদ্বাস্ত মরিয়া হয়ে শীর্ণকায় নৌকায় করে পালাতে চেয়েছিল। তাদের আশা ছিল, নিজেদের সঙ্কটাপন্ন অঞ্চল ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় গিয়ে উঠবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুঃখজনকভাবে এমন ঘটনা বেড়ে গেছে। এটা কেবল ভূমধ্যসাগরে নয়, বিশ্বের অন্যান্য জলভূমিতেও তা দেখা যাচ্ছে। মিয়ানমারের কথা এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। সে দেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা চলমান গণহত্যার কবল থেকে বাঁচতে চেষ্টা করেছে। তবে তাদের কয়েক হাজার ডুবে গেছে বঙ্গোপসাগরে।

কোভিড-১৯ মহামারী বাড়িয়ে দিয়েছে, ত্বরান্বিত করেছে, সেই তীব্র অসাম্য বৈষম্য যা প্রতিটি সমাজে পৃথকভাবে এবং বৃহত্তর অর্থে, দুনিয়াজুড়ে বিরাজ করছে। গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকিংস ইনস্টিটিউট একটি জরিপ চালিয়েছে। এতে দেখা গেছে, চলমান মহামারীতে মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের বর্ণগত প্রভেদ ফুটে উঠেছে। এর অনেকগুলো সূচক সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত দিয়েছে, কোভিড জীবনচক্রে একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হলো বর্ণবাদ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ৪৫-৫৪ বছর বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্পানিক/ল্যাটিনোদের এতে মৃত্যুহার শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অন্তত ছয় গুণ বেশি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে সে বয়সীদের মধ্যে ৬২ শতাংশই শ্বেতাঙ্গ। সে দেশে করোনাভাইরাসে মৃতদের মাত্র ২২ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ। এতে বরং বেশি প্রাণ হারিয়েছে কালো আর ল্যাটিনো জনগোষ্ঠী।

অন্যান্য জরিপেও দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বর্ণগত জনগোষ্ঠীর কোভিড সংক্রমণ আর মৃত্যুর হারের মধ্যে যে পার্থক্য, তার মূল কারণ হলো দারিদ্র্য। আর এ দারিদ্র্যের উৎপত্তি বর্ণবৈষম্য থেকেই। যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা দরিদ্ররা হয়তো একেবারেই পায় না কিংবা পায় সীমিতভাবে। ধনীর বেলায় কথাটা খাটে না।

তদুপরি, দরিদ্র জনগোষ্ঠীগুলো পরিষেবা খাতে অল্প বেতনে কাজ করে থাকে। সেখানে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব। লকডাউনে বেঁচে থাকার জন্য তারা সরকারি সহযোগিতা পায় না। এ অবস্থায় তারা সন্তানের জন্য সাধ্যমতো সব কিছুই করে থাকে। তা করতে গিয়ে ভাইরাসে আক্রান্ত কিংবা মৃত্যুমুখে পতিত হয় তারা।

এখন করোনার টিকা যেভাবে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এ বৈষম্য বিদ্যমান থাকার কথা। পাশ্চাত্যে কয়েকটি দেশ এ টিকা দেয়া শুরু করে দিয়েছে কিংবা এর শিডিউল ঘোষণা করেছে। অথচ বিশ্বের খুব দরিদ্র দেশগুলোকে প্রাণরক্ষাকারী ভ্যাকসিন বা টিকা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে বলে ধরে নেয়া যায়।

আফ্রিকা কিংবা দক্ষিণ গোলার্ধের ৬৭টি দরিদ্র বা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মাত্র এক দশমাংশ মানুষ সময়মতো করোনা ভ্যাকসিন পাচ্ছে। এ তথ্য দিয়েছে ‘ফরচুন’ ম্যাগাজিনের ওয়েবসাইট। তারা এই উদ্বেগজনক প্রতিবেদনে উদ্ধৃতি দিয়েছে পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স (পিভিএ) নামের মানবিক ও অধিকার জোটের পরিচালিত এক জরিপের। জোটটিতে শামিল রয়েছে অক্সফাম ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও।

যদি টিকা দেয়ার ব্যাপারে কোনো কৌশল থাকে, তা হচ্ছে ধনী দেশগুলোর দুঃখজনক ‘মজুদদারি’। পিভিএ’র ডা: মোহগা কামাল-ইয়ান্নি নামে নারী চিকিৎসক বিষয়টি উপলব্ধি করে বলেছেন, ‘ধনী দেশগুলোর হাতে এত টিকা আছে যে, তারা তাদের প্রতিটি নাগরিককে তিনবার করে টিকা দিতে পারবেন। অথচ গরিব দেশগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মীসহ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছার মতো টিকাও নেই।’

এ দিকে অসংখ্য সভা-সম্মেলনে প্রচারণা চলছে, ‘কোভিড মহামারীতে বিশ্বে সাড়া পড়ে গেছে।’ কেমন বৈশ্বিক ‘সাড়া’, তা তো দেখাই যাচ্ছে। এই মহামারীর আগে যেমন ছিল, তেমনি এর পরেও থাকার কথা শ্রেণী, বর্ণ ও জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য। মানবসমাজকে এটা বিপন্ন করলেও এই সামষ্টিক ট্র্যাজেডিকে বিভিন্ন দেশের সরকার সুযোগ মতো ব্যবহারের আশঙ্কা আছে। বৈষম্যের ফাঁক পূরণ করার জন্য এটা করা হতে পারে। তবে তা হবে সবার জন্য আরো ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সূচনা মাত্র।

দরিদ্র, কালো চামড়ার মানুষেরা একটি মাত্র টিকা পেলে বেঁচে যেতে পারে। টিকা প্রচুর আছে। তাই এই মানুষদের মরতে দেয়া যায় না।

লেখক : ফিলিস্তিনের সাংবাদিক ও সম্পাদক। পাঁচটি গ্রন্থের লেখক যার মধ্যে আছে ‘এসব শেকল ভাঙ্গা হবে : ইসরাইলি কারাগারে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম ও সাহসের কাহিনী’ (২০১৯), ‘বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা : গাজার অকথিত কাহিনী’ (২০১০) এবং ‘ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা : একটি জাতির সংগ্রামের কাহিনী’ (২০০৬)।

ভাষান্তর : মীযানুল করীম
[common dreams.org-এর সৌজন্যে]


আরো সংবাদ



premium cement