২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘নতুন স্বাভাবিকে’ দর্শন চর্চা

‘নতুন স্বাভাবিকে’ দর্শন চর্চা - ছবি সংগৃহীত

২০২০ সাল, অতিমারী করোনায় দুনিয়াব্যাপী বদলে যাওয়া বিশ্বের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব সময়ের নাম। মূলত এ বছর আমরা এমন এক জীবন যাপন করছি; যা একই সাথে স্থবির ও অস্থির-উভয়ই। অদৃশ্য এক অণুজীব থেকে রক্ষা পেতে আপ্রাণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববাসী। এ অবস্থায় আমরা নতুন এক জীবন প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হয়েছি, যাকে বলা হচ্ছে ‘নতুন স্বাভাবিক’ বা নিউ নরমাল। নতুন স্বাভাবিক এ বিশ্বে বরাবরের মতোই নভেম্বরের তৃতীয় বৃহস্পতিবার কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে পালিত হয়েছে জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত ‘বিশ্ব দর্শন দিবস’। বদলে যাওয়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ‘নতুনভাবে দর্শনের অনুশীলন’কে উপজীব্য করে এ বছর দিনটি পালন করা হয়।

প্রলয়ঙ্করী কোভিড-১৯ এমন এক স্থবিরতায় সারা বিশ্বকে আবদ্ধ করেছে, যেখানে পাশের বাড়িতে থাকা পড়শি বা স্বজন থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মরক্ষা করছি আমরা। সারা দুনিয়ার সাথে কার্যত এ বিচ্ছিন্নতা মানুষকে বাধ্য করছে নতুন করে সবকিছু নিয়ে ভাবতে। মানুষের মূল্য, সম্পদের ব্যবহার, মানবিক সম্পর্কের জটিলতা, প্রযুক্তির উৎকর্ষ, জনস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক সঙ্কট, প্রকৃতির বৈচিত্র্য- এসব বিষয় ভাবনার জগতে নতুনত্ব এনে করেছে কৌতূহলী হতে। আর যেখানেই মানব কৌতূহল, সেখান থেকেই জন্ম দর্শনের। তাই আজকের এ ভাবনাগুলোর সাথে দর্শনের এক নিবিড় সম্পর্কও আমরা লক্ষ করি।

২০০৫ সাল থেকে জাতিসঙ্ঘ যখন প্রশাসনিকভাবে ‘বিশ্ব দর্শন দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; তখন থেকেই সমসাময়িক বিষয়ে দার্শনিক ভাবনা তথা নতুন নতুন চিন্তাকে প্রাধান্য দেয়া শুরু হয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবে এ বছরও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় দর্শনের তত্ত্বগুলোর প্রয়োগ ও কার্যকারিতার পাশাপাশি নতুন দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রও জ্ঞানের জগৎকে আন্দোলিত করে তুলেছে।

দর্শন আলোচনার গোঁড়ার দিকে একে শুধু বিমূর্ত চিন্তার জ্ঞান হিসেবেই মনে করার একটি প্রবণতা দেখা যায়। যে কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে দর্শন নিয়ে এক প্রকার দুর্বোধ্যতার ধারণা ছিল। তবে দর্শনের শাখা হিসেবে নীতিবিদ্যার আলোচনা দর্শনকে সাধারণ মানুষের বোধগম্য ও জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলেছে ক্রমান্বয়ে। দর্শনের সূতিকাগার রূপে খ্যাত প্রাচীন গ্রিসের পণ্ডিত সক্রেটিস বা প্লেটো থেকে শুরু করে অতি সাম্প্রতিক কালের দার্শনিক আর চিন্তাবিদরাও মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে দার্শনিক বা নৈতিক তত্ত্বগুলোর প্রয়োগের মাধ্যমে এটাকে অর্থবহ করার প্রয়াস পেয়েছেন। সে ধারাবাহিকতায় বর্তমান অতিমারী পরিস্থিতিতে যেসব প্রকৃতিক বা মানবিক সঙ্কটের উদ্ভব হয়েছে বা সঙ্কট দেখা দিয়েছে; সেসবের দার্শনিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের এক তাগিদ দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জনস্বাস্থ্য ইস্যুতে নৈতিক তত্ত্বের প্রয়োগ সাম্প্রতিক সময়ে খুব আলোচিত এক চিন্তা। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের বেলায় কোনটি বেশি বিবেচ্য?- এ প্রশ্নের জন্য নৈতিকতার মুখাপেক্ষী হতে হয়। যদি আমরা উপযোগবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখি, তবে সমাজের সর্বাধিক মানুষের জন্য সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গোষ্ঠীস্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে হয়।

আবার, নৈতিকতার আলোকে ব্যাখ্যা করতে গেলে, মানুষের স্বতন্ত্র মর্যাদা সমুন্নত রাখার প্রশ্নে ব্যক্তিস্বার্থকে গুরুত্ব দেয়াকে সমর্থন করা হবে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ অনুসারে ‘ডু নো হার্ম’ নীতির আলোকে সংক্রামক ব্যাধি হিসেবে করোনার তথ্য একজন চিকিৎসক যেমন রোগীকে অবহিত করা দায়িত্ব একইভাবে অন্যদের সতর্কতারও প্রয়োজন রয়েছে। তবে রোগীর ব্যক্তিত্বের মর্যাদার পাশাপাশি সমাজের সার্বিক স্বার্থের বিবেচনাটিও নৈতিকভাবেই উপলব্ধ হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য প্রসঙ্গের বাইরেও করোনা আমাদের নানা বাস্তব অবস্থার প্রভূত পরিবর্তন করেছে। বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার এ সময়ের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। শিক্ষা, চিকিৎসা এমনকি দাফতরিক ক্ষেত্রেও তথ্য-প্রযুক্তির নানামুখী ব্যবহার দেখা যাচ্ছে।
তবে এর ব্যয় বা সহজসাধ্যতা সবার কতটা উপযোগী? সে প্রশ্নটিও নৈতিক আলোচনার দাবি রাখে। কেননা, আমাদের মতো উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশের নাগরিকদের জীবিকা নির্বাহের স্বাভাবিক পথটি যখন অনেকাংশে জটিলতার সম্মুখীন; তখন তথ্য-প্রযুক্তির বাড়তি ব্যয়ভার অনেক সময় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া তথ্য-প্রযুক্তিগত নানামুখী অপব্যবাহারে অপরাধপ্রবণতাকেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তাই ন্যায়-নীতির প্রয়োগ এখানেও প্রয়োজন।

করোনার জন্য কার্যত স্থবির এ বিশ্বে নানা ধরনের নেতিবাচকতার মধ্যেও প্রকৃতির স্বরূপে ফিরে আসার ইতিবাচক প্রকাশ আমাদের মধ্যে নতুন আশা জাগিয়েছে। অনেকটা সময় কারখানা বা যান্ত্রিক বাহনের সীমিত ব্যবহারে প্রকৃতি যেন নিজেকে গুছিয়ে তুলেছে নিজের মতো করে। যেমন- সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের অনুপস্থিতিতে দেখা মিলেছে সাগরলতার, মোহনায় দেখা গেছে বিলুপ্তপ্রায় ডলফিনের। এমনকি ব্যস্ত রাস্তার পাশে ফুটপাথেও ফুটেছে রঙিন ফুল। পঞ্চগড় জেলা থেকে অনেকটা স্পষ্টভাবে দেখ যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, দূষণমুক্ত নির্মল পরিবেশের জন্যই এ অপরূপ সৌন্দর্য দৃশ্যমান। এখানেও কিন্তু পরিবেশ দার্শনিকদের কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সমসাময়িক পরিবেশবাদী দার্শনিক পিটার সিঙ্গারের মতানুসারে, প্রকৃতিকে জীবন্ত অস্তিত্বের মর্যাদা দিলে প্রকৃতিও তার যথাযথ প্রতিদান দেয় বা বলা যায় প্রকৃতিকে নিরুপদ্রব রাখলে আমরাও ভালো থাকব।

দর্শনের তাত্ত্বিকতার বাস্তব প্রয়োগে বদলে যাওয়া নতুন বিশ্বব্যবস্থায় মানবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে সভ্যতা এগিয়ে যাবে সব প্রতিকূলতা জয় করে। যুগ-যুগান্তরে স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার বিকাশে আমাদের আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালন করবে দর্শন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা কলেজ

Email: zinanphilosophy@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement