১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মুহাম্মদ আসাদের তাফসির ও প্রাসঙ্গিক তর্ক

-

মুহাম্মদ আসাদ (১৯০০-১৯৯২ খ্রি:), যাকে বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের অন্যতম প্রভাবশালী মুসলিম হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ছিলেন সব্যসাচী প্রতিভা। একাধারে সাংবাদিক, লেখক, চিন্তাবিদ, সমালোচক, সংস্কারক, রাষ্ট্রদূত, রাজনৈতিক মতাদর্শিক, অনুবাদক, গবেষক। বংশগতভাবে একজন অস্ট্রিয়ান ইহুদি ছিলেন। নাম ছিল লিওপোল্ড উইস। ফ্রাঙ্কফুর্টার সাইটুঙ্গের তুখোড় সাংবাদিক ও বিশ্লেষক লিওপোল্ড উইস পরে একটি সবল নাম হয়ে উঠেছিল কী আরবে, কী পাশ্চাত্যে। কিন্তু আরববিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে ১৯২৬ সালে ইসলাম গ্রহণ করার পরে মুহাম্মদ আসাদ নামটি হয় আরো প্রবল, আরো অনিবার্য। সে অনিবার্যতা ব্যাপ্ত আছে প্রাচ্যে যেমন, পাশ্চাত্যেও তেমনই।

ইসলাম গ্রহণের পর ভারত সফরে আসেন আসাদ। মুসলিম কবি-দার্শনিক আল্লামা ইকবালের (১৮৭৭-১৯৩৮) সাথে গড়ে ওঠে আসাদের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। ইকবাল আসাদকে ভবিষ্যতের ইসলামী রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় সহায়তা করতে প্রস্তাব পেশ করেন।

মুহাম্মদ আসাদ অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘ইসলাম অ্যাট দ্য ক্রসরোড’ (১৯৩৪) তার এক দীপিত গ্রন্থ, যাতে আসাদ মুসলমানদের পশ্চিমা সমাজের অনুকরণ এড়ানোর এবং মূল ইসলামিক ঐতিহ্যের দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানান। ‘রোড টু মক্কা’ বা মক্কার পথ (১৯৫৪) হচ্ছে তার ঘরে ফেরার ইতিবৃত্ত। রুহানি সফরনামা। জীবনদৃষ্টির নবনির্মিতি এবং ফিতরাতের মর্মমূলে আত্মনিবেদনের হিরন্ময় প্রতিবেদন। ১৯০০ থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত সময়কালের এ আত্মজীবনী হয়ে উঠেছে গতিমান আধুনিক জীবনের অন্তরতলে বিপুল শূন্যতায় ক্রন্দনরত মানবসত্তার দীর্ঘশ্বাস এবং বিপরীতে মুসলিম সংস্কৃতির অতলে জমানো গহনমানবীয় সামগ্রী ও জীবনীশক্তির নিবিড় সমন্বয়ের উন্মোচন। পাশ্চাত্যে আসাদ তার সর্বাধিক বিক্রীত এই আত্মজীবনী গ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেন। ‘Home-Coming Of The Heart’ (১৯৩২-১৯৯২) তার আত্মজীবনীর বাকি অংশ। তার অসামান্য এক গ্রন্থ দ্য আর্লি ইয়ারস অব ইসলাম (১৯৩৮)। এতে তিনি সহি বুখারির কিছু অংশের তরজমা করেন এবং ব্যাখ্যাসহ করেন জ্ঞানপূর্ণ আলোচনা।

The Message of the Qur'an নামে আল কুরআনের একটি ইংরেজি অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা রচনা করেন আসাদ। এটি আসাদের সেরা কাজ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে, যা তিনি ১৭ বছর গবেষণা করে সম্পাদন করেন। ইসলামে ধর্মান্তরিত বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ মার্মাডিউক পিকথল (১৮৭৫ -১৯৩৬) এবং আবদুল্লাহ ইউসুফ আলীর (১৮৭২-১৯৫৩) অনুবাদসহ তার অনূদিত গ্রন্থটি আধুনিক যুগের অন্যতম প্রভাবশালী অনুবাদ হিসেবে বিবেচিত।

আসাদ তার রচনাবলি ‘যারা চিন্তাভাবনা করেন’ তাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছিলেন। তার কাজের স্মরণে ২০০৮ সালে ভিয়েনায় জাতিসঙ্ঘ অফিসের প্রবেশদ্বারে মুহাম্মদ আসাদ প্ল্যাটজ নাম খোদাই করা হয় এবং ‘ধর্মীয় সেতু নির্মাতা’ হিসেবে তাকে বর্ণনা করা হয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তার মূল্যবান গ্রন্থগুলোর অনুবাদ হয়েছে। তার বইগুলোর বহুমাত্রিক অবদান ও ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক আবেদন যে অসামান্য এবং অনস্বীকার্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তার অপরাপর বইগুলোর বিষয়বস্ত ও মূল্যমান নিয়ে উম্মাহর তরফ থেকে শ্রদ্ধা ও ঋণস্বীকার নানাভাবে করা হয়েছে। তবে The Message of the Qur'an নামক কুরআনের অনুবাদগ্রন্থ নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। এটিকে শতাব্দীর সেরা অনুবাদকর্ম হিসেবে স্বীকার করেছেন অনেকেই। এতে তার মনন ও বৈদগ্ধের অনুপম নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেছেন বহু গবেষক। এখানে তিনি নানা ক্ষেত্রে থাকতে চেয়েছেন সৃষ্টিশীল। উদযাপন করতে চেয়েছেন নব উন্মোচকের ভূমিকা। এ ছিল তার জীবনের অন্যতম এক স্বপ্নের প্রতিফলন। এতে তিনি শাব্দিক অনুবাদে যাননি, বরং তুলে ধরেছেন মর্মকথা। নোটে অবশ্য শাব্দিক অনুবাদও করেছেন। সংক্ষেপে তিনি যুক্ত করেছেন বহু নোট। এতে যেমন নিজের জ্ঞানদৃষ্টি তুলে ধরেছেন, তেমনি আগেকার ওলামার বিভিন্ন মতামত উল্লেখ করেছেন। বিশেষত তখন, যখন তিনি তর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করছেন।

তিনি তরজমা করেন ইংরেজিতে, যাতে তার অসাধারণ প্রাজ্ঞতা ছিল সুবিদিত। আরবিতেও তার অধিকার ছিল প্রশ্নাতীত। ফলে একধরনের অবলীল স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও আল্লাহর বাণীর শব্দাবলীর অর্থ প্রকাশে মানবীয় সীমাবদ্ধতা তাকে পীড়িত করেছে। পাশাপাশি, নিজের চিন্তা, ভাবধারা ও বিচারবোধকে গুরুত্ব দিয়েছেন নানাভাবে।

এর ফলে ইসলামের বিভিন্ন আকিদা-বিশ্বাসের ব্যাখ্যায় আসাদের বক্তব্য তর্ক তৈরি করেছে। বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের জায়গা থেকে এ অনুবাদ নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করেছেন অনেকেই।

মুহাম্মদ আসাদের কুরআনের সম্পূর্ণ ইংরেজি অনুবাদটি ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে জিব্রাল্টারের দার আল-আন্দালুস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এর ১৬ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে এক অংশের একটি সীমিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সম্পূর্ণ অনুবাদটি এক হাজারের বেশি পৃষ্ঠাসংবলিত এবং এক খণ্ডে মুদ্রিত হয়। প্রতিটি পৃষ্ঠার উপরের অংশে ডান দিকে কুরআনের আরবি পাঠ রয়েছে এবং বাম দিকে এর ইংরেজি অনুবাদ রয়েছে। আর নিচের অংশে ব্যাখ্যামূলক মার্জিন এবং অনুবাদ সংক্রান্ত শাস্ত্রীয় মন্তব্য রয়েছে। প্রতিটি সূরার শুরুতে ওহির তারিখ, শানে নজুল বা অবতরণের প্রেক্ষাপট এবং সূরায় বর্ণিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

ডা: ওয়াজিহ আবদেল-রহমান তার কিতাব ‘ওয়াকফাতুন মা’আত তারজামাতুল কুরআন আল ইনলিজিয়্যাহ’তে আসাদের এই অনুবাদের সমালোচনা করেন এবং তিনি তার কিতাবের প্রথম খণ্ডের ১৫-১৭ পৃষ্ঠায় তার পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যক্ত করেন।
তিনি লিখেছেন, মুহাম্মদ আসাদ মুজিজা তথা অলৌকিক ঘটনাবলিকে পুরোপুরি অস্বীকার করার প্রবণতা রাখেন এবং তিনি মনে করেন, উদাহরণস্বরূপ, বদরের দিনে মুসলমানদের সমর্থন করার জন্য ফেরেশতাদের অবতরণ একটি রূপক অভিব্যক্তি এবং এর অর্থ মুসলিমদের মনের দিক থেকে শক্তিশালী করা, তাদের উদ্বুদ্ধ করা এবং তাদের মনোবল বৃদ্ধি করা। মুজিজাকে গ্রহণ না করা থেকে আসাদ বহু বিষয়ে বুদ্ধিবাদের দ্বারা চালিত হয়েছেন। খিজির আ:, লুকমান আ: কিংবা জুলকারনাইনকে গ্রহণ করেছেন প্রতীক হিসেবে। মেরাজ প্রশ্নে তার মতামত আয়েশা রা:-এর অনুবর্তী। তিনি মনে করতেন, মেরাজ মূলত আধ্যাত্মিক।

তার কিছু ব্যাখ্যা রয়েছে, যা আরো বিপদে ফেলে দেয়। যেমন, হজরত ইব্রাহিম আ:-এর আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া এবং নিরাপদ থাকার অলৌকিকতা।

কুরআনে এ ঘটনার উল্লেখ তিন জায়গায় রয়েছে। সূরা আম্বিয়া নির্দিষ্ট করে এ তথ্য দেয় যে, তিনি স্পষ্টতই আগুনে নিক্ষিপ্ত হন এবং আল্লাহ তার কুদরতি শক্তির বলে আগুনের জ্বলনক্ষমতা রহিত করে দেন! কুরআনের ভাষায়- ‘হে আগুন! শীতল হও এবং শান্তি হও ইব্রাহিমের ওপর!’

মুহাম্মদ আসাদ মন্তব্য করেন যে, ইব্রাহিম আ:কে প্রকৃতপক্ষে সশরীরে আগুনে নিক্ষিপ্ত করা হয়নি। কুরআন তা স্পষ্ট করে না। বরং সূরা ‘আনকাবুতের আয়াত এর বিপরীত দিকে ইঙ্গিত করে। তবে কি তার যুক্তিবাদ মেনে নিতে পারছে না ইব্রাহিম আ:কে আসলে আগুনে নিক্ষেপ করার মুজিজা? তিনি বরং ব্যাখ্যা করছেন ‘অত্যাচারের আগুন’ হিসেবে। ইব্রাহিম আ: শত্রুপক্ষের বর্বরোচিত অত্যাচার সহ্য করতে পারার ফলে আগুন তার জন্য আধ্যাত্মিক শক্তি এবং প্রশান্তির উৎস হয়ে উঠেছে বলে মুহাম্মদ আসাদ মনে করেন!

আসাদ চেয়েছেন, প্রাকৃতিক নিয়মের স্বাভাবিকতার পক্ষে দাঁড়াতে। মুজিজার পক্ষে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হাজির করা যাচ্ছে না বলে অনেকেই তাকে উপেক্ষা করতে চেয়েছেন এবং দাঁড় করিয়েছেন নিজের মতো কোনো এক ব্যাখ্যা।

মুহাম্মদ আসাদ এসব জায়গায় রূপকার্থ আরোপ করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। এসব ঘটনাকে তিনি ‘কিসসায়ে খিরাফিয়্যাহ’ তথা ‘রূপকথা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

মুহাম্মদ আসাদ ইসলামিক আইনশাস্ত্রের সংবেদনশীল বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা ও ব্যাখ্যা করেছেন। বিশেষত হিজাব নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি সঙ্গতকারণেই আপত্তির মুখোমুখি হয়েছে। যখন তিনি দাবি করেন, মুসলিম নারীর মাথা ঢেকে রাখার বাধ্যবাধকতা সমসাময়িক প্রথা ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল! মেয়েরা আদিষ্ট হয়েছে যৌনাঙ্গ ঢেকে রাখতে। প্রথাগতভাবে তারা ঢাকতে নির্দেশিত নন নিজেদের মুখ, হাত বা পা!

এমনিভাবে আসাদ যখন কুরআনে বর্ণিত হজরত ঈসা আ:-এর জন্মকালীন কথা বলাকে সংঘটিত ঘটনা না মেনে ভবিষ্যতে ঘটতে যাচ্ছে, এমন বিষয় বলে দেখান, তখন স্পষ্টতই দেখা যায়, তিনি যুক্তির দাবিকে গ্রহণ করে মুজিজাকে বর্জন করছেন।
নিজের অনুরাগী মুসলিম মনীষী ও আরব-অনারব বিদ্বানদের ওপর তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব ছিল প্রবল। অনেকেই তাকে গ্রহণ করেছেন তার এসব বিচ্যুতি উপেক্ষা করেই। তার তরজমা অনুরাগী মহলে প্রশংসিত হয়েছে বিস্তর। অতিসাম্প্রতিক নমুনা হিসেবে শাহ আব্দুল হান্নানের (জন্ম : ১৯৩৯-) মতামত উল্লেখ করা যায়। তিনি মুহাম্মদ আসাদের তরজমার একটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন যে, এটি লিঙ্গপক্ষপাত মুক্ত। নমুনা হিসেবে তিনি সূরা নিসার প্রথম আয়াতের অনুবাদ ও নোট হাজির করেন। যেখানে মুহাম্মদ আবদুহুর পাশে অবস্থান করে আসাদের দাবি, নফস বলতে এখানে শুধু আদম নয়, বরং ‘জীবিত সত্তা’ ((living entity) উদ্দেশ্য। এর মধ্যে পুরুষ ও নারী উভয়ই হাজির থাকেন এবং জীববিজ্ঞানের সত্যের সাথে কুরআনের বাণীভঙ্গিমার মিলও রয়েছে গভীর।

শাহ দাবি করেন, ‘আসাদ তার তাফসিরে অনেক বিষয়ে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত; কিন্তু কুরআনের আয়াতের অর্থের আওতাধীন ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে দাসীদের বিয়ের মাধ্যমে স্ত্রীরূপে গ্রহণ এবং হুর সম্পর্কিত ব্যাখ্যার উল্লেখ করা যায়।’ তিনি এক কথায় দাবি করেন, ‘মুহাম্মদ আসাদের পুরো তাফসির একটি অনন্য সাধারণ সৃষ্টি।’

মুহাম্মদ আসাদের আলোচ্য তাফসির প্রকাশের পর থেকে এ পর্যন্ত আলোচিত হয়ে আসছে। পশ্চিমা যুক্তিবাদের কাছে আত্মসমর্পণের অভিযোগে বিক্ষত এ তাফসির যতই বিতর্কিত হোক, এর গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছে বরাবরই। ভুল-ত্রুটি মানবকর্মের স্বাভাবিক সহযাত্রী। আসাদ কখনো নিজেকে ভুলমুক্ত বলে দাবি করেন না, নিজের উপলব্ধির পরিশোধনেও তার অনাগ্রহ ছিল না।

তার তাফসির নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিষয়গুলোর মুখোমুখি হতে এর সচেতন পাঠ জরুরি বলেই ভেবেছে মুসলিম বোদ্ধা মহল। তার অন্যান্য রচনা ও জ্ঞানকর্ম আধুনিক মুসলিম চিন্তায় এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, তাকে ধরে নেয়া হয় ইউরোপ মহাদেশের তরফ থেকে ইসলামের সমীপে শ্রেষ্ঠতম উপহার। জার্মান নওমুসলিম চিন্তাবিদ মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান (১৯৩১-২০২০) ঠিকই লিখেছেন, ‘আসাদ ইসলামকে দেয়া ইউরোপের উপহার। ইউরোপ বহু শতাব্দী ধরে ইসলামের সাথে যে দুশমনি করে আসছে, আসাদের মাধ্যমে সেই ক্ষত কিছুটা পোষানো যেতে পারে।’

লেখক : কবি, গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement