২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া : রাজনীতিক ও সমাজসেবক

ইউসুফ আলী চৌধুরী ওরফে মোহন মিয়া - ফাইল ছবি

ইউসুফ আলী চৌধুরী ওরফে মোহন মিয়ার জন্ম এমন একসময়ে যখন এ দেশের মুসলমান সমাজ শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-বাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, রাজনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। সব ক্ষেত্রে মুসলমানদের এই পশ্চাৎপদ অবস্থা মোহন মিয়াকে অত্যন্ত ব্যথিত করত। কিশোর বয়স থেকেই স্বজাতির মঙ্গলচিন্তায় তিনি বিভোর থাকতেন। ফরিদপুর শহরে সে সময় মাত্র চার-পাঁচ ঘর মুসলমান পরিবার সচ্ছল ছিল। সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ধর্ম, সংস্কৃতির প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রদর্শন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

মোহন মিয়ার শৈশব-কৈশোরে মুসলমান সমাজের অনেকেই হিন্দুদের দেখাদেখি ধুতি পরত, হিন্দুদের পূজা-পার্বণে অংশ নিত এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হিন্দু রীতিনীতি অনুসরণ করত। মোহন মিয়া কখনো এই ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেননি। তিনি শৈশব থেকেই লুঙ্গি, পাজামা, পাঞ্জাবি, শেরোয়ানি, টুপি পরতেন। কৈশোরে ফরায়েজি ঈশান স্কুলে ভর্তি হন। সে সময় শহরের সব স্কুলে হিন্দুরা সরস্বতী পূজা উদযাপন করত মহা ধুমধামের সাথে। মুসলমান ছেলেরাও সে উৎসবে যোগ দিত। পরে ঈশান স্কুলে এবং ফরিদপুর জিলা স্কুলেও ফাতেহা-ই ইয়াজদাহম উপলক্ষে মিলাদ মাহফিল প্রবর্তনের পেছনে মোহন মিয়ার ছিল প্রত্যক্ষ প্রেরণা। মোহন মিয়া তখন তরুণ জমিদার। জিলা স্কুলের কৃতী ছাত্র সুবক্তা আনোয়ার হোসেনকে তিনি একদিন ডেকে পাঠিয়ে জানতে পারেন, জিলা স্কুলে নিয়মিত সরস্বতী পূজা হয় এবং মুসলমান ছেলেরা তাতে চাঁদা দিয়ে, কাজ করে দিয়েও সাহায্য করে। ফাতেহা-ই ইয়াজদাহমে মিলাদ মাহফিলের জন্য আনোয়ার হোসেনকে অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করতে উদ্বুব্ধ করেন এবং নিজে আর্থিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে ফরিদপুর শহরে প্রতি বছর ফাতেহা-ই ইয়াজদাহম, ঈদ, শবেবরাত প্রভৃতি উপলক্ষে নিয়মিত বিরাট ওয়াজ মাহফিল প্রভৃতির ব্যবস্থা করে সমাজে ইসলামী আবহ সৃষ্টি ও মুসলিম সাংস্কৃতিক জাগরণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

মোহন মিয়ার বয়স যখন ১৮ বছর তখন তার পিতা ময়েজউদ্দিন চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। তিনি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। বড় ভাই লাল মিয়া কংগ্রেসি রাজনীতিতে ব্যস্ত। ফলে জমিদারি পরিচালনার গুরু দায়িত্ব মোহন মিয়ার কাঁধেই এসে পড়ে। তরুণ বয়সে এই গুরু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি নিজে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।

জমিদারি জীবনের শুরুতেই তাকে একটা কঠিন সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হয়। পিতা বিস্তর সম্পত্তি রেখে যাওয়ায় পিতৃবৎসল তিন ভাইয়েরই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো জাঁকজমকের সাথে বিরাট আকারে পিতার ফাতেহাখানি করবেন। জমিদারির সব প্রজাকে এ উপলক্ষে দাওয়াত করা হবে। কিন্তু অনুষ্ঠানে গরু জবাই করা নিয়ে আপত্তি জানায় হিন্দু নেতৃবৃন্দসহ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। মোহন মিয়ারা সদ্য পিতৃহারা তিন ভাই তখন এককাট্টা। তারা তিন ভাই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে বলিষ্ঠ যুক্তি দিলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নতি স্বীকারে বাধ্য হন। এভাবেই তাদের দৃঢ়তার ফলে ফরিদপুর শহরে প্রথমবারের মতো গো জবেহ সম্ভব হয়।

ব্রিটিশ আমলে হিন্দু জমিদারদের হাতে অনেক সময়ই মুসলমান প্রজাদের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হতো। একবার ফরিদপুর জেলার বাইশ রশির হিন্দু জমিদারের কোপ দৃষ্টিতে পড়ে বেচু সরকার নামক এক মুসলমান প্রজা। জমিদারের আদেশে বেচু সরকারের দাড়ি ছিঁড়ে দেয়া হয়। এলাকায় প্রবল উত্তেজনার-সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে কোর্টে নালিশ করাও তখন মুসলমান প্রজাদের জন্য ছিল ভয়ের ব্যাপার। এ সময়ে মোহন মিয়া বেচু সরকারের পক্ষে দাঁড়ালে মুসলমান প্রজাদের পক্ষে কোর্টে নালিশ করে এ জঘন্য অন্যায়ের প্রতিকার প্রার্থনা করা হয়। তিনি কলকাতা থেকে ফিরে এসে ফরিদপুর সদর মহকুমার সমগ্র এলাকার মুসলমানদের ফরিদপুর শহরে সমবেত করেন এবং বিক্ষোভ মিছিলের মারফৎ এই জঘন্য কাজের প্রতিবাদ জানান।

এ সবের অর্থ কিন্তু এই নয় যে, মোহন মিয়া সাম্প্রদায়িক ছিলেন। কস্মিনকালেও তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তিনি মুসলমানদের স্বার্থ, মর্যাদা, ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত বরদাস্ত করতেন না। তবে অন্য সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি সম্ভ্রম ও নিরাপত্তার ব্যাপারে সব সময়ই থাকতেন অতি সতর্ক।

অন্যান্য সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মতো কোনো কাজ তিনি কখনো প্রশ্রয় দিতেন না। তার জমিদারি এবং তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে, বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে বহু হিন্দুকে তিনি নিয়োগ দেন। মুসলমানরা ছিল দেশের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী, তাই স্বাভাবিকভাবেই তার প্রচেষ্টা ছিল এই পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা-দীক্ষায় এবং সমস্ত ব্যাপারে অগ্রসর সমাজের সমপর্যায়ে নিয়ে আসা। এটা ছিল যুগের দাবি। যুগের এ দাবি পূরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে তিনি ইতিহাসের নির্ধারিত মিশনই পালন করেন মাত্র।

ফরিদপুর শহর ছাড়া তদানীন্তন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার কোথাও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। তিনি যখন ফরিদপুর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, তখন শিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা ও শিক্ষার সাথে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জেলা বোর্ড তহবিল হতে অনেক সময় নিয়মের বাইরেও অর্থ সাহায্য দান করেছেন। রাজেন্দ্র কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষা উন্নয়নের ব্যাপারে জেলা বোর্ড তহবিল থেকে এ রকম সাহায্য দান করে তিনি প্রবল অডিট আপত্তির সম্মুখীন হলে তিনি এই বলে জবাব দেন যে, ‘জেলা বোর্ডের টাকা জনগণের। জনগণের টাকা দিয়ে জনগণের কাজ করেছি, এ টাকা তো আমার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করিনি। সুতরাং আমি কোনো অন্যায় করিনি।’

শিক্ষা সম্বন্ধে মোহন মিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি খুব বাস্তবমুখী ছিল। তিনি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমাজকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার দিকে লক্ষ্য রেখেই ফরিদপুর শহরের উপকণ্ঠে ‘বায়তুল আমান’ নামে একটি কৃষি শিল্প শিক্ষা প্রকল্প চালু করার প্রয়াস পান। এই উপলক্ষে ১৯৪৫ সালের ২৮ জানুয়ারিতে তিনি এক সম্মেলনের আয়োজন করেন। একে তিনি যে লিখিত স্বাগত ভাষণ পাঠ করেন, তাতে একই সাথে তার ঐতিহ্য প্রীতি ও বাস্তবতা বোধ সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। নানা কারণে তার এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে না পারলেও তার প্রকল্পের রূপরেখা থেকে প্রমাণ হয় তিনি শিক্ষা সম্পর্কে কত উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন।

‘বায়তুল আমান’ প্রকল্পের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল পাঁচটি (এক) ইসলামের আদর্শ সৃষ্টি ও সভ্যতায় অনুপ্রাণিত করে মানুষের মন গড়ে তোলা, (দুই) আধুনিক সভ্যতা ও বিজ্ঞানের সাথে দেশবাসীর পরিচয় ও সম্পর্ক স্থাপন করা, (তিন) জনসাধারণের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ, কর্তব্যবোধ ও কর্মশক্তি সম্বন্ধে চেতনা সৃষ্টি করা, (চার) সৌভ্রাতৃত্বের ভাবধারায় প্রত্যেককে আদর্শ নাগরিক ও সত্যিকার মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলা, (পাঁচ) জনসাধারণের মধ্যে আত্মান্নতির সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। এই পাঁচটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই প্রকল্পে যেসব কর্মসূচি ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনার প্রস্তাব দেয়া হয়, তার মধ্যে ছিল; (১) আবাসিক স্কুল ও মাদরাসা, (২) শিল্প ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিদ্যালয়, (৩) কৃষি ও ডেয়ারি ফার্ম, (৪) মৎস্য চাষ, (৫) ছাপাখানা ও মুখপত্র, (৬) বায়তুল আমানের কর্মকর্তা ও কর্মীদের আদর্শ বসতি, (৭) মসজিদ, (৮) লাইব্রেরি, (৯) ব্যায়ামগার, (১০) মেহমান খানা, (১১) পল্লী উন্নয়ন এবং (১২) চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য। সেই ১৯৪৫ সালে এমন অগ্রসর শিক্ষা পরিকল্পনা ছিল এক কথায় বিস্ময়কর। শিক্ষা সম্বন্ধে এ ধরনের অগ্রসর চিন্তাধারা আমাদের দেশে আর মাত্র একজন লোকের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। তিনি সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

মোহন মিয়ার রাজনীতির একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অন্যদের এগিয়ে দিয়ে নিজে পেছনে থাকতে পছন্দ করতেন। এ জন্য বিভাগপূর্বকালে তো বটেই, পাকিস্তান আমলেও তার পরিচিত ছিল ‘কিং মেকার’ রূপে।
জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে আলিমুজ্জামান চৌধুরী শেষ টার্মে নির্বাচনে অবতীর্ণ হন ১৯৩১ সালে। তখন ফরিদপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন জনৈক অম্বিকা চরণ দত্ত। তিনি আলিমুজ্জামান চৌধুরীর স্থলে জনৈক হিন্দু প্রার্থীকে জয়ী করার উদ্দেশ্যে আলিমুজ্জামান চৌধুরীর কয়েকজন সমর্থক সদস্যকে আটক করে রাখেন। মোহন মিয়া সাহেব এ খবর পেয়ে তড়িৎ বেগে ছুটে যান এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাসভবন থেকে সদস্যদের উদ্ধার করে আলিমুজ্জামানের বিজয় নিশ্চিত করেন। ১৯৫৩ সালে আলিমুজ্জামান চৌধুরী ইন্তেকাল করলে চৌধুরী শামসুদ্দিন আহমদ দুইবছর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৩৭ সালে নিজে সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও মৌলভী তমিজউদ্দিন খাঁকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেন। মৌলভী তমিজউদ্দিন খাঁ ১৯৩৮ সালে প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ায় মোহন মিয়া জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং দুইবছর বাদে একটানা ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। তার চেয়ারম্যান আমলে সারা বাংলাদেশে ফরিদপুর জেলায় সর্বাধিক সংখ্যক নলকূপ খনন করা হয়। বর্তমান রাজবাড়ী জেলা আগে গোয়ালন্দ মহকুমা হিসেবে পরিচিত ছিল। ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরের ডিপো ছিল। মোহন মিয়ার সক্রিয় চেষ্টার ফলেই এই অভিশাপ থেকে রাজবাড়ীর লোকেরা মুক্তি লাভ করেন।

মোহন মিয়ার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির মাধ্যমে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর শেরেবাংলা মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন করে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং পরে সদলবলে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালে শেরেবাংলা যখন মুসলিম লীগ দলীয় প্রধানমন্ত্রী তখন মোহন মিয়া ফরিদপুর জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪১ সালে শেরেবাংলা মুসলিম লীগ ত্যাগ করে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা গঠন করলেও মোহন মিয়া মুসলিম লীগেই থেকে যান। ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নবরূপ পরিগ্রহ করে। ‘বাঁচ এবং বাঁচতে দাও’- এই নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান দাবিতে অচিরেই উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে। ফরিদপুর জেলায় পাকিস্তান আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন ইউসুফ আলী চৌধুরী ওরফে মোহন মিয়া। ১৯৪০ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত একটানা তিনি ফরিদপুর জেলা মুসলিম লিগের সভাপতি ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর একপর্যায়ে তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লিগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ সরকারের সাথে তার বনিবনা না হওয়ায় তিনি ১৯৫৩ সালে মুসলিম লিগের সাথে সম্পর্কছেদ করেন এবং পরে শেরেবাংলা গঠিত কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগদান করেন। এই পার্টির নমিনি হিসেবে তিনি যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি কিছুদিনের জন্য ফজলুল হক কেবিনেটে মন্ত্রিত্বও করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি কৃষক শ্রমিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদের সদস্য হিসেবে ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়নে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ অক্ষুণœ রাখার ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে মার্শাল ল’ জারি হলে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা এক রকম রহিত হয়ে যায়। সেই ঘোর দুর্দিনে ষাটের দশকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে যে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট গঠিত হয়, তার অন্যতম নেতা ছিলেন ইউসুফ আলী চৌধুরী। পরবর্তীকালে দেশে স্বাধিকার আন্দোলন যখন জোরদার হয় তখন এমনকি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম সূচিত হয় তার প্রতিও মোহন মিয়া সাহেবের গভীর সমর্থন ছিল, যদিও আধিপত্যবাদী ভারতের সাহায্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম কতটা বাস্তবতাপ্রসূত এ সম্পর্কে তার বরাবরই একটা সংশয় ছিল। ১৯৭১ সালের সেই ক্রান্তিকালে করাচিতে অবস্থানকালে ২৬ নভেম্বর তারিখে তিনি অকস্মাৎ ইন্তেকাল করেন। এভাবেই এ দেশের জাতিসত্ত্বার এক মহান সেবকের জীবনের সমাপ্তি হয়।

দোষে-গুণে মানুষ। আজীবন রাজনীতি করেছেন বলে তার বিরোধীর সংখ্যাও কম ছিল না। তবুও তার সান্নিধ্যে যারাই গেছেন, সবাই একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য যে, দেশ ও সমাজের উন্নতির লক্ষ্যে তিনি সারা জীবন কাজ করে গেছেন। পাকিস্তান আন্দোলনকালে প্রাদেশিক মুসলিম লিগের সভাপতি মাওলানা আকরম খাঁ একবার বলেছিলেন, ‘যদি আটাশটি জেলায় আটাশ জন মোহন মিয়া পেতাম, তবে অনেক আগেই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে যেতাম।’ কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।


আরো সংবাদ



premium cement