২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হবে তো?

-

উ চ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের জীবনে একটি টার্নিং পয়েন্ট কারণ এই পরীক্ষার মাধ্যমে শিখন কার্যক্রম কোনো অবস্থায় আছে তা যাচাই করা হয়, দেশে বা বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এবং শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনে প্রবেশের দরজা ও মানদণ্ড এটি। এই পরীক্ষার আগেও বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের শিক্ষার্থীদের আরো তিনটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হচ্ছে। তার একটি হচ্ছে সমাপনী পরীক্ষা, দ্বিতীয়টি জেএসসি পরীক্ষা এবং তৃতীয়টি এসএসসি পরীক্ষা। শিক্ষাবিদরা শুরু থেকেই বলে আসছেন যে, এসএসসি পরীক্ষার আগের দু’টি পরীক্ষা যখন শিক্ষার্থীদের দিতে হয় ওই বয়সে তাদের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণ করে তা উপস্থাপন করার পর্যায়ে তারা পৌঁছায় না অর্থাৎ তাদের মধ্যে সে রকম পরিপক্বতা আসে না। ফলে ওই ফলাফল তাদের প্রকৃত মেধা যাচাইয়ের কথা বলে না। উচ্চ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে বিষয়টি কিন্তু তা নয়। এই বয়সে শিক্ষার্থীরা অনেকটাই পরিপক্বতা অর্জন করে। তারা জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে এই পরীক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়ে থাকে। পূর্ববর্তী পরীক্ষাগুলোতে যারা খুব একটা ভালো করতে পারে না তারাও প্রাণপণ চেষ্টা করে এই পরীক্ষায় ভালো করতে। কারণ তাদের হয় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, না হয় ‘কাজের বাজারে’ প্রবেশ করতে হবে। আর এটি তো আমরা সবাই জানি যে, এসএসসির পর সবাই কিন্তু এইচএসসিতে পড়তে আসে না, অনেকেই ঝরে পড়ে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের কারণে আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাও বাতিল করতে হলো। এই পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ১ এপ্রিল। সেই থেকে তারা অভিভাবকসহ দারুণ এক দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল পরীক্ষা হবে কি হবে না, হলেও কবে হবে। সেই দুশ্চিন্তা থেকে শিক্ষার্থীরা সরকারি সিদ্ধান্তে মুক্তি পেল। পরীক্ষা মুক্তির স্বাদ ও মজাই আলাদা!

এবার (২০২০ সালে) এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার জন্য দেশে ১৩ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি অর্থাৎ প্রায় ১৪ লাখ নিবন্ধিত শিক্ষার্থী ছিল। আগের বছরগুলোতে অকৃতকার্য আড়াই লাখের বেশি শিক্ষার্থীর চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল। এদের মধ্যে এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এক বিষয়ে ফেল করেছিল। ৫৪ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী দুই বিষয়ে এবং ৫১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী তিন বা ততোধিক বিষয়ে অকৃতকার্য। তাদের সবাই জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। পরীক্ষার্থীরা তাদের জেএসসি ও এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষায় যে ফল পেয়েছিল তার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ করা হবে। ডিসেম্বর মাসে এ ফল প্রকাশ করা হতে পারে। শিক্ষামন্ত্রী আরো জানান, পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়নের জন্য একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছে যেখানে আহ্বায়ক হিসেবে আছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। এ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদরা রয়েছেন এ কমিটিতে। আর এ কমিটির সদস্য সচিব থাকছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পরামর্শক কমিটির সুপারিশ পাওযা যাবে বলে আশা করে মন্ত্রী বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে ফল প্রকাশ করতে পারব।’ বিগত দু’টি পাবলিক পরীক্ষা অর্থাৎ জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে এইচএসসি। টেস্ট পরীক্ষার ফলকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন না মন্ত্রণালয়। গত বছর যারা উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় এক বা একাধিক বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছিল তাদের মূল্যায়নও বিগত জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে করা হবে, কারণ তারাও তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে।

গত বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ ৫ পেয়েছে ৪৭ হাজার ২৮৬ জন, যা মোট পরীক্ষার্থীর ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গত বছর মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছিল ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন। গত বছর যারা এক বা দুই বিষয়ে ফেল করেছে তাদেরও জেএসসি ও এসএসসির ওই বিষয়ের ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতবার এইচএসসি পরীক্ষা ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন অংশ নিয়ে পাস করে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন। সেই হিসাবে তিন লাখ ৪৮ হাজার ৪৫৭ জন পরীক্ষার্থী, যারা এবার আর কোনো পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও উচ্চ মাধ্যমিকের সনদ পেতে যাচ্ছে।

করোনার সংক্রমণ এড়াতে ২০২০ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা সরাসরি না নিয়ে ভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সরকারকে। এ পরীক্ষায় পাস করানো হবে সব শিক্ষার্থীকেই, এটি একটি বড় সমস্যা। সে জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়েছে। ভারত, চীন, হংকংসহ বেশির ভাগ দেশে পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে বা এখনো স্থগিত রয়েছে। পরীক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে তাদের মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পরীক্ষা চলাকালে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি কিভাবে এড়ানো বা হ্রাস করা যায়, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কাটছাঁট করে পরীক্ষা নিলেও ৩০ থেকে ৩২ কর্মদিবসের প্রয়োজন। প্রতি বেঞ্চে দু’জনের জায়গায় একজন বসালে দুই হাজার ৫৭৯টি কেন্দ্রের জায়গায় দ্বিগুণ কেন্দ্র প্রস্তুত করতে হবে। কেন্দ্র বাড়লে কেন্দ্রভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্যাকেট করতে হবে, এতে আগের প্যাকেট ভেঙে নতুন প্যাকেট করার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া কেন্দ্র দ্বিগুণ করতে হলে প্রশাসনিক জনবল দ্বিগুণ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের জনবলও দ্বিগুণ করার প্রয়োজন হবে। এর সব কিছুর মধ্যে রয়েছে করোনা ছড়ানোর ঝুঁকি। ভার্চুয়াল বেস্ট প্র্যাকটিস দেখেই মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো সমস্যার মুখোমুখি না হয়, সে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

তবে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার কোনটি থেকে কত শতাংশ নেয়া হবে কিংবা দু’টির গড় করা হবে কি না সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পরামর্শক কমিটি সেটি ঠিক করবে। যারা এসএসসির পর উচ্চ মাধ্যমিকে এসে বিভাগ পরিবর্তন করেছে, তাদের মূল্যায়নের বিষয়েও পরামর্শক কমিটি সুপারিশ করবে। অনেক শিক্ষার্থী এসএসসিতে কম জিপিএ পেলেও এইচএসসির জন্য ভালো প্রস্তুতি নিয়েছিল। তাদের যদি জেএসসি বা এসএসসির পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয় এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা কবে হবে, এ নিয়ে ব্যাপক উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা ছিল সবার মধ্যে। সরকার এ পরীক্ষা নিয়ে যে সিদ্ধান্ত দিলো তাতে এ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অবসান হলো। ঘোষণাটা আসা দরকার ছিল। ভবিষ্যতে কবে করোনার সংক্রমণ কমবে, কবে পরীক্ষা নেয়া যাবে, এটা একেবারে অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছিল।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষা বাতিল করে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানসম্মত হয়নি। এটা ঠিক যে, করোনা পরিস্থিতির কারণেই সরকারকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কিন্তু পরীক্ষা না হলে অনেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি আরো বলেন, সে দিক থেকে এসএসসি ঠিক আছে। তবে কথা হলো, এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষাকে শিক্ষার্থীরা যে গুরুত্ব দেয়, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি মনোযোগ দেয় এইচএসসিতে।’

আমরা জানি, একজন শিক্ষার্থী মেডিক্যাল না ইঞ্জিনিয়ারিং না কৃষিবিজ্ঞান না লেদার টেকনোলজি পড়বে তার ভিত্তিটা এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে অনেকটা নির্ধারিত হয়। এর আগের পরীক্ষাগুলোতে তাদের মধ্যে অনেকেরই সে রকম সিরিয়াসনেস থাকে না এবং তাদের মধ্যে সে ধরনের পরিপক্বতাও আসে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত মানদণ্ড অনুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম পুরোদমে শুরু করার জন্য স্বাভাবিক পরিস্থিতি অর্থাৎ পাঁচ শতাংশের নিচে করোনা শনাক্তের হার আমাদের দেশে এখনো হয়নি। কাজেই সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, সেটি একটি বিকল্প। আর কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে ভাবা যেত কি না সেটাও বিবেচনার বিষয়। এখানে স্পষ্ট হয়েছে যে, শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়ন এবং অবিরত মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের জীবনে, শিক্ষকদের কাছে এবং পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় অত্যন্ত মূল্যবান। সেই বিষয়টি ভালোভাবে বিবেচনায় নিলে আজ এত কাঠখড় হয়তো পোড়াতে হতো না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভালো হলে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই পরীক্ষা নিতে হবে। আলাদা পরীক্ষা না নিয়ে, সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করা না হয় সে দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।
ইমেইল : masumbillah65@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement