২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সাংবাদিক এ ইউ এম ফখরুদ্দীন : স্মৃতির মণি-মাণিক্য

এ ইউ এম ফখরুদ্দীন - ছবি : সংগৃহীত

সাংবাদিকতায় এসেছিলাম ১৯৭৩ সালে। চাকরি জীবনের শুরুতেই এ ইউ এম ফখরুদ্দীন সাহেবের মতো সৎ, সাহসী, বিনয়ী, সৃজনশীল একজন শিক্ষক পেয়েছিলাম। অধুনালুপ্ত ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় সেই সময় সম্পাদক ছিলেন আলহাজ শামসুল হুদা। তিনি লিখিত ইন্টারভিউ নিয়ে আমাকে বললেন, তুমি ফিচার পেজে কাজ করো।

মাহবুবুল আলম ভাই ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক। তিনিও একমত হলে আমি ফিচারে যোগ দিলাম। সেখানেই পেলাম ফিচার এডিটর ফখরুদ্দীন সাহেবকে। এর পর থেকে ছেচল্লিশ বা সাতচল্লিশ বছর একসাথে পথ চলা।

এমন জ্ঞানপিপাসু মানুষ যেমন কম দেখেছি, তেমনি নিজের প্রতি এতটা উদাসীন কেউ হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হতো না।
১৯৫৯ সালে রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের পরিচালনায় ইত্তেফাকের কেন্দ্রীয় ‘কচিকাঁচার মেলা’র আহ্বায়ক হিসেবে পত্রিকাটির সাথে তিনি যুক্ত হন। সেই থেকে লেখালেখির শুরু। দেশের প্রায় সব ইংরেজি দৈনিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। শিল্প-সাহিত্যসহ নানা বিচিত্র বিষয়ে তার অজস্র লেখা প্রকাশ পেয়েছে। দেশ ও জাতির উদ্দেশে কল্যাণমূলক সম্পাদকীয় লিখেছেন অসংখ্য। বাংলা ভাষায়ও অসামান্য দখল ছিল। বলতেন, মাতৃভাষা যে যত ভালো জানবে সে অন্য ভাষা তত সহজে রপ্ত করতে পারবে।

তিনি ছিলেন লন্ডনের ডেইলি মিররের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নানা কৌশলে লন্ডনে পাঠাতেন। ১৯৭১-এর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে একটি প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য গ্রামগঞ্জ ঘুরে ঢাকায় এলে কবি আহসান হাবীব এবং কবি শামসুর রাহমান উনাকে জানালেন চিত্রালীর সম্পাদক পারভেজ ভাই বলেছেন, ফখরুদ্দীন যেন ঢাকায় না আসে, তাকে সামরিক গোয়েন্দারা খুঁজছে। একথা জানার পরও তিনি কর্তব্য থেকে একচুলও সরে না গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনের তথ্য বিভাগের কর্মকর্তা হক ভাইয়ের (অবজারভারের সাবেক সহসম্পাদক) কাছে এনেক্স ভবনে (ডিআইটি ভবনের পূর্বপাশে) ছুটে গেলেন। তারা একসাথে দেখা করলেন ডিরেক্টর হ্যাজেল সাহেবের সাথে। এরপর প্রতিবেদনটি পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। এভাবে তিনি যুদ্ধকালীন সংবাদ বিদেশে পৌঁছে দিয়ে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন, যা সবিস্তারে লেখা হয়েছে ডেইলি মিররের তৎকালীন চিফ ইন্টারন্যাশনাল করেসপন্ডেন্ট জন পিলজারের ‘দ্য হিরোজ’ গ্রন্থে (প্রকাশক : জোনাথন কেপ, লন্ডন, ১৯৮৬)।

সংবাদপত্রের প্রধান কর্তব্য সমাজের সব অসঙ্গতি, ত্রুটি-বিচ্যুতি জনসমক্ষে প্রকাশ করে প্রকারান্তরে শাসকবর্গকেই সহায়তা করা। যেন ওরা সুশাসন ও জনকল্যাণে মনোযোগী হন। এ আদর্শ অনুসরণ করতে গিয়ে সম্পাদকরা বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার হয়েছেন, জেল জুলুম ভোগ করেছেন। ওই সব সাহসী কলম যোদ্ধাদের অনুসরণে গড়ে উঠেছিল ফখরুদ্দীন সাহেবের সাংবাদিক জীবন ও মানসিকতা।

আলাদা একটা জগতে বিচরণ করতেন ফখরুদ্দীন সাহেব। যেখানে কেবল বই আর বই। শব্দের সমুদ্রে অবগাহন করে প্রশান্তি পেতেন। এহেন বিষয় নেই যার ওপর তার পড়াশোনা ছিল না। আবার অন্যকে অকাতরে শেখানোর মধ্যেও পরম তৃপ্তি পেতেন। বন্ধুবান্ধব কিংবা সহকর্মীদের সাথে তার আলাপচারিতায় বেরিয়ে আসত অজানা তথ্য বা ইতিহাস। আমি সমৃদ্ধ হতাম। কখনো এসবের কিছু তথ্য নোট করে রেখেছি। পরে নিজের কোনো লেখায় তা ব্যবহার করেছি। উনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘তুমি এটি জানলে কিভাবে? এটা জানতে তো অনেক স্টাডি করতে হয়, তোমার তো সেই সময় নেই। ভুলে যেতেন কবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলেন।

এমনও হয়েছে যে, একটা শব্দের অর্থ জানতে গেছি। উনি শব্দের অর্থসহ নানা ব্যবহার এমনকি এর সূত্র ধরে নানা দেশের সাহিত্য কিংবা ইতিহাসেও পৌঁছে যেতেন। সে দিন আমার হাতে সব কিছু শোনার মতো সময় ছিল না। আমি রান্নাঘর, খাবার ঘর দৌড়ে দৌড়ে কাজ করছি- অফিসের সময় হয়ে আসছে কিংবা সন্তানদের খাবার দিতে হবে। উনি আমার পেছনে ঘুরে ঘুরে আমাকে শেখাতেন। কখনো বিরক্ত হয়ে বলতেন, কিছু জানতে চেয়ে অর্ধেক শুনে চলে আসো কেন? বললাম, চুলায় রান্না, পুড়ে যাবে তো। তার জবাব হতো, চুলা বন্ধ করে এসো আমি আজ খাবো না, তবু তুমি শেখো।

দুর্ভাগ্য, সেসব মণিমুক্তা গ্রহণ করতে পারিনি। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে তত ভাবিনি। মনে একটাই তাগিদ ছিল, একজনকে তো সংসারের হাল শক্ত হাতে ধরতে হবে।

জীবনে কত শত রাত তিনি জেগে কাজ করেছেন তার হিসাব নেই। যখন কম্পিউটার যুগ আসেনি তখন কোনো দিন অফিস থেকে রাত দেড়টা-দুইটার আগে বাসায় ফেরেননি। পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বেরোলে তো বাসায় আসতে ভোর হয়ে গেছে। ইদানীং আমি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দেখেছি বহুদিন তিনি কম্পিউটারে বসা। পরদিন সকালে উঠে তাকে একইভাবে একই অবস্থায় পেয়েছি।

এত সাদাসিধে চলেছেন তিনি, কোনো দিন একটা দামি জামা কাপড় নিজের জন্য কেনেননি অথচ আমাদের সেরা জিনিসটি কিনে দিতেন। সন্তানদের জন্য অনেক দামি খেলনা কিনে আনতেন। নিজের জন্য বরাদ্দ ছিল বইয়ের বাজেট। বেতন পেয়ে আগে গেছেন বইয়ের দোকানে আগের অর্ডার করা বই আনতে।

তখন বাসায় একটিমাত্র বইয়ের আলমারি ছিল। দেয়ালের তাকের শো পিস সরিয়ে রাখা হয়েছে বই। এরপরে দেয়ালে ক্ল্যাম্পের সাহায্যে তক্তা লাগিয়ে বই রেখেছি। এক দিন একসাথে অনেকগুলো বই নিয়ে এলে আমি বিরক্তি দেখিয়ে বললাম, কবে থেকে বলছি বই রাখার জন্য আলমারি কেনো। এরপরে আলমারি না এনে যদি বই আনো তা হলে বই পুড়িয়ে দেবো। এটি ছিল কেবল কথার কথা। কিন্তু এডিটর মানুষ শব্দের আক্ষরিক গুরুত্ব দেয়াই স্বাভাবিক। ফলে যা হওয়ার তাই হলো, আমাকে ভীষণ তিরস্কার করলেন, এ কথা কিভাবে বললে? একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে বই পুড়িয়ে দেয়ার কথা বলতে পারলে! এই কষ্টটা তার মনে অনেক দিন ছিল।

নিজেকে আড়ালে রাখতেই পছন্দ করতেন। কারো সাথে নতুন পরিচয় পর্বে আপনি কোথায় আছেন, কী করেন এমন প্রশ্নের উত্তরে লাজুক একটা হাসি দিয়ে বলতেন, এই আছি আর কী, একটা পত্রিকায় কাজ করি।

জীবনে যা লিখেছেন সেগুলো একত্র করলে কম করে হলেও ৫০টি বই হবে। কিন্তু লেখা পর্যন্তই উনার দায়িত্ব শেষ। লেখাগুলো যে গুছিয়ে রাখতে হবে সেটি তিনি ভাবতেনও না।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি একখানা দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন। যে গানে বাংলার ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য নতুন করে ফুটে ওঠে। প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক আলাউদ্দীন আলীর সুরে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী লিনু বিল্লাহর কণ্ঠে গানটি বিটিভিতে প্রথম পরিবেশিত হয়। পরে শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে কোটি মানুষের হৃদেয় পৌঁছে যায়। আরো পরে শিল্পী আবেদা সুলতানা, ফেরদৌস আরা, ফাহমিদা নবীর কণ্ঠে গানটি রেকর্ড করা হয়। ১৯৮৪ সালে, ২৯/১ পরীবাগ শাহ সাহেব লেন থেকে প্রকাশিত গীতি কবি সংসদের সঙ্কলনে গানটি প্রকাশিত হয়। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বাংলা দেশাত্মবোধক গান গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৯১ সালে। জাগরণ সংস্কৃতিচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে ২০০৯-এর ‘বিজয়-দিবস’ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনের মঞ্চে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান গানটির গীতিকার আবুল ওমরাহ ফখরুদ্দীনকে সম্মাননা দেয়া হয়।

১৯৭৯ সালে উনার বাল্যবন্ধু সাপ্তাহিক বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী তাকে বলেছিলেন, কবিরা আত্মভোলা হয় জানি তবে, তোমার মতো ভোলানাথ দেখিনি বাবা। তোমার গানটা যে ছিনতাই হয়ে গেছে, খবর রাখো? শাহাদাত ভাই টাইপ করা একখানা কাগজ দেখালেন, যাতে লেখা ছিল ‘গানের স্বত্ব এবং বাণিজ্যিক বেতার-৪ (অনুষ্ঠান ১০-৭৯-১৩১২-২২ এবং ২৯-১১-৭৮... জামান); (পুরো নামটা তিনি আমাকে বলেননি)। পরবর্তীতে বেতার তাদের ভুল শুধরে নেয়। এরকম আরো ঘটনা ঘটেছে ওই গান নিয়ে। তিনি খুব একটা আমলে নেননি।

সাংবাদিক ফখরুদ্দীন সম্পর্কে লেখার মতো উপযুক্ত আমি নই। এরই মধ্যে সোস্যাল মিডিয়ায় অনেক গুণীজন তার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। সেসব লেখা থেকে নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাকে চেনার সুযোগ পেয়েছে। সৎ ও প্রতিভাবান মানুষগুলোকে নতুনদের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরার দায়িত্ব আমাদেরই। একজন আত্মনিবেদিত ও গুণী লেখক হিসেবে এটুকু ভালোবাসা তো সাংবাদিক, লেখক, গীতিকার এ ইউ এম ফখরুদ্দীন পেতেই পারেন।


আরো সংবাদ



premium cement