২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইতিহাসের বাঁকে ‘রাওয়া’

ইতিহাসের বাঁকে ‘রাওয়া’ - ছবি : প্রতীকী

‘রাওয়া’ বা ‘RAOWA’ (Retired Armed Forces Officers’ Association) হলো অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্রবাহিনীর অফিসারদের সংগঠন। গত ১৯ ডিসেম্বর ছিল ২০২০ ‘রাওয়া’র নির্বাচনের দিন। প্রার্থীদের সরব প্রচারণায় সদস্যদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য বয়ে যাচ্ছিল। প্রায় বছর খানেক পর নির্বাচনকালে পুরনো বন্ধু সহকর্মীদের সাথে দেখা হবে, স্মৃতিচারণ হবে, শীতের পিঠার আড্ডা হবে এমন আশায় তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ ছিলেন। এরই মধ্যে হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সমাজসেবা অধিদফতর বিদ্যমান নির্বাচিত ‘ইসি’কে (এক্সিকিউটিভ কমিটি) বরখাস্ত করে এবং নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়।

‘রাওয়া’র উদ্দেশ্য হলো অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের জন্য কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং তাদের চিত্তবিনোদনমূলক নানা আয়োজন করা। যদিও ‘রাওয়া’র যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮২ সালে, কিন্তু এর মূল ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯৭৪ সালে। স্বাধীনতার পর দেশে অনেক সামরিক অফিসার অবসর গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত নতুন দেশটিতে আর্থিকভাবে সমস্যায় পড়েন। তখন লে. কর্নেল (অব:) হিশামুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে কয়েকজন অফিসার মিলে সংগঠিত করেন ‘EDA’ (Ex-Defence Officers’ Association)। মেজর (অব:) ফজলুল বারি ছিলেন ‘EDA’-এর সাধারণ সম্পাদক। তাদের প্রচেষ্টায় তৎকালীন অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল নূরুল ইসলামের সহযোগিতায় সেই সময়ে ২১ জন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে পুলিশ সার্ভিসে এবং আরো প্রায় ২১ জনকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে আত্মীকরণ করা হয়। ইতোমধ্যে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে গড়ে ওঠা ‘DORA’ (Defence Officers’ Retired Association) ‘EDA’-এর সাথে একত্র হয়ে কাজ শুরু করে। কিন্তু দিনে দিনে অবসরপ্রাপ্ত অফিসারের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাদের কষ্টও বাড়তে থাকে। এ সময় সাতজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার কর্নেল (অব:) এস এম রেজার উদ্যোগে গঠন করেন ‘Retired Army Officers’ Welfare Association’ বা ‘RAOWA’ যার প্রথম চেয়ারম্যান হন লে. জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দীন। পরে ১৯৮২ সালের ১৮ জুন ‘রাওয়া’র গঠনতন্ত্র বা সংবিধান অনুমোদন করা হয়। কর্নেল (অব:) এস এম রেজা ছিলেন ফাউন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং ‘RAOWA’ নামটি প্রস্তাব করেন মেজর (অব:) আক্তারুজ্জামান। এর কয়েক দিন পর ২ জুলাই লে. জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দীন কূটনৈতিক মিশনে দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় মেজর জেনারেল (অব:) এম খলিলুর রহমান নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ‘রাওয়া’ স্থায়ী ভূমির অভাবে কার্যক্রম চালাতে বিপাকে পড়ে। তখন সেনাসদরের সহযোগিতায় বর্তমানের জমিটি পাবার জন্য সামরিক ভূমি পরিদফতরে আবেদন করলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই ভূমি হস্তান্তরে রাজি হয় এবং শর্ত হিসেবে তিন বাহিনীর সব অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে সংগঠনে যুক্ত করতে নির্দেশনা দেয়। ফলে চূড়ান্তভাবে ‘Retired Army Officers’-এর স্থলে ‘Retired Armed Forces’ Officer’ হিসেবে ‘RAOWA’ তিন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের প্রতিনিধিত্ব করছে।

গত ৩৮ বছরে এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। সংস্থাটিতে পেশাদারিত্ব এসেছে। সদস্যরা এটাকে তাদের সেকেন্ড হোম ভাবতে গর্ববোধ করেন। সিএমএইচে ভর্তি অসুস্থ অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের খোঁজ-খবর নেয়া থেকে শুরু করে সদ্য অবসরে যাওয়া অফিসারদের পুনর্বাসনেও রাওয়া যথেষ্ট তৎপর। ম্যাগাজিন ও গবেষণাপত্র প্রকাশ করা এবং সেমিনার-ওয়ার্কসপের আয়োজন করায় ‘রাওয়া’তে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। ‘রাওয়া’র উদ্যোগে অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের নৈমিত্তিক কাজ যেমন- পাসপোর্ট নবায়ন, ভিসার দরখাস্ত, বিআরটিএ সংক্রান্ত কার্যকলাপ ইত্যাদিতে সহযোগিতা করার পদক্ষেপ অনেকের জীবন সহজ করেছে। তবে ‘রাওয়া’র সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক অবদান হলো মেজর (অব:) সিনহা হত্যার বিচার দাবিতে সোচ্চার হওয়া। এই হত্যার বিচার প্রক্রিয়া এ পর্যন্ত সঠিক পথেই চলছে বলে দেখা যাচ্ছে। একজন সহকর্মীর হত্যাকাণ্ডে ‘রাওয়া’র এই সরব প্রতিবাদ ছিল যথেষ্ট আবেদনময়।

এভাবে আপাতদৃষ্টিতে ‘রাওয়া’ তার স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিল এবং গত ১৯ ডিসেম্বর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু হঠাৎ গত ১৪ ডিসেম্বর সমাজসেবা অধিদফতর চলমান নির্বাচিত কার্যকরী কমিটিকে ‘বরখাস্ত’ করে নির্বাচন স্থগিত করে। মূলত তিনটি অভিযোগের ভিত্তিতে ‘এক্সিকিউটিভ কমিটিকে’ বরখাস্ত করা হয়। সেগুলো হলো- ক, ‘এক্সিকিউটিভ কমিটি’ গঠনের পর অধিদফতর থেকে অনুমোদন না নেয়া; খ. বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়মিত প্রেরণ না করা এবং গ. নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগ না রাখা। অভিযোগগুলো সত্য। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, এ জন্য কি প্রায় চার হাজার সম্মানিত সদস্যের ভোটে নির্বাচিত কমিটিকে ‘বরখাস্ত’ করা যায়? ‘বরখাস্ত’ করার আগে কি যথাযথভাবে সতর্ক করা হয়েছিল বা সংশোধনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল? আর এই অভিযোগগুলো কি শুধুই সাম্প্রতিককালের নাকি দীর্ঘদিনের ভুল প্র্যাকটিস? উল্লিখিত অপরাধে অন্য কোনো সংস্থাকে কি এভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে? এবং ‘বরখাস্ত’ করার মতো বিব্রতকর পদক্ষেপ না নিয়ে ‘কার্যকরী কমিটিকে’ কি ভেঙে দেয়া বা স্থগিত ঘোষণা করা যেত না? এসব প্রশ্ন ‘রাওয়া’ সদস্যদের মনে উত্থাপিত হতেই পারে। এতে অনেক সদস্য ব্যথিত হতে পারেন। সারা জীবন তারা সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করে এসেছেন বলেই এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও তারা নীরবে সব মেনে নিয়েছেন।

গত ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘কেয়ারটেকার বডি’র নোটিশ থেকে বোঝা যায়, একটি ঘটনা পরম্পরার পরিণতিতে সমাজসেবা অধিদফতরের এই চূড়ান্ত নির্দেশনা এসেছে। বেশ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসার সেনাসদরে মতবিনিময়কালে ‘রাওয়া’র অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এবং জুনিয়র সদস্যদের আচরণ সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়ে অভিযোগ করে সেনাসদরের হস্তক্ষেপ কামনা করেন এবং গঠনতন্ত্রে মৌলিক পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। সেনাসদর বিষয়টি প্রতিরক্ষা পরিদফতরের মাধ্যমে সমাজসেবা অধিদফতরে পাঠালে তারা ওই পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অবশ্য ‘রাওয়া’র অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা সম্পর্কে যে সব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো গুরুতর। তবে অবশ্যই সংশোধনযোগ্য। সার্বিক পরিবেশ, সামাজিক নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে থাকলে তা নিঃসন্দেহে গর্হিত অপরাধ। এ ব্যাপারে সব সদস্যকেই পূর্ণ সচেতন থাকতে হবে। তদন্তে প্রমাণিত হলে এসব অপরাধে জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা দরকার এবং তাদের সদস্যপদ বাতিল হওয়া জরুরি। কারণ, একটি সম্মানজনক দেশ সেবামূলক পেশা থেকে অবসর নিয়ে এসে কোনো ধরনের অসম্মানজনক আচরণ এবং অপরাধমূলক কার্যক্রম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ ধরনের পরিবেশের কারণে শান্তিপ্রিয় সিনিয়র অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররা রাওয়া ক্লাবের কার্যক্রমে অংশ নিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এমনকি তারা রাওয়া পরিচালনা কমিটির নেতৃত্বে আসতে অনীহা প্রকাশ করছেন। এমতাবস্থায় ‘রাওয়া’র সার্বিক উন্নয়নের জন্য গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নিম্নরূপ প্রস্তাবনা সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক দেয়া হয়েছে-

ক. চেয়ারম্যান, সেক্রেটারি জেনারেল এবং মেম্বার বেভারেজ এই তিনটি পদে সরাসরি নির্বাচনের পরিবর্তে সেনাসদর কর্তৃক উৎসাহী প্রার্থীদের মধ্য থেকে মনোনীত করা হবে।

খ. মেজর জেনারেল বা সমমানের অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসাররা চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নের জন্য অগ্রগণ্য হবেন। তবে এই পদে কোনোক্রমেই অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বা সমমানের নিচের পদবির অফিসার মনোনীত হবেন না।

গ. এই তিনটি পদের জন্য আগ্রহী প্রার্থীরা নির্ধারিত আবেদনপত্রের মাধ্যমে আবেদন করবেন এবং ওই আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করে সেনাসদর কর্তৃক ‘রাওয়া’ সংবিধানের নীতিমালা মোতাবেক মনোনয়ন দিতে হবে।

ঘ. কার্যকরী পরিষদের বাকি সদস্যরা রাওয়া সদস্যদের সরাসরি ভোটে নীতিমালা মোতাবেক নির্বাচিত হবেন।

ওই সংশোধনীর দ্বারা ‘রাওয়া’ ক্লাবের ওপর প্রচ্ছন্ন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের উন্নয়নসহ সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হতে পারে। তবে স্বাধীনভাবে ভোট প্রয়োগ করে নিজেদের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনের স্বাদ সদস্যরা নাও পেতে পারেন। সামরিক অফিসাররা চাকরিরত অবস্থায় বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের কারণে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন। কাজেই তারা এই ‘রাওয়া’ নির্বাচনকে বিপুলভাবে উপভোগ করে থাকেন। তাদের সেই উৎসাহে ভাটা পড়তে পারে। শীর্ষ পদটি সিনিয়র র‌্যাঙ্কের জন্য নির্ধারিত হয়ে পড়লে ‘রাওয়া’ সদস্যদের মাঝে কোনো ধরনের বিভাজন সৃষ্টি হয় কি না সেটা ভাবার বিষয়। কারণ, সদস্যদের বেশির ভাগই সিনিয়র র‌্যাঙ্কের নন। আবার মনোনয়নের প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্বাচিত হলে কখনো কখনো সাধারণ সদস্যদের আস্থার সঙ্কট দেখা দেয় কি না তা বিবেচনা করতে হবে। সংশোধিত গঠনতন্ত্রে ‘রাওয়া ক্লাবে’ শৃঙ্খলা ও আচরণবিধির উন্নয়ন ঘটতে পারে, তবে সেই সাথে এটাও চিন্তা করা দরকার, যেন কোনো ধরনের ভীতিকর বা ‘স্বস্তিদায়ক নয়’ এমন পরিবেশ আরোপিত না হয়; অথবা বিনোদনের পরিবেশ সঙ্কুচিত না হয়ে পড়ে।

‘রাওয়া’র ইতিহাস বলে, এর সৃষ্টি থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে সেনাসদর সব সময় সরাসরি সহযোগিতা করেছে। সে জন্যই ‘রাওয়া’ আজকে দেশ ও জাতির কাছে অতি পরিচিত একটি সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কাজেই মুষ্টিমেয় কয়েকজন সদস্যের কারণে গোটা ‘রাওয়া’র পরিবেশের অবনতি ঘটলে সেনাসদর সেটা সংশোধনের পদক্ষেপ নিতেই পারে। এই সংশোধনের পদক্ষেপে ‘রাওয়া’ সদস্যদের ইতিবাচক ভূমিকা রাখা উচিত। কাজেই সমাজসেবা অধিদফতরের সংশোধন প্রস্তাব চূড়ান্ত করার আগে সাধারণ সদস্যদের সাথে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। এতে গৃহীত পদক্ষেপে সবার সক্রিয় সহযোগিতা পাওয়া যাবে এবং অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন ‘রাওয়া’কে আরো এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা
E-mail: maksud2648@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement