২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নতুন উদ্যোক্তাদের টিকে থাকতে যা করতে হবে

-

করোনা মহামারীর জন্য দায়ী SAARS-COV-2 নামক ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ওষুধ খাত ছাড়া আর যে সব Intervention নেয়া হচ্ছে (যেমন লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব এবং কোয়ারেন্টিন), এগুলোর কারণে বিশ্বজুড়ে এক অভূতপূর্ব ও নজিরবিহীন মন্দা এবং কর্ম-শৈথিল্য সৃষ্টি হয়েছে। কোনো দেশ, অঞ্চল, মহাদেশ এই বৈশ্বিক ব্যাধির মরণ ছোবল থেকে মুক্ত নয়। ২০২০ সালের বৈশ্বিক মন্দার আগাম বার্তা দিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছে, এ বছর বিশ্বের গড় প্রবৃদ্ধি ৫.৯ শতাংশ কমবে। অর্থাৎ করোনাকালীন বৈশ্বিক লোকসানের বাজারমূল্য দাঁড়াবে ১২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। OECD-র হিসাবে এই সঙ্কোচন পুরোপুরি ৬ শতাংশ হবে।

বিশজুড়ে অর্থনীতিবিদ, গবেষক-পণ্ডিত, ব্যাংকার ও চিন্তাশীল মানুষ এখন থেকেই একেবারে ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মধ্যম পর্যায়ের (MSME) উদ্যোক্তাদের ওপর বেশি ভরসা করতে শুরু করেছেন। বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাই পারবেন জগৎজোড়া এই মন্দা, বাজার সঙ্কোচন, উৎপাদনহানি, কাঠামোগত বেকারত্ব (Structural Unemployment) এবং প্রচলিত উৎপাদন উপকরণের বাইরে গিয়ে পরিবেশবান্ধব, জ্বালানিসাশ্রয়ী, শ্রমঘন, সমবায়ী বা সম্মিলিত উদ্যোগ কাঠামো এবং উদ্ভাবনীমূলক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রচলিত মুনাফাসর্বস্ব উৎপাদনের পরিবর্তে বহুপক্ষীয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সামাজিক ব্যবসায়ী-উদ্যোগের দিকে ঝুঁকতে। এ ধরনের উদ্যোগে উৎপাদনে সামাজিক যৌথ অংশগ্রহণ এবং লাভ-লোকসান ও দায়-দায়িত্বের সমবণ্টিত হিস্যার সুফল খুবই দ্রুত এবং দৃশমানভাবে লাভ করা সম্ভব হবে। সম্মিলিত উদ্যোগের মূল দর্শন হবে মাথা তুলে দাঁড়ানো এবং টিকে থাকা। করোনাকালে যে হারে উপার্জনশীল মানুষ বেকার হয়ে গেছে এবং বড়-মাঝারি ছোট নির্বিশেষে উৎপাদনী উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে, তাতে নতুন বাস্তবতার সাথে সঙ্গতি রেখে নতুন ধরনের মূল্যসোপান (Value Chain) গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এই সোপানে যুক্ত হতে হবে কাঠামোগত স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, পরিবেশ- অনুকূল উৎপাদন ও বর্জ্যব্যবস্থাপনা, জ্বালানিসাশ্রয় অর্থাৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার বা ফায়দা লাভ করা।

বিশ্বজুড়ে চরম ভোগান্তিমূলক করোনাকাল চলছে। কোনো নিশ্চয়তা নেই যে, এই মহামারী সহসা যাবে বা এর পুনঃআত্মপ্রকাশ ঘটবে না; কিংবা ব্যাধির পাশাপাশি অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বরফের আস্তর ভাঙা, সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হওয়া, ঝড়, বন্যা, দাবদাহ, পঙ্গপাল বা কৃষিবিপর্যয়ের মতো দুঃসময় মানবজাতির জন্য অপেক্ষা করছে না। তাই এখন থেকেই সে জন্য তৈরি থাকতে হবে। করোনাকালে এবং করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দায় ঠিক যে ধরনের টেকসই এবং টিকে থাকার মতো উদ্যোগই গৃহীত হোক না কেন, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য এবং মহামারীর মতো বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোগগুলোর সাথে সম্পর্কিত সর্বপক্ষীয় মূল্যসোপানের (Value Chain) পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে যার যার আপন খাতের বা ক্ষেত্রের পূর্ণাঙ্গ সরবরাহসোপান (Supply Chain)। লাভের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে সামাজিক দায়িত্ব, পরিবেশ রক্ষার ব্যবস্থা এবং মুনাফার সামাজিক সুবিচার বা যৌক্তিক বণ্টননীতিকে; শ্রমের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে মেধাকে এবং শিল্প কাঁচামালের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে অব্যাহত গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) কার্যক্রমকে এবং রক্ষণশীলতা সংবরণ করে জেন্ডার সাম্য নীতিকে সম্পৃক্ত করতে হবে মানবসম্পদ (HR) নীতির সাথে।

সময় যতই সামনে এগোবে, ততই নারীর অবদান এবং উৎপাদনে রমণীয় হিস্যার প্রাসঙ্গিকতা বাড়তে থাকবে। একচেটিয়া পুরুষ-প্রাধান্যের যুগাবসান বহু আগেই ঘটে গেছে; করোনা ও করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক নিদেন-আকাল মোকাবেলার কৌশলপটে নারী এক অনিবার্য জেন্ডার ‘ইক্যুয়িটি’, যাকে আর অস্বীকার করা যাবে না। তেমনি তথ্যপ্রযুক্তিসহ যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে, তাতে করোনা ও করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম এবং সর্বাত্মক সদ্যবহার এখন সময়েরই দাবি। অনেক কিছুই ‘ভার্চুয়াল’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হয়েছে এবং হচ্ছে। সেই ‘ভার্চুয়াল’ জীবনযাত্রায় আমাদেরকে আরো নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। অর্থ প্রেরণ সেবা শিল্পে (Payment Industry) RIA, VISA, PayPall, Due, Stripe, Payline Data, Flagship, Adien, BitPay, Go Cardless, Cayan, Amazon Pay, Fintech, Brain Tree, Fast Data, Pay Nova, Boku, Scure ev Trading কিংবা দেশের বিকাশ, নগদ, রকেট ছাড়াও এগিয়ে আসবে আরো অনেক নতুন উদ্যোগ; যেমন নগদ অর্থের ব্যাংক-বহির্ভূত উৎস ‘বিটকয়েন’, EDH, XRP, Light Coin, Tither, Libra, Monroe, EOS, BSV, Binance Coin, Satoshi-এর মতো Cryptocurrency উৎস্যগুলোও ধীরে ধীরে আইনসিদ্ধ হয়ে যাবে, যা শত শত বছরের মুৎসুদ্দিসূলভ ‘হুন্ডি’ ব্যবসার অবসান বা ব্যাপক সঙ্কোচন ঘটাবে। সওদাপণ্য ও সেবা কেনাবেচায় ‘আলীবাবা,’ বা ‘অ্যামাজনের’ মতো বৈশ্বিক অনলাইন দোকানদার ইতোমধ্যেই প্রবল হয়ে উঠেছে। অনলাইন বেচাকেনার এই ধারা উদ্যোক্তাদের খরচ কমাবে, মুনাফাও বাড়াবে। কিছুদিন আগেও কি বাইক রাইড শেয়ারের কথা ভাবা যেত? অথচ এখন ঘর থেকে বের হলেই ‘উবার’, ‘পাঠাও,’ ‘ওভাই’, ‘ওবান’-এর ছড়াছড়ি; ডাকঘর বা ডাক ব্যবস্থা একপ্রকার মৃত্যুবরণই করেছে বিশ্বব্যাপী। ডাকের জায়গায় এসেছে DHL, FedEx, OOCL, Aramex, Gulf World, DTDC, Max Experess, Century Express, Fly Express, ABC Cargo, BLINK, Continental Courier, Dot Express, TNT-প্রভৃতির মতো কত দেশ-জাতি-বর্ণের এক্সপ্রেস কুরিয়ার! প্রতিযোগিতার বাজারে এদের সেবাও বেশি ব্যয়বহুল থাকছে না। ছোট ছোট উদ্যোক্তারাও কী সুন্দর একেকটা ‘অ্যাপস’ খুলে দিব্যি অনলাইন বিকিকিনি পরিচালনা করছেন।

ক্ষুদ্র, মাঝারি ও মধ্যম শ্রেণীর উদ্যোক্তাদের এখন থেকেই টিকে থাকার ক্ষমতা (Resilience) অর্জন করতে হবে, যার মধ্যে থাকবে কৌশলগত ধারা, নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা এবং আজকের পর্যালোচনা থেকে আগামীকালের উপায় অন্বেষণ করা। কোভিড-১৯-এর জন্য কেউ আগাম কিছু জানত না বা প্রস্তুত ছিল না, এর অর্থ এই নয় যে, করোনাকালে দেখা দিতে পারে বা করোনা-পরবর্তী সময়ে হানা দিতে পারে, এমন সব বিপদ মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট ‘Resilience’-এর ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন নেই। টিকে থাকার উপায় কৌশল কেবল করোনাকালের মন্দা মোকাবেলার জন্যই নয়, ভবিষ্যতে এর অনিবার্য অভিঘাত কিংবা এ ধরনের আরো কোনো বালামুসিবত মোকাবেলার জন্যও দরকার।

এ ধরনের উপায়-কৌশলের ব্যবস্থা রাখতে হবে ‘এমএসএমই’-এর নেতৃত্ব নতুন আঙ্গিকে সাজাতে, রাজস্ব যোগানে, ব্যবসায়ী উদ্যোগের কাঠামো পুনর্বিন্যাসে, আর্থিক ব্যবস্থাপনায়, পরিচালনাগত কৌশলে এবং অবশ্যই মূল্যসোপান (Value Chain) ও সরবরাহসোপানকে (Supply Chain) অক্ষত রাখার প্রয়োজনে। এই সোপানগুলো ভেঙে গেলে বা অসংলগ্ন হয়ে গেলে শ্রমিক-কর্মী, কাঁচামাল, প্রযুক্তি ও প্যাকেজিং- সব উপকরণ মজুদ থাকলেও উৎপাদন ব্যাহত হবে। ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের উচিত হবে উৎপাদন ব্যবস্থাপনার চলমান মডেলগুলোর পরিবর্তে ‘টেকসই’ মডেল উদ্ভাবন এবং তা অনুসরণ করা। করোনাকালে মানুষের স্বাস্থ্যহানি ও শারীরিক বিপর্যয় রোধে পুষ্টিকর ও ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যের প্রয়োজন। কম খরচে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের নতুন নতুন মডেল গড়ে তোলার সুযোগ আছে এবং অপরিহার্যতাও রয়েছে। ক্রেতা বা গ্রাহকের প্রতি মমতা বা সহানুভূতি নতুন ব্যবসায়ী মডেলের অন্যতম ভিত্তি হতে পারে; যেমন হতে পারে পরিবেশবান্ধব ব্যবহার্য সামগ্রীর উদ্যোগ বা জৈবসার, পরিবেশ অনুকূল প্যাকেজিং ব্যবস্থা প্রভৃতি। গবেষকরা এটাকে বলছেন উদ্যোক্তার পরিবেশসচেতনতা SME বা MSME কেউই আজ আর একা নয়। তারা এখন বিশ্বের দিকে দিকে সমিতিভুক্ত এবং জোটবদ্ধ। তাদের রয়েছে, ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেস (WASME), ইন্টারন্যাশল কাউন্সিল ফর স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেস (WUSME), ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক ফর স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেস (INSME) প্রভৃতি। এ ছাড়াও দেশ বা এলাকা এবং জেন্ডারভিত্তিক বহু ক্ষুদ্র ও মধ্যম উদ্যোক্তার সঙ্ঘ, সমিতি বা অ্যালায়েন্স আছে, যাদের সাথে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সম্পর্ক গড়ে তুললে সব দিক থেকে লাভবান হবেন। তা ছাড়া এ ধরনের অ্যালায়েন্সগুলোর বেশ কয়েকটির জাতিসঙ্ঘের সাথেও সৌহার্দ্য বন্ধনে আবদ্ধ। জাতিসঙ্ঘ নিজেও এই দুর্দিনে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। জাতিসঙ্ঘ বলেছে- বিশ্বের মোট কর্মসংস্থানের ৭০ শতাংশ, মোট বৈশ্বিক জিডিপির ৯০ শতাংশই এসএমই/ এমএসএমই খাতভুক্ত।

উৎপাদনের অগ্রবর্তী সূত্র ও পশ্চাৎবর্তী সূত্রগুলোর (Forward & Backward Linkage) মধ্যে সমন্বয় ঘটানো এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি। সরকার এবং দাতব্য সংগঠনগুলো আপৎকালীন প্রণোদনার মতো অনেক ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। এগুলোর খোঁজ খবর রাখতে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে উদ্যোক্তাদেরই। সুযোগের একটা বাস-ও যেন কোনো কারণে ‘মিস’ না হয় সেটা উদ্যোক্তাদেরই দেখতে হবে। এখন অংশীদারি ব্যবসা বা ‘পার্টনারশিপের’ ধারণাই অনেকটা বদলে গেছে। কত উদ্যোগের কত স্টেকহোল্ডার কতজনের সাথে যে কতভাবে অংশীদার হতে পারে এবং হচ্ছেও, ভাবতেও অবাক লাগে। ভারতে এ ধরনের একটি সামাজিক উদ্যোগের একেকটি ক্ষেত্রে লাখ লাখ তরুণ উদ্যোক্তা ‘ক্লাস্টার’ বা ‘গ্রুপ’ গঠন করে ঐকবদ্ধ হতে শুরু করেছে। এদের অলস হাত কর্মীর হাতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের CPS (Current Population Survey)-এর জরিপ মোতাবেক, সে দেশের MSME খাত বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মতো অতটা কাবু হয়নি করোনার করাল গ্রাসে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন ‘অফশোর’ উদ্যোগ কমছে এবং বাড়ছে ‘স্টার্টআপ’ উদ্যোগ। এই পরিবর্তনটি বিশ্বের সবার জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement