২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মানবিক পৃথিবীর সংগ্রাম : কে দাঁড়িয়ে কোন দিগন্তে

-

এ দেশে যে ক’জন বুদ্ধিজীবী চিন্তার লাগামকে কলোনি যুগের খুঁটিতে বাঁধা অবস্থায় না দেখার কথা বলেন, তাদের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। তাদের অনেকেই আবার প্রচ্ছন্ন ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত, তারা মাকসবাদে দীক্ষিত এবং এর প্রচারক। তাদের অনেকের জানাশোনার সরহদ্দ প্রশস্ত। রচনার দ্যুতি ও চমক আমাদের অভিভূত করে। তারা যখন সাম্রাজ্যবাদের জোরবারী, মারতাণ্ডব ও চিন্তানৈতিক অমানবিকতাকে খোলাসা করেন, তাতে থাকে বহু হৃদয়ের ভাষাহীন কথার প্রতিভাষ। কিন্তু গোল বাঁধে যখন সাম্রাজ্যবাদের জবরখুরি ও মস্তিষ্কশাসন থেকে বিমুক্ত হওয়ার তরিকা বাতলান। সেই বাতলানো তরিকা অনেক ধানাই-পানাই সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ধোঁয়াশা ছাড়া আর কিছুই হয় না।

অথচ ধোঁয়াশা বরাবরই বিপদজনক। কমিউনিজমের সাথে কিছু লালনীয় ভাববাদ, কিছু লাকা-ফুকো মিশিয়ে একটি অধরা আদর্শ উপস্থাপন করে কেউ কেউ বোঝাতে চান, সাম্রাজ্যবাদ, ভোগবাদ ও তার চৈন্তিক দাসত্ব থেকে মুক্তির এই হচ্ছে প্রকৃষ্ট তরিকা। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকে সচেতন জনগণের প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেন।

প্রশ্নের মুখোমুখি এই দিক থেকে যে, ডাকু-রাহাজানের বিরুদ্ধে জাগ্রত লোকসাধারণের রাহাগিরি কেউ করতে চাইল, সে ডাকু-রাহাজানকে খুব চেনে। কিন্তু যে পথ দিয়ে জনগণকে এগিয়ে যেতে বলল, সে পথ দিয়ে দৌড়ালে দস্যুকে ধরা তো দূরে থাক তার লেজের নাগাল থেকে বঞ্চিত হয়ে উল্টো ব্যর্থতা ও হতাশাকে মাথায় চাপিয়ে জনগণকে ঘরে ফিরতে হবে। ঘরে ফিরে জনগণ বসে থাকবে, এমন নয়। তাদের ত্যাড়া লোকগুলো সেই রাহাগিরকে ধরবে। বলবে বাপু, তুমি আসলে রাহাজানদের একজন। দস্যুদের চিনবার ছল করে তাদের বাঁচিয়ে দিতে জনগণের মধ্যে ঢুকেছিলে! তোমাকেই তাহলে মজা বোঝাই! সেই সব বুদ্ধিজীবী সাম্রাজ্যবাদকে খুব চেনেন। কিন্তু প্রতিরোধ আন্দোলনকে হাঁকাচ্ছেন সাম্রাজ্যবাদেরই সাজানো আরেকটি গলিপথ দিয়ে।

সাম্রাজ্যবাদের জীবনবোধ, সাংস্কৃতিক রসদ ও জ্ঞানতাত্ত্বিক মূল্যমানগুলো পুঁজি করে যাদের জ্ঞানমণ্ডল বিকশিত, তারা যদি একান্ত নেক নিয়তেও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণমানুষের সংগ্রামের পতাকাটা হাতে নেন, তবুও তাদের সেই মূল্যমান তাদেরকে আখেরে খলনায়ক বানিয়ে ছাড়বে, এমন শঙ্কা প্রবল। কেননা চিন্তায়, জীবনবোধে, ব্যবহারিক জীবনাচারে তারা সাম্রাজ্যবাদকে অতিক্রম করতে পারেন না এবং ফলত নিজের জীবনকেই সাম্রাজ্যবাদের কুয়াশাচ্ছন্ন এক দিগন্তরেখায় হাঁসফাঁস করতে দেখেন। যেখানে তারা না এই কুয়াশাকে পারছেন গায়ে মাখতে, না পারছেন অস্বীকার করতে, এমন দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে নিজের ভেতর নিজেকেই ক্রমাগত কর্তন করেন। তাদের পদক্ষেপগুলো ক্রমাগত জিজ্ঞাসা চিহ্ন তৈরি করে। তাদের উচ্চারণের আড়ালে লুকিয়ে থাকে সংশয় ও অস্পষ্টতা কিংবা তারা খুব স্পষ্ট সত্যের ধারাবিবরণী দিয়েও অবশেষে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার গোটা প্রচেষ্টাকে ভুল উপসংহারে উপনীত করেন। পথভ্রষ্ট করে ছাড়েন। তাদের গোটা তৎপরতা এটাই বোঝায় যে, সাম্রাজ্যবাদ থেকে আজাদীর বিষয়টি দিকচিহ্নহীন এক পরিক্রমণ। যেখানে কথার ফুলঝুরি, প্রতিবাদের উত্তাপ এবং মানবতার নামে অশ্রুবর্ষণ ছাড়া আর কোনো নেক আমলের সুযোগ নেই। তাদের এই প্রচেষ্টা প্রকারান্তরে সাম্রাজ্যবাদ থেকে আজাদি আন্দোলনের প্রতি গণমানুষকে অনীহ করে, বীতশ্রদ্ধ করে এবং গোটা আন্দোলনকে ধূম্রপুঞ্জে পর্যবসিত করে। ফলে এই আন্দোলন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সাম্রাজ্যবাদেরই এক ধরনের খেদমত ছাড়া কিছুই দাঁড়ায় না।

ফলত দুয়ে দুয়ে চারের মতো সহজ হিসেবে এই কিসিমের আন্দোলনের দিকপালদের সন্দেহভাজন হিসেবে দেখতে থাকা অস্বাভাবিক নয়। আজকাল এই খাসলতের আন্দোলনওয়ালারা দেদার ময়দানে আসছেন। তারা সাধারণত চর্বিত চর্বণ ছাড়া অন্য ক্রোনা পুঁজির অধিকারী নন। মুক্তি আন্দোলনের দিক থেকে এদের কর্মকাণ্ড ও ইলম-আকল আগাগোড়াই প্রতিক্রিয়াশীলতা বৈ নয়। প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে গণমুক্তির জিম্মা চাপানো আর শিয়ালের হাতে মোরগ বর্গা দেয়া এক কথা। আমরা এমনতরো ভুল করতে পারি না। আমাদেরকে অবশ্যই আদর্শিক এতিমির মধ্যে পাতানো স্লোগানের শূন্যে গোলা ছোড়া, কিংবা বিশ্বাসের মূল্যমানকে উপেক্ষাকারী সংশয় ও দ্বন্দ্ব চর্চা কিংবা বস্তুবাদী আধ্যাত্মিকতার গন্তব্যহীন অভিযাত্রার ফাঁক ও ফাঁকি অতিক্রম করতে হবে। এটা এ জন্যই যে সাম্রাজ্যবাদের শক্তিবাজি তার গোটা কাঠামোর সাথে সংযুক্ত। সে এক পরিপূর্ণ জাহেলি মূল্যমান। যার কোনো একটি অংশকে মেনে নিয়ে অন্য অংশকে অস্বীকার করা যায় না। করলেও তা সোনার পাথর বাটির মতো স্ববিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপনার খুবই দুশমনি, কিন্তু জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে আপনি মজে আছেন, দুনিয়া শাসনের জন্য তার প্রণীত রাজনৈতিক মতাদর্শেই ঈমান আপনার, নারী-পুরুষ সম্পর্ককে সে যেভাবে দেখায়, আপনিও সেভাবে দেখেন, মানবজীবনের উৎস, উদ্দেশ্য ও গন্তব্য সম্পর্কে তার বক্তব্যের বাইরে আপনি কিছু বোঝেন না। সেই আপনি এসে বললেন, ‘সাম্রাজ্যবাদের কবর খুঁড়তে চাই’, আপনাকে বিশ্বাস করলে কী হবে তা তো সুস্পষ্ট। কবর আপনি করবেন বটে! কিন্তু সেটা হবে মুক্তি আন্দোলনের কবর, সাম্রাজ্যবাদের নয়।

তাই, মানবতার মুক্তি আন্দোলনের পক্ষ প্রতিপক্ষ সনাক্তকরণ আজকের অগ্রাধিকার। এ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ ও তার সাথে সঙ্ঘাতরত জীবনাদর্শের বিপরীতমুখী দুই দিগন্ত সুস্পষ্ট। কে দাঁড়িয়ে আছে কোন দিগন্তে, কার চাল কোন প্রান্তকে কেন্দ্র করে, তা বোঝার মাধ্যমেই খোলাসা হবে গণমানুষের মুক্তি আন্দোলনের শত্রু-মিত্রের পরিচয়। অতএব, আজকের দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের ঘোষিত দুশমন ইসলামকে কে কিভাবে দেখছে এটা উদঘাটনের সাথে জড়িত রয়েছে মুক্তি আন্দোলনের ভেজালমুক্তির মৌলিক প্রশ্নটি।

ইসলাম যেহেতু সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিটি ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ করে, যে জীবনদৃষ্টিকে উছিলা করে তার বুনিয়াদ গড়ে ওঠে, ইসলাম সেই জীবনদৃষ্টিকে হারাম ঘোষণা করে। সে যখন প্রভুত্ব চায়, ইসলাম বলে প্রভুত্ব একমাত্র আল্লাহর, অন্য সব দাবিদার প্রভুর বিরুদ্ধে ইসলাম আপন অবস্থান ঘোষণা করে, সে যখন চায় শ্রেণী, সম্প্রদায়, লিঙ্গ ও বর্ণবৈষম্য, ইসলাম তখন বৈষম্যের শিকড় কেটে সব মানুষকে নিয়ে গড়ে তুলতে চায় অবিচ্ছিন্ন উম্মাহ, সে যখন চায় জাতিগুলোর অধিকার, সম্পদ ও শ্রম শোষণ, ইসলাম তখন এর প্রতিপক্ষে মাথা তুলে দাঁড়ায়, সে যখন শক্তি ও প্রতিপত্তির পূজা করে, ইসলাম তখন ইনসাফপূর্ণ পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সে চায় পরিবার ভাঙতে, ইসলাম দেয় পরিবার গড়ার কর্মসূচি, সে চায় সমাজ ও ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা, ইসলাম উভয়কে গ্রথিত করতে চায়, সে চায় উলঙ্গ প্রবৃত্তিপনা, ইসলামে একে গুরুতর সমাজবিধ্বংসী অপরাধ সাব্যস্ত করে, এভাবে জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই যে রূপ ও রঙ সহকারে সে জাহির হয়, ইসলাম তার স্বরূপ চিহ্নিত করে এবং বিকল্প ব্যবস্থাপনা নিয়ে হাজির হয়।

মুসলমানদের অজস্র দুর্বলতা এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে ইসলামের নির্দেশনা অপ্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও ইসলামের এই ভূমিকা সাম্রাজ্যবাদের শিরোপীড়ার কারণ এবং এ কারণেই ইসলামের নাম শোনামাত্র সে তার মৃত্যু কল্পনা করে। এই মৃত্যু আতঙ্কের জাহেরি সুরত হলো মিডিয়ায় ইসলামের সাথে সন্ত্রাস ও ভীতিকে জুড়িয়ে দেয়া এবং মুসলিম মাত্রই ভয়ঙ্কর- এমনতরো প্রোপাগান্ডা।

লেখক : কবি, গবেষক।


আরো সংবাদ



premium cement
হাতিয়া-সন্দ্বীপ চ্যানেলে কার্গো জাহাজডুবি : একজন নিখোঁজ, ১১ জন উদ্ধার হঠাৎ অবসরের ঘোষণা পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়কের বগুড়ায় গ্যাসের চুলার আগুনে বৃদ্ধা নিহত বগুড়ায় ধানের জমিতে পানি সেচ দেয়া নিয়ে খুন জিআই স্বীকৃতির সাথে গুণগত মানের দিকেও নজর দিতে হবে : শিল্পমন্ত্রী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ চুয়েট, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ সখীপুরে সাবেক ও বর্তমান এমপির সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অন্যতম দায়ী : মির্জা আব্বাস সৈয়দপুরে জামায়াতের উদ্যোগে সালাতুল ইসতিসকার নামাজ আদায় জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে না থাকার কারণ জানালেন সাকিব ঝালকাঠিতে গ্রাম আদালত কার্যক্রম পরিদর্শনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল

সকল