২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দেশে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত। - ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। তাদের ৭৫ শতাংশ এখন ভ্রমণ করেন এশিয়ার দেশগুলোতে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও সারা বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল কয়েকটি পর্যটন মার্কেটের অন্যতম। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৪ সালে পর্যটন খাতে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর এ খাতে গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ হারে কর্মসংস্থান বাড়ার সম্ভাবনা আছে। সে হিসাবে, ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত বিভিন্ন সেক্টরের যেমন- পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য যোগাযোগব্যবস্থা থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য কোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি। দেশে দেশে পর্যটন শিল্পকে বৈদেশিক মুদ্রা খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক তৃতীয়াংশের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন শিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন জীবিকার জন্য এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশে প্রতি বছর ৯০ থেকে ৯৫ লাখ পর্যটক দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণ করে থাকেন। বাংলাদেশ হাজার বছরের পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ। বগুড়ার মহাস্থান গড়, কুমিল্লার বৌদ্ধ বিহার, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, ছোট কাটারা, বড় কাটারা, মোগল পাঠান যুগের ঐতিহাসিক মসজিদ, ঈদগাহ, সোনার গাঁও ইত্যাদির ঐতিহ্য রয়েছে। রয়েছে অনন্যসাধারণ সুন্দরবন। আছে কুয়াকাটা ও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, পাহাড়ঘেরা পার্বত্য এলাকা চট্টগ্রাম, সিলেটের চা-বাগানগুলোর অপার সৌন্দর্য, রামু, গজনি, দুর্গাপুর, বিজয়পুর, মাধবকুণ্ড। এর কোনোটিতে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। তবে এখনো অনেক স্থানে থাকা-খাওয়ার সুবিধা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে আমাদের চেয়ে অনেক ছোট দেশ মালদ্বীপের পর্যটন খাতে আয় বিপুল। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে কয়েক মাইল পরিধির টোগো দ্বীপ পর্যটন খাতে প্রতি বছর বাংলাদেশী টাকায় আয় করছে দুই হাজার কোটি টাকা আর বাংলাদেশে এ খাতে যে আয় হয়ে থাকে তা অতি নগণ্য।

দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে শুধু কিছু হোটেল-মোটেল নির্মাণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। পর্যটকদের যাতায়াত, নিরাপত্তা, থাকা-খাওয়ার সুবিধাসহ সব কিছুর সুবন্দোবস্ত থাকা আবশ্যক। শহর, নগরগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে। তাহলেই কেবল পর্যটন খাতে ভালো ভবিষ্যতে আশা করা যেতে পারে। বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায় যাতায়াত ব্যবস্থার সুবন্দোবস্ত না থাকায় এ সৈকতে এখনো কাঙ্খিত সংখ্যায় পর্যটকের আনাগোনা নেই। কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা বেশি বলে অনেকে বলে থাকেন। এখানে বেড়াতে এসে অনেকে দুর্বৃত্তের কবলে পড়েন। কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকতে গোসলে গিয়ে অনেকে বিপদে পড়েন ও প্রাণ হারান। কাজেই স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া পর্যটন শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। যে সব স্থানে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে, সেগুলোর সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতা বজায় রাখা আবশ্যক। একই সাথে দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানে সময়োচিত বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে পর্যটন শিল্প বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

পর্যটন শিল্প দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। বিদেশী পর্যটক ছাড়াও অভ্যন্তরীণ পর্যটন বিষয়ক ভাবনা-চিন্তা করার সময় এসেছে। এ জন্য বিভিন্ন স্পট তৈরি করে আনুষঙ্গিক সুবিধা জোরদার করতে হবে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপি খাতে পর্যটন শিল্পের অবদান ছিল ৮৫০ বিলিয়ন টাকা। এখাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ২৪ লাখ ৩২ হাজার। একই বছর পর্যটন খাতে বিনিয়োগ এসেছে ৪৩ বিলিয়ন টাকা।

আমাদের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত, যা আর পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতটি কোথাও কাদার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাই কক্সবাজার সমুদ্র্রসৈকত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং এর রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বর্তমানে কক্সবাজার নিয়ে চলছে নানা পরিকল্পনা। সম্পতি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগর পাড়ে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে পর্যটননগরী কক্সবাজারের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বের পর্যটক বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটন আকর্ষণে কক্সবাজারে আসে। এখানে তিনটি পর্যটন পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এটা সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। এগুলো নির্মাণ করা হলে ২০০ কোটি ডলার আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হলো সাবরাং ট্যুরিজম, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। পৃথিবীর বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের মোট বনভূমির ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশ। বাকি অংশ ভারতে। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য এটিকে পৃথিবীর অন্য যেকোনো পর্যটন কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র রূপে উপস্থাপন করেছে। সুন্দরবনকে জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, খাল, শত শত শাখানদী, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। সুন্দরবন নামের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বনভূমিটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানা ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির, ডলফিন ও সাপসহ অসংখ্য প্রাণীর আবাসস্থল।

বাংলাদেশের আরো একটি পর্যটন এলাকা পার্বত্য অঞ্চল, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত। এটা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের এলাকা যা তিনটি জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান নিয়ে গঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হলো পাহাড়ঘেরা সবুজ প্রকৃতি, যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। এটি যেন ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলানোর খেলা। এখানে শীতে যেমন এক রূপ ধরা দেয় ভ্রমণপিপাসুদের কাছে, বর্ষায় অন্য রূপে হাজির হয় কাছে। শীতে পাহাড় কুয়াশা ও মেঘের চাদরে ঢাকা থাকে, তার সাথে সোনালি রোদের মিষ্টি আভা। আবার বর্ষায় চার দিকে সবুজের সমারোহ। এ সময় প্রকৃতি ফিরে পায় নতুন যৌবন। বর্ষায় মূলত অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিস্টদের পদচারণা সবচেয়ে বেশি থাকে এ পার্বত্যাঞ্চলে। তখন এখানে ঝরনা, হ্রদ কিংবা নদীপথগুলো নতুন রূপে সেজে ওঠে যা দেখার জন্য অসংখ্য পর্যটক এখানে ভিড় করেন। এর সাথে আছে পাহাড়ের মানুষের ভিন্নধর্মী জীবনাচরণ যা আমাদের চেয়ে আলাদা।

নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। এ শহরে রয়েছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মালনীছড়া চা-বাগান। এ অঞ্চলে আসা পর্যটকদের মন জুড়ায় সৌন্দর্যের লীলা খ্যাত জাফলং, নীল নদ খ্যাত স্বচ্ছ জলরাশির লালাখাল, পাথর জলের মিতালীতে বয়ে যাওয়া বিছানাকান্দির নয়নাভিয়াম সৌন্দর্য। পাহাড় ভেদ করে নেমে আসা পাংথুমাই ঝরনা, সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল, ‘মিনি কক্সবাজার’ হাকালুকি কানাইঘাটের লোভ ছড়ার সৌন্দর্য। বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল আরেকটি পর্যটন এলাকা। কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এই সাত জেলার ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওরাঞ্চল গঠিত। হাওরাঞ্চলের সাগরসদৃশ বিস্তীর্ণ জলরাশির এক অপরূপ মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা নৌকায় বসে বিস্তীর্ণ জলরাশি এক অপরূপ মায়ায় ভেসে বেড়াতে পারেন। হাওরের কোল ঘেঁষে থাকা সীমান্ত নদী, পাহাড়, পাহাড়ি, ঝরনা, হাওর, বাঁওড়ের হিজল, করচ, নলখাগড়া, বনের প্রকৃতিক সৌন্দর্য, নানা প্রজাতির বনজ, জলজপ্রাণী ও আর হাওর পাড়ের বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকা নৈসর্গিক সৌন্দর্য, নানা প্রজাতির বনজ, জলজপ্রাণী আর হাওর পাড়ে বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো খোরাক মিলবে পর্যটক দর্শনার্থীদের।

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পিছিয়ে আছি। এ শিল্পের উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। পর্যটন শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত সব পক্ষকে নিয়ে একসাথে কাজ করতে হবে। দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশী পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সাথে সাথে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সঠিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটনে শিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement