২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রেরণার বাতিঘর, অধ্যক্ষ গোলাম সরোয়ার সাঈদী

অধ্যক্ষ গোলাম সরোয়ার সাঈদী - ছবি : নয়া দিগন্ত

রাসূলের সা: সুন্নাহতে উদ্ভাসিত আলোকিত জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রখ্যাত মুফাসসির ও আড়াইবাড়ি দরবারের পীর মাওলানা গোলাম সরোয়ার সাঈদী। তিনি সহজ ও সাবলীল ভাষায় ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ইসলামের মর্মবাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে খুব অল্প সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বিশেষ করে করোনার কঠিন মুহূর্তে তার দেয়া আহ্বান ‘যুবক তুমি এখনো নামাজ পড় না, এখনো তুমি মসজিদে ঢকুতে পারো নাই, তুমি কি দেখ নাই মসজিদগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।’ তার এ ধরনের বেশ কিছু আলোচনা সবার হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে।

সদা হাস্যোজ্জ্বল সদালাপী অতিথিপরায়ণ ও পরোপাকারী মানুষটি করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর গ্রিন রোডের কমফোর্ট হাসপাতালে ভর্তি হন। দীর্ঘ ১৬ দিন নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে থেকে গত ২১ নভেম্বর ভোর ৪টা ১০ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আমার খুব কাছে থেকে দেখা বর্ণাঢ্য জীবনের একজন সফল মানুষ তিনি। খুব পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। তার আড়াইবাড়ির বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তার সাজানো দরবার। বৈচিত্র্যময় কারুকাজে আবৃত মসজিদটি সাজিয়েছেন ফুলেল সম্ভারে। যে ফুলের টব যেখানে লাগানো দরকার তিনি সেখানেই লাগিয়েছেন।

বহু গুণের অধিকারী গোলাম সরোয়ার সাঈদী ১৫ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে আড়াইবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই বেড়ে ওঠেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত আড়াইবাড়ি দরবার শরিফের প্রয়াত পীর সাহেব আল্লামা হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ গোলাম হাক্কানীর রহ:-এর সুযোগ্য সন্তান এবং এই দরবার শরিফের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা হজরত মাওলানা আবু সাঈদ আসগর আহমাদ আল-কাদেরী রহ:-এর নাতি তিনি। গোলাম সরোয়ার সাঈদীর প্রপিতামহ ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার নারুই গ্রামের হজরত মাওলানা মুকসুদ আলী রহ:। তিনি দেশবরেণ্য আলেম ছিলেন। তার আম্মা সাইয়েদা সুরাইয়া বেগম ছিলেন ধর্মভীরু নারী। ঢাকার ঐতিহাসিক লক্ষ্মীবাজার শাহ্ সাহেব বাড়ির মেয়ে। তার বাবা সাইয়েদ আবুল হোসেন। তিনি ভাষাসৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের মামাতো বোন।

পিতার হাতে শিক্ষার হাড়েখড়ি হলেও তিনি আড়াইবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরে দাদার প্রতিষ্ঠিত আড়াইবাড়ি ইসলামিয়া সাঈদীয়া মাদরাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে দাখিল আলিম ও ফাজিল পাস করেন। এরপর কুমিল্লার ধামতি আলিয়া মাদরাসা থেকে ১৯৯০ সালে হাদিস বিষয়ে কামিল পাস করেন। শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকায় তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে কৃতিত্বের সাথে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কাঁটাবন ইসলামিক সেন্টারে বরেণ্য স্কলার আল্লামা সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন আবদুল্লাহ জাফরীর কাছে হাদিস তাফসির ও ইলমি ফিকহের ওপর গভীর জ্ঞান লাভ করেন। তা ছাড়া তিনি ধামতি আলিয়ার প্রখ্যাত মাওলানা ইসমাইল হুজুর, ফজলুল করিম, মাওলানা আমিনুদ্দীন, মাওলানা গোলাম হাক্কানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাওলানা আব্দুস সাত্তার ও প্রফেসর আনসার আলীসহ অনেকের কাছে থেকে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পরিবারে বিয়ে করেন। তার স্ত্রী উম্মে শিফা সীমা আখতার। তিনি ঢাকার ইডেন কলেজের মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। ঈমানি জযবা, অনাবিল শান্তি আর আনন্দের মধ্যে বেড়ে ওঠে তাদের চার সন্তান।

মাওলানা সরোয়ার চার বোন ও পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়। ভাইদের মধ্যে বড় জন মাওলানা এ বি এম গোলাম কিবরিয়া সাঈদী দীর্ঘ দিন ধরে আমেরিকা প্রবাসী। মেজো ভাই গোলাম কবির সাঈদী ঢাকার সফল ব্যবসায়ী। সেজ ভাই গোলাম খবির সাঈদী ভারতের ঐতিহাসিক আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স করে বর্তমানে ঢাকার একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর হিসেবে কর্মরত। ছোট ভাই গোলাম হাদী সাঈদী দীর্ঘদিন লন্ডনে পড়ালেখা করে বর্তমানে ঢাকায় ব্যবসা করছেন।

তিনি আড়াইবাড়ি কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। তার মাদরাসা ২০০৪ সালে দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। তিনি ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। তিনি ক্লাসে যাওয়ার আগেই ছাত্রদের ভিড় জমে যেত। তিনিও ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন আপন মমতায়। নিজ সন্তানদের মতোই তাদের যত্ন করতেন। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় পরীক্ষার আগে খুব মেধাবী ছাত্ররা যাতে রেজাল্টের দিক থেকে বোর্ডের শীর্ষ তালিকায় থাকে সে জন্য তার বাড়িতেই থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তার হাতে গড়া ছাত্ররা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ালেখা করছে।

তিনি তার এলাকা বিদআত ও শিরক মুক্ত করতে শিক্ষা ও গবেষণা সেন্টারে ওলামাদের নিয়ে মাসিক বৈঠক করতেন। এ ছাড়া দরবারে আসা সাধারণ নারী-পুরুষদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তিনি পীর হলেও এলাকার মানুষের সাথে ভাইয়ের মতোই ব্যবহার করতেন। তাদের কবরস্থানের কোথাও কারো নাম লেখা নেই। এমনকি কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই।

গোলাম সরোয়ার সাঈদীর দাদা মাওলানা আবু সাঈদ আসগর আহমাদ ১৯৩৭ সালে কসবা উপজেলার পৌর সদরের আড়াইবাড়ি আলিয়া মাদরাসা ও একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে তার ছেলে মাওলানা মুহাম্মদ গোলাম হাক্কানী এর হাল ধরেন। তারপর মোহাম্মদ গোলাম সরোয়ার সাঈদী ২০০৪ সালে মাদরাসাকে কামিল মানে উন্নীত করেন। এ ছাড়া রয়েছে আড়াইবাড়ি ইসলামিয়া ছায়েদিয়া এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং, আড়াইবাড়ি হাক্কানিয়া হাফেজী মাদরাসা, আড়াইবাড়ি সাইয়েদা সুরাইয়া নূরানী মাদরাসা, ইসলামী বুক ক্লাব। বর্তমানে ইবতেদায়ি, জুনিয়র, দাখিল, আলিম ও ফাজিল মাদরাসা ছাড়াও একাধিক দাতব্য ও সামাজিক সংস্থা রয়েছে যার মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এলাকায় শিক্ষা বিস্তার, মাদকতা, সন্ত্রাস ও অনৈসলামিক কার্যকলাপ রোধসহ বিভিন্ন সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কার্যাবলি পরিচালনা করেছেন। প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক ছাত্রের প্রিয় শিক্ষাঙ্গন আড়াইবাড়ি দরবার। সেখানে তিনি প্রতি বছর দেশের শীর্ষ মুফাসসিরদের নিয়ে তাফসির মাহফিলের আয়োজন করতেন।

খুব অল্প সময়ে দেশের সীমানা পেরিয়ে গোলাম সরোয়ার সাঈদী আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি আন্তর্জাতিক সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে লন্ডন, ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেন।

তার নামাজে জানাজায় লাখো মানুষ শরিক হন। মুহূর্তের মধ্যে তার ইন্তেকালের খবর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তাকে চিনতেন বা তার সাথে সংশ্লিষ্টতা ছিলো এমন সবাই খুব মর্মাহত ও শোকার্ত হয়ে পড়েন। রোজ টিভির স্বত্বাধিকারী আব্দুল্লাহ আল রোমান কান্নায় ভেঙে পড়েন। কারণ অধ্যক্ষ গোলাম সরোয়ার সাঈদীকে মোটিভেশনাল স্পিকার সাঈদী বানাতে নেপথ্যে তার দেয়া শ্রম, মেধার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। জনপ্রিয় মুফাসসির মিজানুর রহমান আযহারী ভাইয়ের পেছনেও তিনি মেধা ও সময় দিয়েছেন অকাতরে।

বাদ আসর আড়াইবাড়ি দরবার শরিফের মসজিদ মাঠে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ইমামতি করেন মরহুমের বড় ছেলে গোলাম সোবহান সাঈদী। নামাজের আগে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক টেলিফোনের মাধ্যমে বক্তৃতা দেন। কথা বলেন ফালাহ-ই-আম ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ডা: শফিকুর রহমান, বিশিষ্ট আলেম আল্লামা কামালুদ্দীন জাফরী, কমফোর্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী কবির আহমেদ, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামিম সাঈদী, মোল্লা নাজিম উদ্দিন ও উপজেলা চেয়ারম্যানসহ মরহুমের ভাই ও বড় ছেলেসহ অন্যান্য স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। তার মৃত্যু ও জানাজার সংবাদ প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়।
তার মৃত্যুতে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, লেখক মুফাসসির অনেকে শোক প্রকাশ করেছেন। এমনকি নিজের ফেসবুক ভেরিফায়েড পেজে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন আলোড়ন সৃষ্টিকারী মুফাসসির মিজানুর রহমান আযহারী ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার তাসকিন আহমেদ।

তার মৃত্যু সংবাদ শুনে দরবারের হাজারো ভক্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে থাকেন। দুপুর না হতেই রাস্তা ঘাট, মাঠ মসজিদ সব ভরে যায়। মানুষের এত ভিড় যে আশপাশের কোনো বাড়ির ছাদও খালি ছিল না। লোকে লোকারণ্য এক জানাজা। সে দিন ছিল সত্যিই লাখো মানুষের শোকের দিন। যেন প্রিয়জন হারানোর আর্তনাদ। আল্লাহ্ এই প্রিয় মানুষকে কবুল করুন। তার রেখে যাওয়া কাজগুলো আঞ্জাম দেয়ার জন্য যোগ্য লোক তৈরি করে দিন। অসহায় সন্তানদের সহায় হোন।

নামাজে জানাজা শেষে অধ্যক্ষ গোলাম সরোয়ার সাঈদীকে তার পিতা ও দাদার কবরের পাশে দাফন করা হয়।

লেখক : খতিব ও মুফাসসিরে কুরআন
azadcairo@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল