২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কলেজ শিক্ষকতা কালের কিছু স্মৃতি

কলেজ শিক্ষকতা কালের কিছু স্মৃতি - ছবি সংগৃহীত

১৯৭৪ সালের নভেম্বরে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে চাকরি পেলাম। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোবার পর এটি আমার পঞ্চম চাকরি। জীবনে এই প্রথম যমুনা পাড়ি দিতে যাচ্ছি। আরিচা ঘাটে লঞ্চে উঠলাম। রাত ১০টা পর কলেজে গিয়ে পৌঁছলাম। রাতের জন্য হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হলো। সকালে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দিলাম। কলেজে শিক্ষকদের জন্য মেস আছে। পরে তাতেই থাকার ব্যবস্থা হয়।

এর অল্প কিছু দিন পর ক্যাপ্টেন মনসুর আলী প্রধানমন্ত্রী হলেন। মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে তিনি নিজ জেলা পাবনায় আসছেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ সকালে সব শিক্ষককে ক্যাম্পাসের মাঠে খালি পায়ে জড়ো হতে বললেন। আমরা সবাই নির্দেশমতো মাঠে জড়ো হলাম। এরপর সেখান থেকে লাইন ধরে রাস্তার বাম পাশ দিয়ে হেঁটে ডিসি অফিসের সামনে রাস্তার ধারে শহীদ মিনারে এলাম। প্রধানমন্ত্রী তখনো আসেননি। আমরা যে যার মতো কেউ ক্যান্টিনে চা খাচ্ছি, কেউ এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছি। কেউ শিক্ষকদের এতটা পথ খালি পায়ে হাঁটিয়ে আনার প্রতিবাদে চাপা গজ গজ করছি। প্রধানমন্ত্রী এলেন। তিনি এসে সোজা শহীদ মিনারে ফুল দিতে চলে গেলেন। চার দিকে গ্রিল দিয়ে ঘেরা শহীদ মিনারে প্রবেশের সময় প্রধানমন্ত্রী গেটে তার সাদা চটি জোড়া রেখে গেলেন। পাবনা পৌরসভার চেয়ারম্যান আবদুল গনি প্রধানমন্ত্রীর চটি জোড়া তুলে বগলে করে ভেতরে প্রবেশ করলেন। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যেমনি এসেছিলেন তেমনি চলে গেলেন। আমরা খামোখাই এসেছি। আমরা রোদ মাথায় করে দুপুরে খালি পায়ে গরম পিচঢালা পথে হেঁটে কলেজে ফিরলাম।

এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বদলি হয়ে তিতুমীর কলেজে এলাম ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে। সে সময় এ কলেজের দক্ষিণের সীমানা দেয়ালের সামনের খালি জায়গাটা নিয়ে একটা সমস্যা ছিল। শোনা যাচ্ছে এ জায়গায় বহুতল বাণিজ্যিক ভবন গড়া হবে। এ যদি সত্যিই হয় তবে কলেজটি এসব ভবনের আড়ালে অসুন্দর ও বদ্ধ পরিবেশে আটকে যাবে। কলেজ কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে উৎকণ্ঠিত। এ ছাড়াও কলেজের নিজস্ব হোস্টেল ভবন নেই। ছাত্ররা বনানীতে ভাড়া করা বাড়ির হোস্টেলে থাকে। কলেজের সামনে সীমানার ভেতর লাখ লাখ ইট স্তূপ করে রাখা হয়েছে কলেজের অডিটোরিয়াম নির্মাণের জন্য। কিন্তু অডিটোরিয়াম হচ্ছে না।

কলেজের সামনে পশ্চিম দিকে সিঅ্যান্ডবির একটি গ্যারেজ কলেজের সৌন্দর্যহানি করছে। সেখানে কলেজের হোস্টেল নির্মিত হলে কলেজের পরিবেশ উন্নত হয়। এ-জাতীয় বিভিন্ন সমস্যা কলেজের। কলেজ কর্তৃপক্ষ বিস্তর লেখালেখি করেও কোনো ফল পাচ্ছেন না। শেষ পর্যন্ত গণপূর্তমন্ত্রী টাঙ্গাইলের আবদুর রহমানকে কলেজে দাওয়াত করা হলো। উদ্দেশ্য সরেজমিন তাকে কলেজের সমস্যা অবহিত করা। অধ্যক্ষ নুরুজ্জামান সাহেবই ক’জন প্রবীণ শিক্ষককে নিয়ে এ ব্যবস্থা করেছেন। আমরা নবীনরা এর কিছু জানি না।

এক দুপুরের একটু আগে অধ্যক্ষের কক্ষে এলাম। দেখি দীর্ঘকায় এক পৌঢ় ভদ্রলোক সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে অধ্যক্ষের সামনে বিনীত ভঙ্গিতে বসে আছেন। অধ্যক্ষ তার নিজ চেয়ারে বসে সামনের দিকে ঝুঁকে নিবিষ্ট মনে কিছু লিখছেন। দু-একজন শিক্ষকও আছেন। আমি অধ্যক্ষের সামনের একটি চেয়ারে বসলাম। পাশে বসা এক সহকর্মীর কাছে আগন্তুকের পরিচয় জানতে চাইলাম, ‘ইনি কে’? তিনি আস্তে বললেন, ‘গণপূর্তমন্ত্রী আবদুর রহমান সাহেব’। একটু পর কে একজন এসে বলল, ‘এবার চলেন স্যার’। অধ্যক্ষ গণপূর্তমন্ত্রীকে বললেন, ‘চলুন আমরা মাঠে যাই’। আমাদের বললেন, ‘আপনারাও আসুন’।

কলেজ মাঠের পুব সীমানার মাঝামাঝি জায়গায় একটি ছোট্ট সাদামাটা লাল রঙের সাদা ঝালরওয়ালা শামিয়ানা টানানো হয়েছে। এর নিচে মাঠে কাঠের ফ্রেমে বেতের ক’টি চেয়ার। মন্ত্রী আর অধ্যক্ষ ও আমরা ক’জন শিক্ষক শামিয়ানার নিচে। গুটিকয়েক ছাত্র যারা খবর পেয়ে এসেছে ,তারা সামনে মাঠের ঘাসের ওপর বসেছে। দু-চারজন ছাত্র তাদের বিনীত সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে কলেজের সমস্যা তুলে ধরল। এরপর মন্ত্রী বক্তব্য দিতে উঠলেন। তিনি অল্প ক’টি কথা বললেন। কারো স্তুতি নয় নিন্দা নয়, তিনি কেবল বললেন, ‘আপনাদের এত সমস্যা! এর মধ্যেও মন্ত্রীকে চা নাশতা খাইয়ে আপ্যায়ন করেছেন। আপনারা যে মন্ত্রীকে মারেন নাই এটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। আমি দেখব।’

অধ্যক্ষের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে সভা শেষ হলো। মন্ত্রীর নম্রতা বিনয় ভদ্রতা ও কর্তব্যবোধের তাগিদ দেখে অবাক হলাম। এর আগে মন্ত্রী অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীও কলেজে এসেছিলেন। কলেজের কলা ভবনের নিচ তলার একটি শ্রেণিকক্ষে তিনিও কারো স্তুতি নয় নিন্দা নয় কেবল ‘বৃক্ষ’ সম্পর্কে একটি অরাজনৈতিক বক্তব্য রেখে গেছেন। তিনি যে সত্যিকার অর্থেই একজন যথার্থ শিক্ষক, তার প্রমাণ তিনি সেদিন রেখে গেছেন। আমরা শিক্ষক ছাত্র সবাই তার বক্তব্যের অনুপম সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি। তিনি নিজেও গৌরকান্তি সুপুরুষ। এদের কারো সাথেই কলেজ অভ্যন্তরে সাঙ্গোপাঙ্গ, কোনো গাড়ি বা পুলিশ দেখিনি।

তিতুমীর কলেজ থেকে ১৯৮০ সালের মার্চে বদলি হলাম আমার ছাত্র জীবনের ঢাকা কলেজে। কলেজে পুনর্মিলনী উৎসব হবে। এ কলেজের অসংখ্য ছাত্র জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক উঁচু উঁচু পদে অধিষ্ঠিত। মন্ত্রীই প্রায় আধা ডজনের বেশি। প্রতিষ্ঠিত সামরিক বেসামরিক আমলা প্রকৌশলী ডাক্তার ব্যবসায়ী রাজনীতিক, কে নয়? বিশাল আয়োজন। মাঠের পশ্চিম পাশে বিশাল শামিয়ানা টানিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে। স্মৃতিচারণ, ডিবেট সবই হলো। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মন্ত্রী জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান বললেন, ‘সাইকেলে চড়ে কলেজে আসতাম। সাইকেলের চেনে জড়িয়ে পাজামা ছিঁড়ে যেত। যতবার ছিঁড়ত ততবারই পাজামায় গিঁট্ঠু মারতাম। গিঁট্ঠু মারতে মারতে পাজামা হাঁটু পর্যন্ত উঠে যেত। এটাই পরে পরদিনও কলেজে আসতাম। আর আজ তোমরা? সেটা ভাবতেই পার না’। ডিবেটের বিষয় কী ছিল মনে নেই। এর এক পক্ষে প্রবীণদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রফেসর বদরুদ্দোজা চৌধুরী আর অপরপক্ষে নবীনদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাহমুদুর রহমান মান্না। নবীনেরই জয় হলো।

১৯৮৩ সালে টাঙ্গাইল করটিয়া সা’দত কলেজে বদলি করা হলো আমাকে। সে সময়ের টাঙ্গাইল দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা হলেও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অগ্রসর। ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১ মে, ১৬ ডিসেম্বর, ১ বৈশাখ জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়। যথাযথ অনুষ্ঠানাদির পাশাপাশি সাহিত্য সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। এসব সঙ্কলনে আমার লেখা ছাপা হয়। যে পৌনে আট বছর এখানে ছিলাম এর কোনো বছরই এর ব্যতিক্রম হয়নি। এ ছাড়াও সাপ্তাহিক ‘টাঙ্গাইল বার্তা’ ও সাপ্তাহিক ‘লোককথা’য় নিয়মিত আমার কবিতা ও প্রবন্ধ ছাপা হতো।
সে সময়ের টিনের ঘর বহুল এই ছোটখাটো শহরটির লোকদের সহজ-সরল চলাফেরা ও ব্যবহারের আন্তরিকতা ও অকৃত্রিমতা হৃদয়কে স্পর্শ করে। নিজেদের মধ্যে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়েও ঝগড়াঝাটি হয় আবার নিমেষেই মিটমাট হয়ে গলাগলি ভাব। একটি কথা শুনেছি যে শিক্ষিত লোকের মধ্যে বিরোধ হলে তা সহজে মিটমাট হয় না। দেখলাম টাঙ্গাইলে এর ব্যতিক্রম। অবশ্য রাজনৈতিক বিরোধের কথা আলাদা।

টাঙ্গাইলের জেনারেল মাহমুদুল হাসান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। কলেজে তার সংবর্ধনা। অডিটোরিয়ামে ছাত্র শিক্ষকের উপচে পড়া ভিড়। মন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে ছাত্র-শিক্ষক ক’জন বক্তৃতা দিলেন। ঢাকা নগর মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রশাসক থাকাকালে নানা দুর্নীতির অভিযোগে মাহমুদুল হাসান বিতর্কিত হন। এ নিয়ে নানা জন নানা কথা বলত। কলেজের সংবর্ধনায় দেখলাম বক্তারা সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এদের কাউকে জনান্তিকে তাকে নানা কুরুচিপূর্ণ বিশেষণে বিশেষিত করতে দেখেছি।

মন্ত্রী অনেকের সাথে ঢাকার খাস অধিবাসী এক যুবককে সাথে করে এনেছেন তার গুণকীর্তন করার জন্য। সবশেষে মাহমুদুল হাসান তার বক্তৃতায় অনেক কথাই বললেন। একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘আমার সাথে সহযোগিতা করতে হবে। কেউ যদি বিরোধিতা করে তাইলে টান দিয়া ফড়িংয়ের মতো ছিড়া ফালামু’। আমি অবাক বিস্ময়ে স্বাধীন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তৃতা শুনলাম। কবি ফররুখ আহমদের কবিতার ক’টি চরণ মনে পড়ল- ‘মানুষ-শিকারী পশু/ইনসানের ছায়া দেখে অকারণে বাড়াও হিংস্রতা/লুব্ধ হও চিতা কিম্বা আজদাহার মত’।

এরপরে বিভিন্ন কলেজে সামনাসামনি আরো অনেক মন্ত্রী দেখেছি ও তাদের বক্তৃতা শুনেছি, কিন্তু উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু মনে পড়ছে না।
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ভাইস প্রিন্সিপাল, মহিলা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা


আরো সংবাদ



premium cement
শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৪০ নিউইয়র্কে মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করবে যুক্তরাষ্ট্র! টাঙ্গাইলে লরি-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে নিহত ১ জিম্বাবুয়ে সিরিজে অনিশ্চিত সৌম্য বেনাপোল সীমান্তে ৭০ লাখ টাকার স্বর্ণের বারসহ পাচারকারী আটক

সকল