২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনার প্রভাব

-

একজন স্বশিক্ষিত মানুষকে জানি যিনি তেমন কোনো ডিগ্রিধারী নন। তিনি একটি বিদ্যালয়ে দাফতরিক চাকরি করতেন। তিনি তার চাকরিটাকে নাকি কখনোই ছোট করে দেখতেন না, বরং খুবই সম্মানের চোখে দেখতেন। খুবই যত্ন সহকারে চাকরিটি করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি সুযোগ পেলেই পড়াশোনা করেছেন প্রচুর। তার সাথে সব সময়ই একটি বই থাকত। এমন একজন মানুষ তো সুশিক্ষিত না হয়ে যায় না। তিনি শুধু পড়তেনই না, টুকিটাকি লেখালেখিও করতেন। ফলে যা হয়, তার জগতে তিনি একটি বিশেষ স্থান পেয়ে গেলেন। একটি প্রখ্যাত কাব্যগ্রন্থের আঞ্চলিক সম্পাদক পর্যন্ত হলেন তিনি। তার ঝুলিতে বিশেষ সংখ্যক অ্যাওয়ার্ডও এসে গেল, যদিও তার শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যার মতোই শত্রুর সংখ্যাও কম নয়। তবে তা ধোপে টেকেনি। আমি তার ওই কাব্যগ্রন্থে মাঝে মাঝে ছোটখাটো কবিতা পাঠাই যেমন পাঠাই অন্য কোথাও কোথাও। কবিতাগুলো কেন যেন ছাপা হয়ে যায়। তবে ওই কাব্যগ্রন্থে ছাপানো কবিতার সংখ্যাই বেশি। তার কারণ আছে, এ ব্যক্তির ব্যবহার এত সুন্দর আর লেখা সংগ্রহের আগ্রহ এত প্রবল যে, নীতিগতভাবেই মুগ্ধ হতে হয়। তিনি এমনকি পারিবারিক কুশলাদিরও খোঁজ নেন। তবে ইদানীং একটি বিষয় আমাকে একটু ভীত করে তুলেছিল। ফোন করলেই মনে হতো ওনার শরীর ও মন বেশ দুর্বল। কোনো কোনো সময় বলেই ফেলতেন, ‘দিদি’ আগের মতো আজকাল কাজ করতে পারি না, শরীর চলে না, কাজ আগায় না।’ হবেই তো, তার বয়সও অনেক, ৮৩ বছর। কখনো কখনো বলতেন ‘দিদি, বয়স হয়েছে, কখন যে চলে যাই, ভগবান যেন আমায় গ্রহণ করেন।’ উল্লেখ্য, তার স্ত্রীও একজন লেখক। তার সাথেও আমার কথা হয় মাঝে মাঝে। অপূর্ব তার ব্যবহার।

যা বলছিলাম, সম্পাদক মহাশয় করোনা দুর্যোগ শুরুর প্রায় দু’মাস পরে আমাকে ফোনে জানালেন অত্যন্ত নরম সুরে ‘দিদি, আমি খুবই অসুস্থ ও দুর্বল তো আছিই, প্রার্থনা করবেন, প্রার্থনা করবেন সবার জন্য। মায়ের কাছেই আছি, মায়ের পায়ে নিবেদিত আমার প্রাণ।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘কোথায় আপনার মা?’ তিনি জানালেন, ‘আমার মা কি আছেন? আমি মন্দিরে মায়ের সেবায় নিয়োজিত হয়েছি।’ বিষয়টি বুঝতে পারলাম। প্রায় ১০ দিন পর তার ফোন পেলাম। তিনি জানালেন, ‘মায়ের জন্য করতে তো জানেন দুঃখীজনের সহায়তা দিতে হয়। এ ব্যাপারে আমার একটা দাবি থাকল আপনার কাছে, দেখবেন।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে’। ভাবলাম পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়ে এলে কিছু টাকা পাঠাব ‘বিকাশ’ করে। উল্লেখ্য, এ সম্পাদক মহাশয়কে কখনো দেখিনি, ফোনেই কথা হয় সময় সময়।

গত ১৪ এপ্রিল সকালে ঠিক সাড়ে ৮টায় একটি ফোন এলো। একজন আমাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানালেন এবং বললেন, ‘ভয় পাবেন না, মনে শক্তি ধরে রাখুন, দেখবেন এ বিপর্যয় যেমন এসেছে কেটেও যাবে।’ খুবই স্পষ্ট এবং শক্তিশালী কথাবার্তা। কে ফোন করলেন বুঝে ওঠার চিন্তা করতে না করতেই তিনি বললেন, ‘রাখে হরি মারে কে, মারে হরি রাখে কে?’ বুঝতে পারলাম, সম্পাদক মহাশয়। এত শক্তি সাহস মনোবল সম্পাদক মহাশয় কোথায় পেলেন চিন্তা করতে থাকলাম। আমাকে অবশ্যই উপসংহারে আসতে হলো যে, মহাবিপদে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মানুষ যখন যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং সে যখন নিরস্ত্র থাকে তখন সে এতটাই সাহসী হয়ে যায় যে, শুধু হাত দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঠেকায়। বুঝতে পারলাম। কোভিড-১৯ এর প্রভাব এটি।

আরেকটি ঘটনা জানা আছে আমার, সেটিও কোভিড-১৯-এর প্রভাব। এখন সেই ঘটনাটি বর্ণনা করছি। আমার জানা এক দম্পত্তির গল্প এটি। ভদ্রলোকের অভ্যাস, নিজের চাকরির সময় বাদে নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকা। এতটাই পরিবারের চেয়ে সমাজের জন্য ব্যস্ততা তার যে, তাকে ঘরে খুব কমই পাওয়া যায়। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ আর কী! বর্তমানে বেশ কয়েক বছর হলো তিনি যেহেতু অবসরপ্রাপ্ত তিনি তার পুরো সময়ই পরিবারের বাইরে ব্যয় করেন। তিনি মসজিদ কমিটিতে আছেন, বিল্ডিং কমিটিতে আছেন, পাড়ার কমিটিতে আছেন; কোথায় নেই? কিন্তু তার পরিবারেও তিনি কর্তব্যপরায়ন। অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ভদ্রলোক। তার দুটো সন্তান- একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। অত্যন্ত মেধাবী। দু’জনই বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার। তারা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে বিদেশে বড় বড় পজিশনে চাকরি করছে এবং রীতিমতো ডলার ইউরো পাঠাচ্ছে। ছেলেটি বাবা-মাকে একটি সুন্দর ফ্লাটও কিনে দিয়েছে। সুতরাং ভদ্রলোকের বনের মোষ বেশি করে তাড়াতে আর কোনো বাধা রইল না। ভদ্রলোক আদতেই একজন ভদ্রলোক। পরিবারে তিনি কখনো অশান্তি করেননি, কস্মিনকালেও না। সুতরাং তার ছেলেমেয়ে তো বটেই, তার স্ত্রীও তার প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট। কখনো কখনো তার স্ত্রী স্বামী হিসেবে এই ভদ্রলোকের প্রশংসায়ও দ্বিধা করেন না। ইদানীং কোভিড-১৯-এর কারণে অতি কষ্ট করে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, আত্মীয় স্বজন ও পাড়ার লোকের চাপে মাত্র প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে বাসায় আবদ্ধ। তারা আমার খুবই কাছের আত্মীয়। লকডাউনের মধ্যে কে কেমন আছেন জানার জন্য ফোন করলাম উনার স্ত্রীর কাছে। মহিলা প্রায় কেঁদেই ফেললেন। বললেন, ‘আপা, আমি জানতাম না এই লোক এত উদ্ভট! সব সময় ঝগড়া করে, দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ায়, রাগারাগির তুঙ্গে বাটি ছুড়ে মারে, গ্লাস ছুড়ে মারে, আমার ঘরে থাকা দায়। এই লোক যে এত বাজে তা কখনো জানতাম না। আমি কোথায় যাবো আপা?’ আমার বুঝতে বাকি রইল না যে, এটা কোভিড-১৯-এর প্রভাব।

পরিশেষে আমি ভাবতে বসে ভাবলাম, কোভিড-১৯ মানুষের জীবনই শুধু কেড়ে নিচ্ছে না, কেড়ে নিচ্ছে মানসিক সুস্থতাও। আবার মনের অবস্থার উন্নয়নও ঘটাচ্ছে। মানুষের বিপর্যয় আসে, আবার চলেও যায়। কোভিড-১৯ ও চলে যাবে, মানুষ ঘুরেও দাঁড়াবে একদিন। তবে লাভ-ক্ষতির বেলায় ভালো বেশি আসবে, না মন্দ? আমার ভয় হয় মন্দের আশঙ্কায়। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধতুল্য কিংবা তার চেয়েও শক্তিশালী কোভিড-১৯ আমাদের যে মন্দের মধ্যেই ডুবিয়ে দেবে তাতে সন্দেহ নেই। কেননা, এমন কিছুর মধ্যেও আমরা চাল চুরি করি, তেল চুরি করি। এসব দেখে শুনে মানুষ আবদ্ধ থেকে থেকে মানসিক সুস্থতা তো হারাতেই পারেন, বিশেষ করে যারা সতত মানুষের মঙ্গলের জন্য ব্যাপৃত ছিলেন, ব্যস্ত ছিলেন।

লেখক : প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement
গণকবরে প্রিয়জনদের খোঁজ কক্সবাজারে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, স্বজনদের হাসপাতাল ঘেরাও বঙ্গোপসাগরে ১২ নাবিকসহ কার্গো জাহাজডুবি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশকে ‘নেট সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি রাজশাহীতে টানা তাপদাহ থেকে বাঁচতে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা শরীয়তপুরে তৃষ্ণার্ত মানুষের মাঝে পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ জামায়াতের এক শ্রেণিতে ৫৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী নয় : শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নজিরবিহীন দুর্নীতির মহারাজার আত্মকথা ফতুল্লায় ১০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে নির্মাণকাজ বন্ধ, মারধরে আহত ২, মামলা পার্বত্যাঞ্চলে সেনাবাহিনী: সাম্প্রতিক ভাবনা

সকল