২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গুঁড়া মাছের গপ্পো

গুঁড়া মাছের গপ্পো - ছবি : সংগৃহীত

চার যুগ পর আগের মতো বর্ষা দেখলাম। কাছে থেকে বর্ষা দেখতে মাঝে মধ্যেই গাঁয়ে যাই। সকালে হাঁটতে বের হয়ে পেলাম মাছ। ৩০০ টাকায় কিনলাম দেড় কেজি গুঁড়া মাছ। যার মধ্যে কিছু নরম পুঁটি মাছও ছিল। সেগুলো আলাদা করে অতিরিক্ত রসুন ও মরিচ-মসল্লা মিশিয়ে তাজা লেবুপাতা যোগ করে রান্না করা তরকারির নাম ‘মর্জলা’। শব্দটি আঞ্চলিক। কেউ কেউ ‘পোড়া পোড়া’ও বলে। তাজা পুঁটি মাছ করা হয়েছে ভাজা। ক্যাচড়া বাইম, গুতুম, বজুড়ি, কাইক্কা ইত্যাদি মাছের সাথে হালকা মসলা মিলিয়ে, আলু ও উচ্ছে যোগে রান্না করা হয় ‘কাঁচবাগার’ (মাছ ভাজা না করে ফোঁড়ন দেয়া)। ফলি, টেংরা, শিংয়ের কড়া, বৈচা, খলিশা, মেনা ইত্যাদি মাছের সাথে চালতা দিয়ে রান্না করা হয় ‘টক’।

একসাথে চারজন খেতে বসেছি। সবাই আমার মতোই শহর থেকে গ্রামে এসেছেন। সামনে ভাতের গামলাসহ চার পাত্রে চার রকমের তরকারি। ৩-৪টি করে ভাজা পুঁটি নেয়া শেষ করে বারবার মর্জলা নিচ্ছিলাম। আমাদের মর্জলা খাওয়া দেখে গিন্নি বললেন, ‘আপনারা দুই তরকারি দিয়েই কি খাওয়া শেষ করবেন? আরো দুই তরকারি আছে; সেগুলো খাবে কে?’ বুঝতে পারছি, নরম মাছ দিয়ে রান্না করা মর্জলার ওপর নজর অন্দর মহলেরও। পাতলা ঝোলের কাঁচাবাগারের মাছ মুখে দিয়ে বুঝতে পারি, স্বাদ কারে কয়! বাকি থাকে ‘টক’। টকের মাছ এতই ছোট যে, কাঁটা বাছতে হয় না। প্রতি নলায় (লোকমায়) ১-২টি করে মাছ মুখে তুলে চিবিয়ে খেতে গিয়ে আধুনিক পোলাও-কাচ্চি তুচ্ছ মনে হয়েছিল। সব তরকারির স্বাদ চাখতে গিয়ে সেদিন সবাই ভাত অনেক বেশি খেয়েছিলাম।

২৫ অক্টোবর মৎস্য আহরণের নিষিদ্ধ দিবস। ঝড়-বৃষ্টিতে উত্তাল নদী। গাঁয়ের উত্তর দিকে মেঘনায় ‘মাইর’ পড়েছে ইলিশ মাছ আর দক্ষিণের বিলে মাইর পড়েছে গুঁড়া মাছ। চার দিকে মাছের মাইরে জেলেদের ঘুম নষ্ট। কেউ কেউ ‘টম অ্যান্ড জেরি’ খেলার মতো, এক দিকে সঙ্গোপনে নদীতে জাল ফেলছে অপর দিকে ফিশারিওয়ালাদের দেখে জাল জলে রেখেই নৌকা নিয়ে ভাগছে। রেখে আসা জাল চোখে পড়লে তুলে নিয়ে যায় ফিশারি ডিপার্টমেন্টের লোকজন। সস্তায় মাছ কেনার জন্য ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকে এলাকার অনেক নারী-পুরুষ।

দক্ষিণের বিলে মাছ ধরতে বাধা নেই। চার দশক আগের বিল আর বিল নেই। বিল ও ফসলের মাঠজুড়ে বাস্তুহারাদের বিক্ষিপ্ত বাড়িঘর। এক দিকে নদীর ভাঙন, আরেক দিকে সরকারের উন্নয়নের জোয়ার। গাঁয়ের মেঠোপথ এখন ইট বিছানো সড়ক। এর মোড়ে মোড়ে দোকানপাট। তিন সড়কের সংযোগস্থলে নবনির্মিত প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাস্তার উভয় পাশে চা, নাস্তা, চটপটি, সেলুন, তরকারি ও কসমেটিকসের দোকান। সকালে নাস্তার দোকানে এবং অনেক রাত পর্যন্ত চায়ের দোকানে মানুষের ভিড়। বাড়ি-ঘর উত্তোলনের পর বিলের কিছু অংশ এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। সে অংশে কিলবিল করে মাছ। গুঁড়া মাছ ধরার জন্য মৌসুমি জেলেরা (স্বল্পপুঁজির বেকার, যারা শুধু বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরার কাজ করে) সন্ধ্যার দিকে পেতে রাখে বৈচানি (বাঁশের কঞ্চির তৈরি) আলতা (চাঁইয়ের মতো), পাতা জাল, কারেন্ট জাল, চায়না জালসহ (মাছ ধরার নতুন প্রযুক্তি) গুঁড়া মাছ ধরার নানারকম ফাঁদ। এ সময় শুধু মাছ নয়, শরতের স্নিগ্ধ প্রকৃতি দর্শনের জন্য অনেকই গাঁয়ে আসতে শুরু করে। প্রকৃতি দর্শনের ফাঁকে ফাঁকে সবার নজরই গুঁড়া মাছের দিকে।

আমাদের আরেক পরিচয় ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ আর দেশের পরিচয় ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’। বর্ষায় গাঁয়ে এলে উক্তি দু’টির সার্থকতা পাওয়া যায়। আইইউসিএন (২০০৩) এর তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে ৪০০ প্রজাতির বেশি মাছ পাওয়া যায়। দেশের ৪০০ এর অধিক নদী, অসংখ্য খাল, বিল, হাওর, ডোবা ও নালায় পাওয়া যায় এসব মাছ। দেশের যেখানে পানি সেখানেই মাছ। আমাদের এই ছোট্ট ভূখণ্ডে যত প্রজাতির মাছ রয়েছে, তত প্রজাতির মাছ বিশ্বের আর কোথাও আছে কি না, সন্দেহ। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটির কার্যকারিতা শহরে হারিয়ে গেলেও রয়ে গেছে গাঁয়ে। করোনাভাইরাসের থাবায় লকডাউনসহ শহরে যখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, তখনো গাঁয়ের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক।

করোনার সাথে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক অস্বীকার করার জো নেই। এ কারণেই কোনো ব্যক্তি, এলাকা বা দেশ প্রকৃতি থেকে যত দূরে সরে যায়, করোনাভাইরাস তত কাছে চলে আসে। গাঁয়ের মানুষ এখনো ‘প্রকৃতির সন্তান’। মায়ের কোল সন্তানের জন্য যত নিরাপদ গাঁয়ের কোলও সন্তানের জন্য তত নিরাপদ। তাই শারীরিক ও মানসিক সমস্যা শহরবাসীর তুলনায় গ্রামবাসীর কম। গাঁয়ের মানুষের ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, ব্লাডপ্রেসার, হৃদরোগ, চোখের সমস্যা এক সময় ছিল না বললেই চলে। গাঁয়ে স্বাস্থ্যগত সমস্যা কম হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে ফর্মালিনমুক্ত মুক্ত পানির গুঁড়া মাছ অন্যতম। গাঁয়ের মৎস্যজীবীরা বড় মাছ শহরে পাঠিয়ে গুঁড়া মাছ বিক্রি করে গাঁয়ে।

বর্ষার শুরু ও শেষে গুঁড়া মাছের ছড়াছড়ি। যেখানে শহরে ১০০ টাকার কমে মাছ পাওয়া যায় না, সেখানে গাঁয়ে ২০-২৫ টাকার গুঁড়া মাছ কয়েকবার খাওয়া যায়। শুধু দামে কম নয়; স্বাদে ও উপকারিতায়ও অসাধারণ। খনিজ লবণ, ভিটামিন ‘এ’, প্রোটিন, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি-৩, ফ্যাটি অ্যাসিড ও মিথিওনিনের ভালো উৎস গুঁড়া মাছ। মানবদেহে দৈনিক প্রচুর ক্যালসিয়ামের চাহিদা থাকে। বিশেষ করে বাড়ন্ত শিশু, গর্ভবতী মা এবং প্রসূতি মায়েদের ক্যালসিয়ামের চাহিদা বেশি। হাড় ও দাঁত গঠনে ক্যালসিয়াম খুবই দরকারী। তাই প্রতিদিন আমাদের ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ গুঁড়া মাছ খাওয়া উচিত। এ ছাড়া যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ গুঁড়া মাছ তাদের ব্লাডপ্রেসার কমাতে সাহায্য করবে।

গুঁড়া মাছের একটাই সমস্যা, রান্নার আগে কাটা-কুটি। বিশেষ করে বজুরি, গুতুম, বাইমের ক্যাচড়া ও শিংয়ের কড়া ইত্যাদি মাছ কাটা বিরক্তিকর। একটু অসাবধান হলেই শিংয়ের বিষাক্ত কাঁটা মহিলাদের নরম আঙুলে ঢুকে পড়ে। শিংয়ের কাঁটা আঙুলে ঢুকলেই দফারফা। শ্রুত আছে যে, অসহায় স্বামী কর্তৃক ‘দজ্জাল’ বউদের শায়েস্তা করার সহজ উপায় বারবার গুঁড়া মাছ কিনে আনা। গুঁড়া মাছের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম আলতা ও চায়না জালের মাছ। আলতা গুঁড়া মাছ ধরার পুরনো প্রযুক্তি। শহরে গুঁড়া মাছ পাওয়া গেলেও বড় মাছের চেয়েও দাম বেশি। তাই ঠিক করি, শহরে যাওয়ার সময় গুঁড়া মাছ নিয়ে যাবো। চায়না জালের মাছ নেয়ার পরামর্শ দেয় সবাই। ৩০-৪০ ফুট লম্বা লোহার ফ্রেমের ওপর একেকটা চায়না জাল দেখতে প্রকাণ্ড অজগরের মতো। জালে কিছু দূর পরপর চাঁইয়ের বানার মতো ছিদ্র। এ ছিদ্রপথে মাছ শুধু ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। সুতার জাল থেকে ছাড়াতে গিয়ে মাছের গায়ে দাগ পড়ে। দীর্ঘসময় জালে আটকে থাকা মাছ মরে যায়। আর চায়না জালের মাছের গায়ে জালের ছোঁয়াও লাগে না। মাছ থাকে টাটকা ঝকঝকে। পরদিন ফজর নামাজ আদায় করেই চলে যাই বিলের চূড়ায় তেরাস্তায়। কোমর পানি বিলে ছোট ছোট নৌকা। সবাই মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত। কেউ কেউ পানিতে নেমে জাল তুলছে।

নদীর ওপার বৈদ্যেরবাজার। প্রতিদিন ভোরে বসে বৈদ্যেরবাজার মাছের ঘাট। ঘাটে বিক্রি হয় লটকে লট মাছ। শহর থেকে পাইকার আসে মাছ কেনার জন্য। ডাকাডাকি করে মাছ কেনা-বেচা হয়। অল্পস্বল্প মাছ নিয়ে কেউ ঘাটে আসে না। গ্রামে বিক্রি না হলে চলে যায় তুলাতুলি বাজারে। সে বাজারে যাওয়ার পথে বসে থেকে গোটা বিশেক কই মাছসহ দেড় কেজির মতো গুঁড়া মাছ ৯০০ টাকায় কিনে বাড়ি এসে দেখি, গিন্নি কয়েকটি শোল মাছসহ চার কেজি চায়না জালের মাছ কিনেছেন ১৬০০ টাকায়। এত মাছ! নিতে নিতে যদি নষ্ট হয়ে যায়? তার চেয়ে মাছগুলো কেটে নিলে নিরাপদ হবে। কে কাটবে এত মাছ? আমাকে সবার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করার কথা বলে গিন্নি খুঁজতেই বঁটিসহ হাজির হয় কয়েকজন মহিলা। কাটা ও ধোয়ার পর পানি ঝরিয়ে দেখি ৪০ পুঁটলি। এক পুঁটলি একবার করে, ৪০ বার রান্নার মাছ কিনেছি মাত্র আড়াই হাজার টাকায়।

গাঁয়ে এসে গুঁড়া মাছ খেয়ে মনে পড়ে তিন যুগ আগের চিত্র। বর্ষার শুরুতে ওঁছা (বাঁশের নির্মিত বাঁশের হাতলযুক্ত ডুলার মতো ছিদ্রযুক্ত গুঁড়া মাছ ধরার ফাঁদ) ও জালি নিয়ে গুঁড়া মাছ ধরার কথা। গাঁয়ের দক্ষিণের বিলে ‘দাম’ (জলজ ঘাস) ভর্তি থাকত। দামে লুকিয়ে থাকে ইচা মাছের গুঁড়া। জালি বা ওঁছা আস্তে করে ঠেলে ঘাস বাছাই করলেই ঝকঝকে ইচার গুঁড়া। গিন্নিদের কাছে তা প্রিয় হওয়ার কারণ- ইচার গুঁড়া দিয়ে ভর্তাসহ রান্না করা যায় নানা রকমের তরকারি। ‘আশ্বিনে রান্ধে কার্তিকে খায়, যেই বর মাঙ্গে সেই বর পায়’ শৈশবের সেই প্রিয় অনুষ্ঠান ইচার গুঁড়া বাদে চলেই না। ওঁছা দিয়ে গুঁড়া মাছ ধরার দ্বিতীয় পদ্ধতি জিন টেনে। এখানে ‘জিন’ বলতে লম্বা রশি বুঝায়। বর্ষার শেষদিকে যেসব আবর্জনা ও পানাঘাসে গুঁড়া মাছ লুকিয়ে থাকে সেসব স্থানে পরপর কয়েকটি ওঁছা পেতে রাখা হয়। ওঁছাগুলো এমনভাবে পাতা হয় যাতে গুঁড়া মাছ তাড়া খেয়ে ওঁছার ভেতরকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করে। দূর থেকে জিনের দুই প্রান্ত দুইজন ধরে পানাঘাসের ভেতর থেকে গুঁড়া মাছ তাড়িয়ে ওঁছার দিকে আনতে হয়। গুঁড়া মাছ জিনের আগে আগে এসে আশ্রয় নেয় ওঁছার ভেতরের ফাঁকা স্থানে। টেনে তুলতেই ওঁছার ভেতর ঝলমল করে গুঁড়া মাছ।

বর্ষার শেষদিকে গুঁড়া মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। এক দিকে পানি কমতে শুরু করে, আরেক দিকে বড় মাছের ভয়ে ছোট মাছ খাল-বিল-ডোবা-নালায় কচুরিপানাসহ জলজ আবর্জনার তলে আশ্রয় নেয়। তখন জালিসহ নানা রকমের জাল নিয়ে শৌখিন লোকজনও শখ করে মাছ ধরতে নামে। সে দিন ভাটার সময় খালের দিকে চেয়ে দেখি, কম্পিউটারের প্রফেসর। মালকোঁচা দিয়ে কাজিনের সাথে কচুরিপানার তলায় জালি ঢুকিয়ে গুঁড়া মাছ ধরেছে। আমি কোষা নৌকায় করে কাছে যেতেই সলজ্জ সালাম দিয়ে, ‘মামা, কলেজ বন্ধ, সময় কাটে না, তাই গোসল করার আগে---’। ‘লজ্জার কী আছে? আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ও মাছ ধরেন। তোমাদের মাছ ধরা দেখে নামতে ইচ্ছে করছে আমারও।’

‘গেঁয়ো’ শব্দের আভিধানিক অর্থ- অমার্জিত, অশিক্ষিত, মূর্খ ও অজ্ঞ, ইত্যাদি অপবাদ। অপবাদ ঘুচানোর জন্য একদিন গাঁ ছেড়েছিলাম। ভোগ-বিলাস ও চাকচিক্যে গাঁ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলাম শহরে। হীরার বদলে কাঁচ গ্রহণের মতো শহরে এসে হারিয়েছি নির্মল বায়ু, পূর্ণিবাসর রাত, সরল মানুষ, পেয়েছি বিষাক্ত বায়ু, ফর্মালিনযুক্ত খাদ্য ও জটিল মানুষ। উন্নত জীবনের হাতছানিতে দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে পরিবারের সবাই। লন্ডন, ফ্রান্স ও সুইডেন বিশ্বের তিন দেশে বাস করছে তিন মেয়ে। তাদের সুখ দেখার জন্য মাঝে মধ্যে ছুটে যাই। বিশেষ করে ইউরোপ বেড়াতে গিয়ে প্রথম পরিচয় হয় ‘ফ্রোজেন’ শব্দের সাথে। বুঝতে পারি, ‘ফ্রিজজাত’ থেকে ফ্রোজেন শব্দের উৎপত্তি। বড় মেয়ে যত্ন করে পাক করে ভেড়ার ফ্রোজেন গোশত। পাকিস্তানি বাসমতি চালের ভাতের সাথে ভেড়ার গোশত। মুখেই তুলতে পারিনি। বেশি কাঁচামরিচ দিয়ে ডিম ভাজা করে কোনোরকমে ক্ষুধা তাড়ানোর চেষ্টা করেছি। বাজার করার সময় তাদের সাথে গিয়েছি বাজারে। দোকানের তাকে তাকে মাছ-গোশত ও সবজি। তাকগুলোই ফ্রিজ। পণ্যের গায়ে ব্যবহারের সময়কাল লেখা রয়েছে। কোথা থেকে কিভাবে ফ্রিজে ঢুকেছে, জানা নেই। কিনে আনা ফ্রোজেন মাছ খেতে গিয়ে বুঝতে পারি, মুক্ত পানি থেকে সদ্য তুলে আনা মাছের কী স্বাদ! দেশে তাজা গোশত খেয়ে বিদেশের ফ্রোজেন করা গোশত জিহ্বা যে কারণে অ্যালাউ করে না, সে কারণে গাঁয়ের টাটকা মাছের স্বাদ নেয়ার পর শহরের ফর্মালিনযুক্ত চাষের মাছও জিহ্বা অ্যালাউ করতে চায় না।

শুধু মাছ-গোশতের ক্ষেত্রে নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রে আমরা প্রকৃতিকে যত দূরে সরিয়ে দিচ্ছি, তত দূরে সরে পড়ছে প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধাও। দেহ থেকে ফুরিয়ে যাচ্ছে অটোরিপেয়ারিং (প্রতিরোধ) ক্ষমতাও। গাঁয়ে থাকাকালে আমাদের ডাক্তার ছিলেন হাতুড়ে। নাম সিদ্দিকুর রহমান। আমরা বলতাম ‘সিদ্দিডাক্তার’। যখন যেতাম তখনই দেখতাম, এক লোক টেবিলের ওপর পাথরের পাত্রে নোড়া দিয়ে সর্বক্ষণ ট্যাবলেট চূর্ণ করছে। নানা রকমের ট্যাবলেট চূর্ণ করে পুরিন্দাসহ মিক্সারই ছিল তার প্রধান ওষুধ। দূর-দূরান্ত থেকে রোগী আসত। ফজর নামাজ পড়ে চেম্বার খুলতেন, বন্ধ করতেন সকাল ৯টায়। চিকিৎসা বন্ধ করে চলে যেতেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায়। তাই সকাল সকাল গিয়ে লাইন দিতাম। বড় ধরনের রোগ-বালাই হলে চলে যেতাম নদীর ওপারে বারদীবাজারে। গাঁয়ের সিঁড়ি থেকে উপরে ওঠার পর খুঁজে বের করতাম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আরো কয়েক সিঁড়ি উঠার পর এখন চলছে বিদেশে চিকিৎসা। আমি যাই কলকাতা মুকুন্দপুর আর গিন্নি যান মাদ্রাজের চেন্নাই। দু’জন প্রতিদিন ৮-১০টি করে ট্যাবলেট খাই। ট্যাবলেট খুঁজে বের করার যন্ত্রণায় গিন্নি মাঝে মধ্যে বলেন, ‘আমাকে গাঁয়ে পাঠিয়ে দিন। গাঁয়ে গেলে কোনো ওষুধই খেতে হয় না। নিতে হয় না ইনসুলিনও।’

ঈদ ও পূজাপার্বণে দেখতাম, শহর ছেড়ে গাঁয়ে যাওয়ার জন্য মানুষের ঢল। লঞ্চঘাট, বাসটার্মিনাল ও রেলস্টেশনে গিজগিজ করছে মানুষ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রক্তের টানে গাঁয়ের পানে ছুটছে তো ছুটছেই। অশিক্ষিত, মূর্খ, অজ্ঞ অপবাদ ঘুচানোর জন্য যে দিন থেকে গাঁ ছেড়েছি, সে দিন জীবন থেকে প্রকৃতিও হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। আমরা প্রকৃতির কোল থেকে যতই দূরে সরে যাচ্ছি ততই বাড়ছে দৈহিক ও মানসিক সমস্যা।

গাঁ ছেড়েছি আশির দশকে। নব্বইয়ের দশকে সোনারগাঁওয়ে একটি বাড়ি করি। বাবা-মা থাকতেন গাঁয়ে। মাঝে মধ্যে আমাদের জন্য নদীর টাটকা মাছ ও খাঁটি দুধ নিয়ে আসতেন। মা আনতেন নিজ হাতে বানানো পিঠা ও লেঞ্জাধানের খই-মুড়ি। তখন অর্থের অভাব থাকলেও সুখ-স্বস্তির অভাব ছিল না। বাবা-মাকে বলতাম, ‘এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবেন।’ দু’দিন যেতে না যেতেই বাবা-মা গাঁয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য ছটফট করতেন। বেলাশেষে গাঁয়ের দিকে মুখ করে নতুন বাড়ির ঘাটায় বসে থাকতেন। গাঁয়ে বাবা-মাকে রান্না করে খেতে হয়। এখানে রান্নার চিন্তা নেই। নাতি-নাতনীদের সাথে খুনসুটি করে দিন কাটে। তারপরেও গাঁয়ে যাওয়ার জন্য কাতর হয়ে থাকার কারণ তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, জন্মভূমির সাথে মানুষের সম্পর্ক আজন্ম- নাটাই আর ঘুড্ডির সম্পর্কের মতোই। ঘুড্ডি মাটির মায়া ছেড়ে বাউলা বাতাসে আউলা-জাউলা গোত্তা যাই খাক না কেনো, সূক্ষ্ম সুতার সংযোগ এড়াতে পারে না। সুখের সন্ধানে কবি মধুসূদন দত্ত বিশ্বঘুরে নিঃস্ব হয়ে দুঃসময়ে তার মনে পড়েছিল গাঁয়ের কথা। গাঁয়ে বাস্তবে যে নদী খটখটে শুকনো, কাদা ও কচুরিপানা ভর্তি, সে কপোতাক্ষই কবির কাছে ‘মাতৃভূমি স্তনে দুগ্ধস্রোতরূপী’ মনে হয়েছিল। ভ্রান্তির ছলনে নদীর কলকল ধ্বনিতে কান জুড়িয়ে বিশ্বের অতুলনীয় নদীরূপে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে/ কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে।’
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক

adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন: অর্থমন্ত্রী বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেল চিকিৎসাধীন কয়েক শ' শিশু নাটোরে ভ্যানচালককে কুপিয়ে হত্যা হাজীদের জন্য বাড়ি ভাড়া করতে পারছে না বেসরকারি এজেন্সিরা গাজার যে ছবি 'ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অব দ্য ইয়ার' গুঁড়া চিংড়ির কেজি ১৬০০ টাকা! গাজায় যুদ্ধবিরতি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকতে চাইছে না কাতার থামছে না পুঁজিবাজারে পতন বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভোট শুরু: নাগাল্যান্ডে ভোটার উপস্থিতি প্রায় শূন্য কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপির হাল ধরার কেউ নেই : ওবায়দুল কাদের

সকল